প্লিজ, বলুন তো ১/১১র সময়ে কয়জন ভয় পাননি

গোলাম মাওলা রনি….ঘটনার দিন কী বার ছিল এবং তারিখই বা কী ছিল তা আজ আর মনে নেই। তবে সেই কুলক্ষুনে ঘটনার স্মৃতি ভুলবার নয়। আমি তখন বর্তমানের তুলনায় অনেক সচ্ছল এবং ব্যস্ত একজন ব্যবসায়ী। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন অদ্ভুত এবং অভিনব এক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত সচল রাজনীতির মাঠে আমি ফরিদপুর জেলার একটি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। মনোনয়নপ্রাপ্তি এবং নির্বাচনে জয়লাভের জন্য যা যা দরকার ছিল তা আমি অতি নিষ্ঠার সাথে করে আসছিলাম ২০০১ সালের পর থেকেই। দলের প্রতি মমত্ববোধ এবং রাজনৈতিক মনমানসিকতার কারণে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও সহমর্মিতা ছিল। বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে যাওয়া, সন্ধ্যার পর নেত্রীর কার্যালয়ে হাজিরা দেয়া এবং দুপুরে সমমনা নেতাকর্মীদের সাথে একত্রে খাবার খাওয়া রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ১/১১র পরের দিন মনে হলো রাজনীতির মাঠে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে- পরিচিত কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ৮-১০ দিন পর দু-একজনের সাথে যা-ও দেখা হলো, তারা সবাই নেত্রীকে দোষারোপ করলেন এবং বললেন, জীবনে আর রাজনীতিই করতে চান না- বাকিটা জীবন বউবাচ্চা নিয়ে নিরাপদে কাটাতে চান।

১/১১র প্রথম বছরটি ছিল বাহারি সাসপেন্স, থ্রিল এবং অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ। যত সচ্ছল এবং মুক্তচিন্তার মানুষজন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, আমলা-কামলা এবং রাজনীতিবিদেরা পড়লেন মহাসঙ্কটে। প্রথমে ১০০ চিহ্নিত দুর্নীতিবাজের তালিকা প্রকাশ করা হলো। দ্বিতীয় দফায় আরো ১০০ জনের তালিকা সংযুক্ত করা হলো। হাতেগোনা অল্প কয়েকজন বাদে তালিকার অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সারা বাংলাদেশে এন্তার অভিযোগ ছিল। লোকজন বলাবলি করছিল, সামরিক আদালতে দুর্নীতিবাজদের বিচার করা উচিত। অনেকে আবার তাদের ক্রসফায়ারে দিয়ে মেরে ফেলার কথাও বলাবলি করতে লাগল। জনসমর্থনের হালনাগাদ দশা দেখে ১/১১র কুশীলবরা আনন্দে নাচানাচি আরম্ভ করলেন। তারা দুদক পুনর্গঠন করলেন আর পুনর্গঠিত দুদক দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভীতিকর গান রচনা করে তা নাচন-কুর্দনসহকারে টেলিভিশনগুলোতে প্রচার করতে থাকল। সেনা কর্মকর্তা, এনএসআই, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং দুদক মিলে একটি শক্তিশালী কমিটি বানাল দুর্নীতিবাজদের জিজ্ঞাসাবাদ, তাদের সম্পদের খোঁজখবর করা এবং তাদের শাস্তির আওতায় আনার জন্য।
চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের বিরাট অংশটি পালিয়ে গেল। সামান্যসংখ্যক ধরা পড়ল। রাজনীতির মাঠ ফাঁকাÑ সবাই শুধু ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি জপছে। এ অবস্থায় রাজনীতিবিদ, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ীদের একটি বিরাট গ্রুপ ১/১১র কুশীলবদের সাহায্য সহযোগিতা দিতে এগিয়ে এলেন অথবা তাদের এগিয়ে নিয়ে আসা হলো। এ ঘটনা ঘটল মে-জুন মাসের দিকে। কিন্তু তার অনেক আগেই বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের গ্রেফতারকৃত শীর্ষ নেতারা তাদের দলীয় প্রধানের বিরুদ্ধে যাচ্ছেতাই স্বীকারোক্তি দিলেন। যারা গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছিলেন, তারা যেকোনো শর্তে তৎকালীন মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের কাছে দেহ-মন মাথাসহ আত্মনিবেদন করতে পাঁচ পায়ে দাঁড়িয়ে গেলেন (মানুষের হাত-পা এবং নাক যখন একত্রে মাটি স্পর্শ করে কারো সামনে অবনত হয়, তখন তাকে পাঁচ পায়ে দাঁড়ানো বলে)। ১/১১র কুশীলবরা এই সুযোগটি পুরোমাত্রায় কাজে লাগালেন। আওয়ামী লীগের অফিসগুলো যারা দখলে নিয়ে নিলেন, তারা নিজেদের সংস্কারবাদী হিসেবে জাতির সামনে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অন্য দিকে, আওয়ামী সংস্কারবাদীদের তুলনায় বিএনপির সংস্কারবাদীরা দুর্বল ছিলেন। তারা বিএনপি অফিস দখল নিতে পারলেন না। ফলে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের যৌথ মহড়ায় সংস্কারবাদীরা একদিন অল্প কিছুক্ষণের জন্য নয়া পল্টনস্থ বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসটির তালা ভেঙে সেখানে ঢুকলেন এবং সংক্ষিপ্ত টিভি সাক্ষাৎকার দিয়ে কেটে পড়লেন।
১/১১র সময়ে সংঘটিত ঘটনাবলি এবং আমার একটি নির্মম অভিজ্ঞতার কথা হঠাৎ করেই মনে পড়ল ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদকের হাল আমলের করুণ অবস্থা দেখে। সরকারদলীয় জোট এখন যেকোনো মূল্যে তাদের শ্রেণিশত্রু। তাদের চলার পথের বাধা বলে বিবেচিত পথের কাঁটাগুলো এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূল করার অছিলা খুঁজে বেড়াচ্ছে। সরকারি দল মনে করে. ড. ইউনূস, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান এবং ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের ত্রিভুজীয় প্রচেষ্টা, সমর্থন এবং মদদের কারণে ১/১১ প্রলম্বিত হয়েছিল এবং তাদের নেত্রীকে জেলে ঢোকানো হয়েছিল। আগামী দিনে ত্রিভুজটি যেন পুনরায় কোনো ক্রিয়া-বিক্রিয়া শুরু করতে না পারে এ জন্য তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দিতে বর্তমান সময়কে বেছে নিয়েছে। সব দিক বিবেচনায় সরকার এখন সর্বোচ্চ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বিদেশের যেসব পরাশক্তি বিরূপ ছিল, তারাও কারণে-অকারণে সরকারকে তোষণ করছে। অর্থনীতি তুঙ্গে- সরকারের বিদেশী বন্ধুরা তাদের প্রতি সমর্থন আরো জোরালো করেছে। কাজেই আগামী দিনে ক্ষমতায় আসার পথের কাঁটা এবং পচা শামুকগুলো তারা যথাসময়ে উপড়ে ফেলতে পরিকল্পিত পথেই এগোচ্ছে।
ডেইলি স্টার সম্পাদকের বিচার চেয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়ের স্ট্যাটাস কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জয়ের কথাবার্তা যে যেভাবেই মূল্যায়ন করুন না কেন, আমি কিন্তু তার কথার মধ্যে সব সময়ই সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার ইঙ্গিত পেয়েছি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বহু আগে তিনি বলেছিলেনÑ আমার কাছে তথ্য আছে যে, আগামীতে আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় আসবে। তার সেদিনের সেই আগাম তথ্য যে কতটা নির্ভুল ছিল তা দেশবাসী ইতোমধ্যেই টের পেয়েছেন। বর্তমান সরকারে তিনি অত্যন্ত সুকৌশলে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন। তারেক রহমান কিংবা হাওয়া ভবনসংক্রান্ত বদনামির মতো কোনো কলঙ্ক গত সাত বছরে তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ২০০১ সালের বিএনপি-জামায়াত সরকারে তারেকের যে প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল তার চেয়ে বর্তমান সরকার এবং সরকারি দলে জয়ের প্রভাব কোনো অংশে কম তো নয়ই; বরং অনেক অনেক বেশি। এ অবস্থায় তার কর্মকুশলতা, মেধা ও যোগ্যতা নিয়ে যারা প্রশ্ন করতে চান আমি তাদের দলে নেই।
মাহফুজ আনাম যদি প্রথম থেকেই সতর্ক হতেন তাহলে তাকে বর্তমানের ফ্যাসাদে পড়তে হতো না। আগামী দিনে তিনি যদি সাহসের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা না করেন তবে অনাহূত বহু ঝামেলা তাকে গ্রাস করবে এবং একই কায়দায় প্রথম আলো এবং মতিউর রহমানও ফেঁসে যাবেন। সাংবাদিকতার পেশাগত জীবনে আমার সুযোগ হয়েছিল দু’জনের সাথেই কাজ করার। আমি যখন মাহফুজ আনামকে চিনতাম, তখন তিনি পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক। এস এম আলী সম্পাদক। রিয়াজ সাহেব প্রধান প্রতিবেদক, আমানুল্লাহ কবির বার্তা সম্পাদক, শহীদুজ্জামান খান নগর সম্পাদক এবং খলিলুর রহমান অ্যাসোসিয়েট এডিটর হিসেবে নিয়োগ লাভ করে রিপোর্টার ও সহ-সম্পাদকদের রোজ প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। অন্য দিকে, মাহফুজ আনাম এবং তৌফিক সাহেব দেখাশোনা করতেন প্রশাসনিক এবং অর্থ ও বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত বিষয়। আমার জানা মতে, মাহফুজ আনাম একজন নিরেট ভদ্রলোক এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভয়ানক লাজুকও বটে। হঠাৎ করে উত্তেজিত হওয়া তার একটি রোগ, যাতে আক্রান্ত হয়ে সেদিন এটিএন নিউজের টকশোতে কথা বলতে গিয়ে তিনি ফেঁসে গেছেন। অথচ তিনি যদি হাসিমুখে বলতেন, বর্তমান সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপি ১/১১র সময়ে তিনিসহ আরো অনেক সম্পাদকের কাছে নিয়মিত ধরনা দিতেন, যাতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বেশি বেশি প্রতিবেদন ছাপা না হয়, তাহলে উপস্থাপিকা মুন্নি সাহা হয়তো ঘটনার গভীরে ঢোকার চেষ্টা করতেন না।
বাংলাদেশের ১/১১ দেশের বাইরের কেউ ডেকে আনেননি। দেশের কোনো বর্ণ-সম্প্রদায়ও ডেকে আনেনি। দেশের রাজনীতিবিদেরাই ১/১১র জনক-জননী। ১/১১ তে পয়দা হওয়া সন্তানসন্ততিদের তাদের রাজনীতিবিদ জনক-জননীরাই প্রথম স্বাগত জানিয়েছিল এবং সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সর্বতো সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল। জনক-জননীর আগ্রহ উৎসাহ ও উদ্দীপনার কারণে পাড়া-প্রতিবেশীরা নবজাতকের পাশে দাঁড়ায়। সন্তানগুলো যে কুলাঙ্গার ছিল, তা বাবা-মা টের পায় চার-পাঁচ মাস পর আর পাড়া-প্রতিবেশী টের পায় সাত-আট মাস পর। সবাই মিলে যখন কুলাঙ্গার সন্তানকে বাগে আনার চেষ্টা চালায়, তখন অবাধ্য সন্তান শুরু করে তাণ্ডব। সেই তাণ্ডবে কমবেশি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তার চেয়েও বেশি মাত্রায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে পুরো দেশ। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে একমাত্র মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এবং মরহুম খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের পরিবার-পরিজন ইচ্ছে করলে ১/১১ নিয়ে বড় কথা বলতে পারেন। বাকিদের অবস্থা কমবেশি একই সমান্তরালে ছিল।
১/১১ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। আমার ব্যবসা-বাণিজ্য, ধনসম্পদ এবং রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়ে কুশীলবরা চেষ্টা করলেও যে কোনো ত্রুটি বের করতে পারবে না, সে ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম। ফলে ওই সময়ের আতঙ্কিত জনপদে সবচেয়ে দামি গাড়িতে চড়ে বুক ফুলিয়ে চলতে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না। অধিকন্তু অন্য একটি কারণে আমি মনে মনে পুলক অনুভব করছিলাম। আমার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রথম ১০০ জন শীর্ষ দুর্নীতিবাজের তালিকায় স্থান করে নেন এবং পালিয়ে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করার প্রয়াস চালান। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এসে বিভিন্ন কারণে আমার মন খারাপ হতে থাকে। কুশীলবরা টাকার বিনিময়ে অনেকের সাথে দফারফা করছে এবং ব্যবসায়ী ও নিরীহ বিত্তশালীদের ফাঁদে ফেলতে ১৯৭১ সালের হানাদার বাহিনীর মতো দোসর পয়দা করেছে, এমন খবরে আমি প্রমাদ গুনতে থাকি। অন্য দিকে, নির্বাচনী এলাকার নতুন বিভাজন করার ফলে ফরিদপুর জেলায় একটি সংসদীয় আসন কমে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হলে প্রথমে যে আমার নির্বাচনী আসনটি বিলুপ্ত হবে, সেই খবর শোনার পর মন আরো খারাপ হতে শুরু করল।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে দেশের বিভিন্ন অংশে বন্যা দেখা দেয়। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ত্রাণকার্য পরিচালনার জন্য চেষ্টা করছিল, কিন্তু অর্থাভাবে পেরে উঠছিল না। দলের তামাম কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমানের বাসা থেকে। সভানেত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর জিল্লুর চাচার সহকারী লিটন এবং খালেদ মাহমুদ চৌধুরী (বর্তমানে এমপি) বেশির ভাগ সময় জিল্লুর রহমান সাহেবের সাথে থাকতেন আর টিভি ক্যামেরাগুলো দলবেঁধে তাকে পাহারা দিত সারাক্ষণ। মহিলাদের মধ্যে ডা: দীপু মনি, নাজমা আকতার, মাহবুব আরা গিনি নিয়মিত সেখানে হাজিরা দিতেন। আমি একদিন জাহাঙ্গীরকে আমার অফিসে ডেকে জিল্লুর চাচাকে ত্রাণকাজ চালানোর জন্য কিছু টাকা দিতে চাইলাম। সে জিজ্ঞাসা করল, কত টাকা দেবেন। আমি বললাম, লাখ পাঁচেক। পরের দিন টাকাসহ জিল্লুর চাচার বাসায় গেলে তিনি মতিয়া চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক (মরহুম), খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখকে ডেকে সবার সামনে আমার হাত থেকে টাকা নিলেন ত্রাণকাজ চালানোর জন্য। আসার সময় তিনি বললেন, পারলে ছাত্রলীগের ত্রাণে একটু সহযোগিতা করো এবং ওমুক ওমুককে একটু দেখে রেখো। আমি গুলশান থেকে সোজা মধুর ক্যান্টিনে চলে এলাম। ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারি নাজমুলসহ শতাধিক নেতাকর্মী আমাকে স্বাগত জানাল। ছাত্রলীগ সভাপতি রিপনকে ফোন করে আমার ধানমন্ডির বাসায় ডেকে আনলাম এবং আরো অনেককে আমার বাসা বা অফিসে নিমন্ত্রণ করলাম। আমার তৎপরতার খবর রটে গেল। আমি এক দিকে ১/১১’র কুশীলবদের টার্গেটে পরিণত হলাম। অন্য দিকে, আওয়ামী লীগের কারাবন্দী নেতারা হররোজ চিরকুটের মাধ্যমে এবং প্রবাসে পলাতকরা টেলিফোন কল করে নানা ফুট ফরমাসে ব্যস্ত রাখতে একটুও কৃপণতা দেখাল না।
ঘটনার দিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। আমার শরীরটা কয়েক দিন ধরে ভালো যাচ্ছিল না। আমি বারডেমে আমার এক ডাক্তার বন্ধুর রুমে বসে প্রেসারটা চেক করছিলাম। বন্ধুটি প্রেসারযন্ত্র আমার হাতে বেঁধে যখন চেক করছিল, ঠিক তখন মোবাইলে আমার অফিস থেকে ফোন এলো। অপর প্রান্তের কথা শুনে আমার মেজাজ তেত্রিশ ডিগ্রি চরমে পৌঁছাল। ডাক্তার বন্ধু বললেন- কী হলো? এতক্ষণ তো প্রেসার ভালোই ছিল। ফোন আসার পর হঠাৎ করেই অনেক বেড়ে গেল। কোনো সমস্যা! আমি মুচকি হেসে বললাম, এখন প্রেসার মাপতে হবে না। আমার অফিসে এই মুহূর্তে যৌথ বাহিনী তল্লাশির নামে তাণ্ডব চালাচ্ছে- আমাকে খুঁজছে। আমার কথা শুনে ডাক্তার বন্ধুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি কোনো কথা বলতে পারলেন না। আমার হাত থেকে প্রেসার যন্ত্র খুলে নেয়ার সময় তার হাত দু’টি থরথর করে কলাপাতার মতো কাঁপতে লাগল। আমি টেলিফোন করে যৌথ বাহিনীর তল্লাশি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। তাদের বোঝালাম- আমি পলাতক নই। তারা যদি অফিসে অপেক্ষা করেন তবে আমি এক ঘণ্টার মধ্যে উপস্থিত হবো- নতুবা তারা ইচ্ছে করলে বারডেম থেকেও আমাকে গ্রেফতার করতে পারেন। অন্য দিকে, তারা যদি চান তবে অবিলম্বে আমি নিজেই স্বল্পতম সময়ের মধ্যে তাদের ক্যাম্পে উপস্থিত হতে পারি। তারা ক্যাম্পের ঠিকানা দিলো এবং আমি দ্রুত সেখানে উপস্থিত হলাম। আমাকে একজন সিনিয়র মেজর সাহেবের সামনে নেয়া হলো। তিনি বেশ গম্ভীর হয়ে আমার ফাইলটির পাতা উল্টাতে থাকলেন। তারপর আমার বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত অভিযোগটি উত্থাপন করলেন- ‘সজীব ওয়াজেদ জয় যখন সস্ত্রীক প্রথম বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন তার সংবর্ধনার যাবতীয় ব্যয় আপনি বহন করেছিলেন। মোট কত টাকা দিয়েছিলেন- কেন দিয়েছিলেন এবং এত টাকা কোথায় পেলেন?’
মেজর সাহেবের কথা শুনে আমি হেসে দিলাম। বললাম, ‘সজীব ওয়াজেদ জয়ের আগমনী সংবর্ধনার ব্যয় বহন করার জন্য আওয়ামী লীগে আমার চেয়েও অনেক অনেক গুণ ধনী অনেকে রয়েছেন। এমন একটি অনুষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহের জন্য আওয়ামী লীগের নির্ভরতার তালিকায় আমি এখনো স্থান লাভ করতে পারিনি। তাই টাকা পরিশোধের সুযোগ আসেনি। তবে হ্যাঁ! যদি আমার কাছে সেই সুযোগ আসত তবে অবশ্যই আমি সানন্দচিত্তে টাকা পরিশোধ করতাম। আমার কথা শুনে মেজর সাহেবসহ অন্য কর্মকর্তারা হাঁ করে রইলেন…।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর