কেন এমন হয়? বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

এই সেদিন ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন এফবিসিসিআইর নির্বাচন হলো। নিটল গ্রুপের প্রাণপুরুষ মাতলুব আহমাদ বিজয়ী হয়েছেন। আমি তাকে আন্তরিক অভিনন্দন ও মোবারকবাদ জানাই। ব্যবসায়ীদের সরকারের লেজুড় হওয়া উচিত নয়। নিশ্চয়ই সরকারের সঙ্গে এফবিসিসিআইর সদ্ভাব থাকবে, কিন্তু তা লেজুড়ি হবে না। কারণ এফবিসিসিআইর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা সরকারের হবে তেমন না। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ীদের হাতে থাকলে জটিলতা কমে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিক হলে যেমন রাজনীতির সর্বনাশ, ঠিক তেমনি রাজনীতিকরা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করলে ব্যবসা এবং দেশের সর্বনাশ। আগেরজন এস এম আকরাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেশের মানুষ ছিলেন বলে হয়তো খুবই অহংকারী ছিলেন। অবস্থান কর্মসূচির শুরুতে প্রচণ্ড শীতে তার কাছে দুই-চারটা কম্বল পাওয়া যায় কিনা সেজন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান তালুকদার বীরপ্রতীক এবং আবদুল্লাহ বীরপ্রতীকসহ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কয়েকজন নেতাকে পাঠিয়েছিলাম। পত্রিকায় দেখেছিলাম তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ৩৮ হাজার শীতবস্ত্র দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হলে হয়তো আমাকেও দিতেন, কিন্তু ৩৮ হাজারের জায়গায় ৩৮টিও পাব না তেমনটা ভাবিনি। নেতারা যখন দুই-এক বেলা খাবার এবং কিছু শীতবস্ত্রের কথা বলেছিল তখন তিনি বলেছিলেন, খুবই অভাবে আছেন, তার আমাদের সহযোগিতা করা দূরের কথা বরং আমরা তাকে সহযোগিতা করলে বেঁচে যান। তার কথায় খুব একটা খারাপ লাগেনি। দেশ স্বাধীন হয়েছে, অনেকেই সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। দেশ স্বাধীন না হলে তিনি কোথায় থাকতেন, কী হতো তার আর্থিক সঙ্গতি তা আল্লাহই জানেন। নতুন সভাপতি মাতলুব আহমাদ একজন বিচারকের সন্তান। ছোটকাল থেকেই সুন্দর পরিবেশে বড় হয়েছেন। তাই আশা করব তার নেতৃত্বে ব্যবসায়ীদের এ প্রতিষ্ঠান একটি চমৎকার উচ্চতায় পৌঁছবে এবং দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে। বিক্রমপুরের গাজী আবদুল সালাম (সেলিম) মুক্তিযুদ্ধে আমার সঙ্গে অংশ নিয়েছিল। জুলাই-আগস্টে সে মুক্তিযুদ্ধের প্রাণকেন্দ্র সখিপুরে যায়। অনেক যাচাই-বাছাই এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেলিম এবং শাহালমকে দলে নেওয়া হয়। ঢাকার ডিআইটির লিফটে সে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটায়। আগস্টের মাঝামাঝি পাকিস্তান হানাদারদের গুলিতে আমি গুরুতর আহত হলে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রায় সব ঘাঁটির পতন ঘটে। সব কিছু তছনছ হয়ে যায়। মা-ভাইবোনদের ঢাকার নারিন্দার ছারা খালার বাড়িতে পাঠানো হয়, অন্যদিকে দুই ভাইসহ বাবাকে ভারতের মানকারচরে। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষে ডিসেম্বরের ১২-১৩ তারিখ ডা. শাহাজাদা চৌধুরীর স্ত্রী লাইলীর বাপের বাড়ি চাষাঢ়া থেকে সবাইকে লঞ্চে নিয়ে সেলিম টাঙ্গাইলের পথে রওনা হয়। নারায়ণগঞ্জ থেকে বিক্রমপুর, মাওয়া নানা জায়গা হয়ে তারা নাগরপুরের এলাসিনে পৌঁছে। সেখান থেকে ২০ ডিসেম্বর মা-ভাইবোনদের টাঙ্গাইল নিয়ে যাওয়া হয়। বাবা-মা-ভাইবোনদের দেখে স্বাধীনতা পাওয়ার মতো খুশি হয়েছিলাম। স্বাধীনতার পর গাজী সেলিম আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিল। ভারত থেকে আমার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনেও সে অসম্ভব ভূমিকা রেখেছে। বছরের পর বছর শত শত কর্মীকে খাইয়েছে, টাকা-পয়সা, গাড়ি-ঘোড়া যখন যা প্রয়োজন হয়েছে সবকিছুর ব্যবস্থা করেছে। সেই সেলিম হঠাৎই মারা যায়। গ্রামের বাড়িতে তার কবর হয়। সেলিমের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে জানতাম। সারা জীবন টুঙ্গীপাড়া যাই, বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করে দোয়া করি। সেদিন গিয়েছিলাম টংগীবাড়ি প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব শামসুল ইসলামের বাবা আলহাজ ওসমান গনির কবরের পাশে ঈদগাহ মাঠে জায়গা নিয়েছিলাম। হঠাৎই সেলিমের ছেলে শাওনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখানে তোদের বাড়ি কোথায়? সে বলেছিল লৌহজংয়ে মাওয়া পুরনো ফেরিঘাট পাড়ে। ঠিক করেছিলাম ওদের বাড়ি গিয়ে সেলিমের কবর জিয়ারত করব। টংগীবাড়ির তিন সিঁড়ি সুখবাসপুর ঈদগাহ মাঠে কবির বেগের ছেলে কামরুলের স্ত্রী ও ছেলেরা দেখা করতে গিয়েছিল। কামরুলই ফোন করেছিল ইউনুসকে। লৌহজংয়ের ইউনুস ‘৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামে শরিক হয়েছিল। সুনামগঞ্জের তাহেরপুরে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে এক প্রচণ্ড সংঘর্ষে সে গুরুতর আহত হয়। তার গায়ে ১৭-১৮টি গুলি লাগে। সরকারি বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনা হয় আদর করে বাঁচানোর জন্য নয়, বাঁচিয়ে রেখে তথ্য সংগ্রহের জন্য। যেভাবেই হোক ইউনুস বেঁচে আছে। সেজন্য দয়াময় আল্লাহর প্রতি গভীর শুকরিয়া জানাই। সেলিমের বাড়ি যশলদিয়া যাওয়ার এখন আর ভালো রাস্তা নেই। পদ্মায় ভেঙে গেছে। বিকল্প পথে যেতে খুবই কষ্ট। তারপরও তার কবরে ফাতেহা পাঠ করে ঋণ শোধ করার চেষ্টা করেছি। মাওয়া পুরনো ঘাটের আশপাশেই থাকার ইচ্ছা ছিল। একবার ভেবেছিলাম খেলার মাঠে তাঁবু ফেলি। কিন্তু ফুটবল খেলা থাকায় সেখানে থাকা সমীচীন মনে হয়নি। একটু এগিয়ে আলহাজ শাহ সুফি হজরত আবদুল মালেক দরবেশ আল-কাদেরি (রহ.)-র মাজারের পাশে তাঁবু ফেলেছিলাম। সেখানকার লোকজন যে কত ভালো যেটা বলে শেষ করা যাবে না। এই একমাত্র জায়গা যেখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সবাই আন্তরিকভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছে, শুভ কামনা জানিয়েছে। আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য নেতারা এসে দেখা করেছেন। রাতে তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার দিয়েছেন। আমার দুই কর্মী এক ঘোর আওয়ামী লীগের বাড়ি খাবার চাইতে গেলে প্রথম তাদের খাইয়েছে তারপর আমার জন্য দিয়েছে। সকালে সেই মায়াময়ী গৃহিণী হালিমা জামান নিজে এসে সামনে বসে নাস্তা খাইয়েছে। বিএনপির এক নেত্রী নার্গিস রাতের খাবার, সকালের নাস্তা ও আম দিয়েছে। সকালে যখন মাজারের সামনে বসেছিলাম মাজার ঝাড়পোছ করা অসহায় এক মহিলা বলেছিল, ‘ব্যাগ দেন। আপনার ছেলেমেয়ের জন্যে আম দেবো।’ কথার মধ্যে সে যে কী মায়া, বহুদিন পর এক মধুময় আনন্দ অনুভব করেছিলাম। সারা জীবন না চাইতেই দয়াময় আল্লাহ আমায় অনেক কিছু দিয়েছেন। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গঠনের পর কতবার ভেবেছি টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সপ্তাহব্যাপী মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে মাওয়া ফেরিঘাটের পাশে দুবার খেয়েছিলাম। কী যে অসম্ভব যত্ন করে তারা খাইয়েছিল। সে স্মৃতি সব সময় মনের দুয়ারে উঁকি মারে। অথচ কিছুতেই তাদের নাম মনে করতে পারি না। সেদিনও একে ওকে বলছিলাম। বেগম হালিমা জামান আমাদের কর্মীদের বলেছিলেন, তার বাড়িতে আমি নাকি তিন তিনবার খেয়েছি। কিন্তু আমি মাওয়াতে তিনবার খাইনি দুবার খেয়েছি। তাই ঠিক মনে হচ্ছিল না। না চাইতেই আল্লাহর দয়ায় পরদিন সকালে যখন বসেছিলাম সুদর্শন এক ভদ্রলোক মো. নুরুল ইসলাম এসে হাজির। একথা ওকথার এক ফাঁকে রাসেদুল ইসলাম মুন্না এবং কে এম জাহাঙ্গীর আলম মোহন সেখানে পৌঁছে। লিডার বলে সালাম করেই দুজন প্রায় একসঙ্গে বলে উঠে, ‘লিডার, চিনতে পারছেন? আমি মোহন, আমি মুন্না।’ চেনার আর সময় দেয়নি। দুজন প্রায় একসঙ্গে বলছিল, ‘সেই যে টুঙ্গীপাড়া যাওয়ার পথে আবদুল মতিন খানের বাড়িতে খেয়েছিলেন। ওই যে ওখানে ডা. আবদুল আজিজ খানের বাড়িতে খেয়েছিলেন। সেদিন আমি ছিলাম। ওই যে অমুক দিন আপনাকে ফেরি পার করে দিয়েছিলাম।’ এক সময় সত্যিই তাদের কথা মনে পড়ে এবং চেহারাগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কী যে আনন্দিত হয়েছিলাম বলে বুঝাতে পারব না। হারিয়ে যাওয়া সজ্জন বহুদিন পর বাড়ি ফিরলে যেমন হয়, আমারও তেমন হয়েছিল। আর কিছু না হোক এ যাত্রায় যা চেয়েছি তারচেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি।

আল্লাহকে হাজার শুকরিয়া মা এবং ভাইকে নিয়ে কুশিমণি লৌহজং গিয়েছিল। অনেক সময় ওকে কোলে নিয়ে বসেছিলাম। দুই দিন আগে মা আমার স্কুলে গিয়ে বমি করেছিল। ওর শরীর খারাপ শুনে বুকের ভিতর তোলপাড় করছিল। কোনো স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। তাই তার মাকে বলেছিলাম ওকে নিয়ে আসতে দুই চোখ ভরে দেখব বলে। ওকে দেখলে আমার মাকে দেখার স্বাদ মিটে। কেন যে ওর জন্য আমি নাড়ীছেঁড়া টান অনুভব করি বুঝতে পারি না। দেশে ফেরার পর আমার স্ত্রীর পেটে বাচ্চা এসেছিল। কোন দোষে যে তাকে আমরা পৃথিবীর আলো দেখাতে পারিনি। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে সে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তারপর আল্লাহর দান কুশিমণি আসায় আমার সব দুঃখ বেদনা সন্তাপ কোথায় মিলিয়ে গেছে। আজ কোনো অবহেলাই স্পর্শ করে না, কষ্ট দেয় না, খারাপ লাগে না। অবাক হয়ে ভাবী আর ভাবী, কী অমোঘ শক্তি একটা মানব সন্তানের মধ্যে। দীপ-কুশিকে নিয়ে ওর মা সন্ধ্যার পর ঢাকা চলে গিয়েছিল। আমি থেকে গিয়েছিলাম লৌহজংয়ে। এত ভালো লেগেছিল তাই আর কষ্টের কথা মনে করতে ইচ্ছা করছিল না। তবু দেলোয়ারের বড় ভাই ওসমান গনি মোশারফ কদিন আগে ত্রিবেনীতে অবস্থান নিয়ে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। তাই সে বিষয়ে দুই কথা না লিখে পারছি না।

কাশীপুরের আগে ছিলাম ব্রহ্মপুত্র ব্রিজের পাশে ত্রিবেনীতে। সে এক মহাকৌতূহলী জায়গা। ৫-১০ গজের মধ্যে নানা ধরনের নাম। মিনার বাড়ি, তারপর চর ইসলামপুর, একটু সামনেই লম্বা দরদী, কাইকারটেক- এরকম পায়ে পায়ে নাম। সেনপাড়া থেকে মিনার বাড়ি হয়ে হিন্দুদের পবিত্র স্নানের লাঙ্গলবন্দের দিক থেকে ফেরার পথে চর ইসলামপুর ব্রিজের ঘারিতে ছোট্ট একটি জায়গা পছন্দ করেছিলাম। সামনে ত্রিবেনীতে শামসুজ্জোহা এম. বি. ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে নতুন বিল্ডিং হয়েছে। কেন যে সেখানে গিয়েছিলাম। ইট-রড-বালু এদিক-ওদিক পড়েছিল। লাগাতার বৃষ্টি থাকায় সারা মাঠ বড় বড় ঘাসে ভরা। তাই আমার তেমন পছন্দ হচ্ছিল না। ঠিক সেই সময় বহুদিনের সহকর্মী ফরিদ বলেছিল, ‘দাদা, দুই পাশে বিল্ডিং, ঝড় তুফান আসলে খুব একটা অসুবিধা হবে না। ওর কথায়ই স্কুলের মাঠে দুইটা কাঁঠাল গাছের মাঝে তাঁবু ফেলতে বলেছিলাম। অন্যত্র যেমন হয়, সেখানেও অনেক লোক হয়েছিল। মাগরিবের সময় হয়ে এসেছিল। লোকজনের চাপে অজু করতেও অসুবিধা হচ্ছিল। দেখতে শুনতে খুব সুরত এক ভদ্রলোক নিজেই পরিচয় দিলেন আমি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা, প্রাক্তন চেয়ারম্যান। তার আগ্রহের শেষ ছিল না। পাগলের মতো করছিলেন। নামাজ পড়ব পাটি, জায়নামাজ সবই ছিল। কিন্তু তিনি সাতরঞ্জি জায়নামাজ পেতে অফিস ঘরের ফ্যান ছেড়ে হাত ধরে টানতে শুরু করেছিলেন। বলছিলাম, ‘ঘর থেকে বেরিয়েছি অনেক দিন, শুধু জুমার নামাজ ছাড়া ঘরে পড়িনি। মসজিদে ২-৪-১০ বার অন্য ওয়াক্তের নামাজ পড়েছি। তাই বারান্দায়ই পড়ব। নামাজ পড়েছিলাম নিজের জায়নামাজে। নামাজের সময় কোনো কিছু আমাকে স্পর্শ করে না, গরম ঠাণ্ডা কিছুই বুঝি না। কিন্তু কেন যেন মশা আমায় সেদিন বিরক্ত করছিল। নামাজ শেষে কেবলই বের হয়েছি। নাসিমের স্ত্রী পারভীনের ফোন ধরতেই তার কান্না। বারবার বলছিল, ‘ভাই, এখনো বিশ্বাস হয় না, আপনার নাসিম নেই। ভাবীকেসহ ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার এখানে একবার আসবেন।’ পারভীনকে বলেছিলাম, ‘ত্রিবেনীতে তোমার শ্বশুরের নামে স্কুলে থাকতে চাই। দোয়া করো।’ ছেলেমেয়ে সবার খবর নিয়েছিলাম। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জনাব মহিউদ্দিন চা খাওয়ানোর জন্য খুবই পীড়াপীড়ি করছিলেন। কিন্তু নামাজের পর দেখি তার মুখ থমথমে। হঠাৎই বললেন, ‘এমপি সাহেবকে ফোন করেছিলাম। ভেবেছিলাম তিনি খুশি হবেন। তিনি তা হননি।’ একটু পর কয়েকজন মাস্তান নিয়ে এলেন। যারা তাঁবু বাঁধছিল তাদের বললেন, এখানে তাঁবু করা যাবে না। কথাটি আমার কানে আসতেই বিরক্ত হয়ে তাঁবু খুলে ফেলতে বললাম। মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু গুটিয়ে ব্রহ্মপুত্র সেতুর ঘারিতে আবদুল বাতেন সুপার মার্কেটের মেসার্স শরিফ ট্রেডার্স দোকানের সামনে তাঁবু ফেলেছিলাম। সে যে কী অসাধারণ মানুষ তারা। জমির মালিক ছুটে এসে বলছিলেন, ‘আমার জমিতে পা রেখেছেন। এখানে রাত কাটাবেন আমার জীবন ধন্য হলো।’ স্কুলের আঙিনায় যত মানুষ ছিল তার ১০-১৫ গুণ লোক সমাগম হয়ে গেল। সবার এক কথা আপনি এখানে এসে ভালো করেছেন। আমিও ভাবলাম ওখানে না গিয়ে এখানেই যদি আগে তাঁবু ফেলতাম তাহলে জনাব মহিউদ্দিনের কদর্য চেহারা দেখতে পেতাম না। আল্লাহ যা করেন সবই ভালোর জন্যই করেন। মহিউদ্দিনের এ ব্যবহার আমাকে উৎসাহিতই করেছে সেই প্রবাদের মতো, ‘পাঁচশিকার মোরগ গেল গেল, কিন্তু শিয়ালের ইমান তো জানা গেল।’ খান সাহেব ওসমান আলী কুমিল্লার মানুষ। সেখান থেকে এসেছিলেন নারায়ণগঞ্জে। চাষাঢ়ার হীরা মঞ্জিলে অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে বাস করেছেন। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি দুই বিয়ে করেছিলেন।

এক পক্ষের সন্তানরা নারায়ণগঞ্জে। জনাব শামসুজ্জোহা, মোস্তফা সরোয়ার, বাবু সরোয়ার, ননি সরোয়ার। আবার জনাব শামসুজ্জোহার ছেলে নাসিম, শামীম, সেলিম ওসমান।

জ্জোহা পরিবার ত্বকি হত্যার ঘটনায় যখন সবচেয়ে বেশি নিন্দিত তখন নারায়ণগঞ্জের এক সভায় বলেছিলাম, ‘কোনো পরিবারের কোনো সদস্যের জন্য পুরো পরিবারকে অভিযুক্ত করা যায় না। জ্জোহা পরিবারের যেমন পাকিস্তান আন্দোলনে ভূমিকা আছে, তেমনি স্বাধীনতা যুদ্ধে আছে। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ প্রতিরোধে বাসর ঘরের বউ রেখে নাসিম আমার সঙ্গে অংশ নিয়েছিল। আমি কখনো কোনো কিছু পাওয়ার আশায় কোনো কথা বলি না।’ কিন্তু দুই দিন পর নাসিম আমার বাড়ি গিয়ে ঝারঝার করে কেঁদেছিল। বলেছিল, ‘আমার পরিবারের জন্য আপনি যা করলেন আমরা সারা জীবন আপনার গোলামি করেও সে ঋণ শোধ করতে পারব না। হঠাৎই নাসিম না ফেরার দেশে চলে যায়। তার শূন্য আসনে সেলিম ওসমান প্রার্থী হয়। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের পক্ষ থেকে আমরা শফিকুল ইসলাম দেলোয়ারকে প্রার্থী করেছিলাম। এক সময় জাতীয় নেতাদের পক্ষ থেকে অনেক অনুরোধ আসে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে। আমরা তেমনটা চাইনি। নাসিমের স্ত্রী পারভীন ফোন করে আকুল হয়ে বলেছিল, ‘ভাই, আমাদের ছায়া দেবার মাথার উপর কেউ নেই। আপনি দেখবেন। আপনার প্রার্থী উঠিয়ে নিলে আমাদের জোর করে হারিয়ে দেবে। সেলিম রাজনীতি করত না, তাই তার জানার কথা না। ইলেকশনের ৪-৫ দিন আগে তিন হাজার র্যাব, আরও আড়াই-তিন হাজার বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছিল। র্যাব-বিজিবি সব ছিল শামীমের বিরুদ্ধে। ব্যাপক কারচুপির পরও ফলাফলে খুব একটা তফাৎ ছিল না, ব্যবধান ছিল খুবই কম। গামছা সরে দাঁড়ালে তার কী প্রভাব পড়ত সেটা সেলিমের বোঝার কথা নয়, সেটা শামীম বুঝত।

তা যাই হোক আমি এমপি সেলিম ওসমানকে দেখিনি। তার আচার-আচরণ, চাল-চলন সম্পর্কে তেমন অবহিত নই। কিন্তু জ্জোহা পরিবারের সবাইকে দীর্ঘ সময় ধরে জানি। তাই ত্রিবেনীতে শামসুজ্জোহা এম.বি. ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে তাঁবু খাটিয়ে আমি থাকলে সেলিমের অসুবিধা কোথায় ছিল তা আমার বোধগম্য নয়। লৌহজং আওয়ামী লীগের সভাপতি, সেক্রেটারি এসে দেখা করতে পারল, তারা খাবার পাঠাল, আলহাজ শাহ সুফি হজরত আবদুল মালেক দরবেশ (রহ.)-এর কবরের পাশে মাঠে থাকলাম, সাধারণ মানুষসহ আওয়ামী লীগ-বিএনপি কতজন খাবার দিল, কোথাও আসমান ভেঙে পড়ল না, ত্রিবেনীতে পড়ল- এ প্রশ্নের কোনো জবাব পাচ্ছি না। ঠিক আছে, অপেক্ষা করি। দেখা যাক, ব্যাপারটা সুবিধাবাদীদের অতি ভক্তির ফল, নাকি সেলিম নিজেই তার বাবার নামের স্কুলে আমাদের থাকতে দেয়নি- ভবিতব্যই বলে দেবে, আমাদের কিছু করতে হবে না। তবু কেন যেন মনে হয় এমনটাই কি ওসমান পরিবারের ঋণ শোধের নমুনা?

লেখক : রাজনীতিক।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর