সাবধান অনলাইনে সাবরিনা

ডা. আয়েশা তাসনিম ঈশিতা। এনজিও সংস্থা এফআইভিডিবি’র ফ্যাকাল্টি ডক্টর। কাজের অবসরে আর সবার মতো তিনিও ঢুঁ মারেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। চেনা-জানা মুখ, আত্মীয়পরিজনের খবর-বার্তা মিলে যায় মাউসের এক ক্লিকে বা আঙুলের স্পর্শে। চারপাশের নানা ঘটনা সম্পর্কেও জানা হয়ে যায়। মেলে কিছু বাড়তি খবরও। ২০১৪ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি কোন একসময়, ‘সাবরিনা ক্লোজেট’ নামে বাহারি পোশাক ও সংগ্রহের একটি পেজ চোখে পড়ে ডা. ঈশিতার। চোখ টানে পোশাকগুলো, মনও কাড়ে। ঘাঁটাঘাঁটি করে জানেন পেজটির অ্যাডমিন (পরিচালক) সাবরিনা আউয়াল নামের এক তরুণী। সাবরিনা তৈরী পোশাকের ব্যবসা করেন। সাবরিনাই জানান, এখন বিশেষ অফার চলছে- এক সঙ্গে তিনটি পোশাকের অর্ডার দিলে ফ্রি মিলবে একটি আকর্ষণীয় হ্যান্ডব্যাগ। টাকা পাঠিয়ে দিতে হবে আগেই। তারপর পোশাক ও ব্যাগ চলে আসবে ডা. ঈশিতার ঠিকানায়। ‘বিনয়ী’ সাবরিনা ইতিমধ্যেই ডা. ঈশিতাকে ‘বড় বোন’ বানিয়ে ফেলেছেন। ছোট বোনের ওপর কোন সন্দেহই থাকে না ডা. ঈশিতার। আর তাছাড়া সাবরিনার বন্ধু তালিকায় নিজের চেনা একজনও রয়েছেন। তাই অবিশ্বাসের কিছুও খুঁজে পান না ডা. ঈশিতা। তিনটি পোশাকের মূল্য হিসেবে দুটো কিস্তিতে ২৩ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন সাবরিনাকে।
টাকা দিলেও পোশাক আর বুঝে পান না ডা. ঈশিতা। সাবরিনা শুধু টালবাহানা করেন। আজ দিচ্ছেন, কাল দিবেন। এই বলেন, অর্ডার আটকে আছে পোর্টে। তো আবার বলেন, বিমানবন্দর থেকে মাল ছুটাতে যাচ্ছেন তিনি। নানা অজুহাত। আবার অ্যাকসিডেন্ট করে ভাই ‘আইসিইউ’ ভর্তি আছেন এমন অজুহাত দাঁড় করিয়ে সময়ও চান সাবরিনা। ডা. ঈশিতা বুঝতে পারেন দুষ্ট মেয়ের মিষ্টি কথায় ‘ধরা’ খেয়েছেন তিনি। কিন্তু কাউকে বলেনও না বিষয়টা তার ‘বোকামি’ নিয়ে হাসাহাসি হবে ভেবে। সবকিছুই ভাগাভাগি করেন, এ বিষয়টিইবা কি করে গোপন রাখেন স্বামীর কাছে। কয়েক দিন নিজের মাঝে রেখে শেষমেষ স্বামীকে বিষয়টি খুলেই বলেন ডা. ঈশিতা। যা ভেবেছিলেন, কোন ডকুমেন্ট ছাড়া অপরিচিত কাউকে এতটা টাকা দিয়ে দেওয়াকে ‘বোকামি’ হিসেবেই বিবেচনা করেন তার স্বামী। অবশ্য স্ত্রীকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেও দেরি করেন না। স্বামী-স্ত্রীর দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর কিছু টাকা উদ্ধার হয়। এখনও বাকি রয়েছে এক-তৃতীয়াংশ।
পুরো বিষয়টি হজম করেছিলেন ঈশিতা ও তার স্বামী এসএম রাহাত আজিজ। হঠাৎই ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস চোখে পড়ে তাদের। সাবরিনা আউয়ালের ছবি দিয়ে পোস্ট করা স্ট্যাটাসটি জনৈক রেহানা রাজিয়া তৃষার। সে স্ট্যাটাসের পরই সাবরিনাকে নিয়ে ঝড় ওঠে ফেসবুকে। যেন গল্পের ঝুড়ি খুলে গেছে। সাবরিনার কাছে প্রতারিত হওয়ার গল্পগুলো যেন হুবহু তাদেরই গল্প।
সাবরিনার কাছে প্রতারিত জনৈক সানজিদা তন্ময় ‘ফ্রড এলার্ট’ শিরোনাম দিয়ে নিজের প্রতারিত হওয়ার কাহিনী বর্ণনা করে ফেসবুকে পোস্ট করেন। তার শুরুটা এমন, ‘সাবরিনা আউয়াল… আমি মনে করেছিলাম আমি একমাত্র যে কি না সাবরিনা আউয়াল-এর প্রতারণার শিকার… কিন্তু দুই-তিন ধরে ফেসবুকে দেখলাম আমার মতো আরও অনেক মেয়েই এই প্রতারকের কাছে টাকা পায়’।
প্রতারিত হওয়ার গল্প ফেসবুকে ভাগ করেন জনৈক দিলরুবা শারমিন মৌটুসীও। তিনিও সাবরিনা আউয়ালের কাছে পোশাকের অর্ডার দিয়েছিলেন। ফেসবুকেই তার সাবরিনার সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় থেকে সাবরিনা তাকে ‘বোন’ ডাকে। গেল রোজার ঈদে ‘ছোট বোনে’র কাছে ৩টা ড্রেসের অর্ডার দেন দিলরুবা মৌটুসী। ঈদ চলে আসে সাবরিনা বাহানায় বাহানায় সময় পার করেন। ঈদ যখন একেবারে কাছে ঘনিয়ে আসে তখন সাবরিনা জানান তার ভাই অ্যাকসিডেন্ট করে আইসিইউ’তে। নিজের পোশাকের কথা ভুলে দিলরুবা মৌটুসি সান্ত্বনা দেন সাবরিনাকে। সে ঈদে আর নতুন জামা পরা হয়নি দিলরুবা মৌটুসির। সময় দেন সাবরিনাকে ‘ধকল’ কাটিয়ে উঠতে। কোরবানি ঈদের আগে যোগাযোগ করেন আবার। বাহানায় বাহানায় সে ঈদও চলে যায়। বুঝতে পারেন এই জনমে আর পোশাক মিলবে না। তখন টাকা ফেরত চেয়ে তাগাদা দেন সাবরিনাকে। এবারও অজুহাত আর সময়ক্ষেপণ চলতে থাকে। টাকা পান না। তবে ভাগ্য ভালই বলতে হবে দিলরুবা শারমিন মৌটুসীর ফেসবুক ঝড়ের পর তিনি টাকা উদ্ধার করতে পারেন।
দিলরুবা মৌটুসির এ পোস্টটিতে ঝড় উঠে, ডালপালাও মেলে। নিজের টাইমলাইনে পোস্টটি শেয়ার করেন মো. সাইফুল নামের আরও একজন। ২০শে মে পোস্টটি শেয়ার করার পর পাঁচ দিনেই পোস্টটি শেয়ার হয় আরও ৭৯৯ বার। আর নিচে মন্তব্যের যেন কমতি নেই। পোস্টের নিচে ইফতি খাইরুল চিশতী কমেন্ট করেন, ‘কেউ কি চিটারটার অ্যাড্রেস দিতে পারবেন। আমার বোনও ভিকটিম।’ নাজনীন মির্জা ঝুনু নামের এক ভুক্তভোগীর মন্তব্য, ‘টাকা পাই বা না পাই এর শাস্তি চাই।’ জানা যায় আরও কিছু ভুক্তভোগীর নামও। হাসিনা আক্তার, ফারজানা হোসেন চুমকি, নুসরাত জাহান নিশি, তাসরিনা রাবিয়া চৌধুরী স্বর্ণা, আফরিনা আইয়ুব ইমু, সামিরা রশিদ এরা প্রত্যেকেই ‘ধরা’ খেয়েছেন সাবরিনার কাছে।
মন্তব্যের সারিতে কেউ ভয়াবহ তথ্যও দেন। জনৈক আরাফাত শহীদ কমেন্টে লেখেন, ‘এই মেয়েটার একটা ছিনতাই পার্টি আছে। বড়লোকের ছেলেদের সঙ্গে খাতির কইরা ওর গ্রুপ দিয়া গাড়ি নিয়া নেওয়ায়’। আরও একটি কমেন্টে আরাফাত শহীদ লেখেন ‘এই মেয়েটি ড্রাগ জাতীয় কি জানি সেল করে।’ আবার সাবরিনার পরিচিত জনেরও কিছু কমেন্ট মেলে পোস্টের নিচে। তারা বিশ্বাস করতে পারেন না। জনৈক আশা আমিনের মন্তব্য, ‘ও কি আসলেই এ কাজগুলো করেছে।’ আর ফেসবুকে ‘স্যাম আহমেদ’ নামধারী সাবরিনার বন্ধু এগিয়ে এসেছেন সাবরিনাকে ক্ষোভের হাত থেকে বাঁচাতে। তিনি চেষ্টা করছেন সাবরিনার হয়ে সাফাই গাইতে। তবে সাবরিনা আউয়াল কিন্তু একেবারেই নীরব। আত্মপক্ষ সমর্থন করে কোথাও তার কোন মন্তব্য চোখে পড়েনি এ পর্যন্ত। ফেসবুকে পাওয়া সাবরিনার দুটো মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করা হয় মানবজমিনের পক্ষ থেকে। একটিতে রিং হলেও অন্যটিতে সংযোগ মেলে না। তবে কথা হয় না কোনভাবেই।
সাবরিনা প্রসঙ্গে প্রকাশিত পোস্টগুলো ঘেঁটে জানা গেছে সম্ভ্রান্ত এক ঘরের মেয়ে সাবরিনা। পুরো নাম সাবরিনা খাতুন। বাবার নামের অংশ আউয়াল। চিকিৎসক বাবার নামের এ অংশ ধারণ করেছেন। পুরনো ঢাকায় তাদের বাড়িও আছে। মোহাম্মদপুরের আদাবরে ‘আওয়াল হাউজ’। সাবরিনার জন্ম সৌদি আরবে। তিন ভাইয়ের দুই ভাই’ই প্রতিষ্ঠিত এবং ভাল অবস্থানে আছেন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে পড়াশোনা করলেও তা অসমাপ্ত রয়ে গেছে। অনেক কীর্তিগাথার কারণে শিক্ষাজীবনে বেশ আলোচিত ছিলেন সাবরিনা। পারিবারিক পরিচিতির সঙ্গে সাবরিনার কীর্তিগাথা যেন ঠিক খাপ খায় না। এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের বখে যাওয়া মেয়ে সাবরিনার পরিচয় এখন ‘অনলাইন ফ্রড’ হিসেবেই। তবুও থেমে নেই সাবরিনা আউয়াল। পুরনো পেজগুলো বন্ধ পেলেও সন্ধান মিলেছে নতুন আরও একটি পেজের। ওয়েব জগতে এখন সক্রিয় আছে ‘সাবরিনা’স ড্রেস অ্যান্ড কালেকশন’ নামের ফেসবুক পেজটি। অতএব সাবধান।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর