দেশের নতুন সম্পদ মুক্তা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ঝিনুকে মেলে মহামূল্যবান ‘মুক্তা’। প্রাচীনকালে এর উৎপাদন কৌশল জানা না থাকায় শুধুমাত্র প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মুক্তাই সংগ্রহ করা হতো। তবে বর্তমানে বিশ্বের কয়েকটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও মুক্তা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবিত হয়। আর এ চাষে অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

২০১০ সালে মুক্তা চাষ নিয়ে গবেষণা শুরু করে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। এর ছয় বছর পর সফলতা পান বিজ্ঞানীরা। ফলে দেশের নতুন সম্পদে পরিণত হয় মুক্তা।

বিএফআরআই এখন পর্যন্ত সারাদেশের এক হাজার মানুষকে মুক্তা চাষের ওপর বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এরমধ্যে ৮০০ জনই নারী। প্রশিক্ষণ পেয়ে সফলভাবে প্রথম পর্যায়ে মুক্তা উৎপাদন করছেন ১২ জন। বাকিদের মধ্যেও অনেকে চাষ শুরু করেছেন।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, ইমেজ মুক্তা উৎপাদন প্রযুক্তি তুলনামূলক সহজ এবং বাণিজ্যিকভাবে করা সম্ভব। তাই প্রথমে এটির ওপর নজর দেয়া হচ্ছে বেশি।

মুক্তা কী?

হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, নদী-নালা নিয়ে ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। রয়েছে অসংখ্য জলাশয়। এসব জলাশয়ে ঝিনুকও আছে বৈচিত্র্যময়। আর সে ঝিনুক থেকেই যুগ যুগ ধরে পাওয়া যাচ্ছে মহামূল্যবান মুক্তা।

গবেষণার শুরুর দিকের কথা

মুক্তা চাষকে বাণিজ্যিকীকরণের উদ্দেশ্যে ২০১০ সাল থেকেই গবেষণা শুরু করেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) একঝাঁক উদ্যমী বিজ্ঞানী। এরইমধ্যে তারা অনেকটা সফলতাও অর্জন করেছেন। তারা বলছেন, মুক্তা গবেষণা একটি দীর্ঘ মেয়াদী, ধারাবাহিক ও জটিল গবেষণা কার্যক্রম। তবে মুক্তা চাষের ক্ষেত্রে নতুন ও উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে তা কৃষক-খামারিদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে, মুক্তা আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।

গবেষণায় সফলতা

প্রকল্পের অর্থায়নে শুরু থেকেই গবেষণা কার্যক্রমের আওতায় মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুক চিহ্নিত করার জন্য দেশব্যাপী জরিপ চালানো হয়। গবেষণার মাধ্যমে এখন একটি ঝিনুক থেকে সর্বোচ্চ ১২টি মুক্তা তৈরি করা যাচ্ছে। ছয় মাসে সর্বোচ্চ পাঁচ মিলিমিটার এবং গড়ে তিন মিলিমিটার আকারে মুক্তা পাওয়া গেছে। বাণিজ্যিকভাবে মুক্তা চাষের ক্ষেত্রে মুক্তার আকার আরো বড় করা প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে ভিয়েতনাম থেকে কিছু উন্নত জাতের ঝিনুক সংগ্রহ করে গবেষণা করা হচ্ছে।

আবহাওয়ার উপযোগিতা

বাংলাদেশে শীতকালের স্থায়িত্ব কম হওয়ায় এবং সারা বছরেই উষ্ণ আবহাওয়া থাকায় এ দেশ ঝিনুকের দৈহিক বৃদ্ধি ও মুক্তা চাষের অনুকূলে রয়েছে। এমনকি এ দেশের মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুক থেকে সংগৃহীত মুক্তার ‘রঙ’ বিশ্ববাজারে অনন্য বলে বিজ্ঞানীরা জানান।

মুক্তা দিয়ে যা তৈরি হচ্ছে

ইমেজ মুক্তা (চ্যাপ্টা আকৃতি) সম্পর্কে মুক্তা চাষ প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহসেনা বেগম তনু বলেন, এটি এক ধরনের নকশা আকৃতির মুক্তা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ মূল্যবান মুক্তার অলংকার প্রচলন থাকলেও এ দেশে এটি একদম নতুন। ইমেজ মুক্তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এটি উৎপাদন করতে মাত্র ৭ থেকে ৮ মাস সময় লাগে। যেখানে গোলাকৃতির মুক্তা তৈরিতে দেড় থেকে দুই বছর সময় লাগে। চ্যাপ্টা মুক্তার উৎপাদন খরচও কম। পুকুরে মাছের সঙ্গেও চ্যাপ্টা মুক্তা চাষ করা যায়।

দেশে প্রভাব

মুক্তা চাষে ভাগ্য খুলে যেতে পারে হাজারো বেকার যুবক-যুবতীদের। বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়ন নতুন সুযোগ তৈরি হবে। মুক্তা চাষে নারীদের অধিক আগ্রহ এরইমধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। ঝিনুক অপারেশনে তারা অধিক পারদর্শী।

বেকারত্ব ঘুচছে

অল্প সময়ের মধ্যেই বেকারত্ব দূরীকরণে ভূমিকা রাখছে মুক্তা চাষ। এরইমধ্যে বিএফআরই থেকেই এক হাজারের বেশি মানুষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাদেরই একজন লালমনিরহাটের মাছ চাষি রুহুল আমিন লিটন জানান, এক একর জমিতে মাছ চাষ করেন তিনি। মাছের পুকুরেই বাড়তি আয় আনতে মুক্তা চাষ শুরু করেন। এরইমধ্যে তিনি ৯ মাস বয়সী ঝিনুক থেকে ২০০ মুক্তা সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেছেন, যা থেকে তার আয় হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা।

বিশ্ববাজারে মুক্তা

বিশ্বব্যাপী অমূল্য রত্নরাজির ক্ষেত্রে হীরার পরই মুক্তার স্থান। মুক্তা চাষ অনেক দেশেই এনে দিচ্ছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, কানাডা, স্পেন, ফিলিপাইনসহ অন্যান্য দেশে ‘প্রণোদিত’ উপায়ে মুক্তা উৎপাদন এবং চাষ হচ্ছে। তবে বিশ্ববাজারে মুক্তা রফতানিতে প্রথমে রয়েছে চীন। চীনের উৎপাদিত স্বাদু পানির মুক্তা বিশ্ব বাজারের ৯৫ শতাংশ দখল করে আছে, যার পরিমাণ বছরে প্রায় ৮০০ থেকে এক হাজার টন। এর প্রায় অর্ধেকেই এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, তিন ধরনের মুক্তা চাষে আমরা সক্ষমতা অর্জন করেছি। প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে মুক্তা চাষ পদ্ধতি উদ্যোক্তাদের দেয়া হচ্ছে। তবে উৎপাদনের পর এর বাজারজাতকরণ এবং রফতানির ব্যবস্থা করতে হবে। সেই জায়গাটিতেও আমরা কাজ করছি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর