খিচুড়ি হাজার বছরের ঐতিহ্য

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ‘খিচুড়ি রান্না’ এবং ‘প্রশিক্ষণ’ নিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য বহুল আলোচিত ও সমালোচিত চর্চিত বিষয়কে মাথায় রেখে আমি ব্যক্তিগতভাবে খাদ্য প্রস্তুতকরণ, খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, রান্নার আধুনিকায়ন, ফুড প্ল্যানিং ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হিসেবে খিচুড়ি ও এর বৈশিষ্ট্য এবং ঐতিহ্য সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত তথ্য সকলের জন্য উপস্থাপন করার প্রয়াশ নিলাম।
আনুমানিক ৩০০ খ্রীষ্টপূর্বে যখন ভারতবর্ষে ‘মারইয়া’ সাম্রাজ্যের বিস্তার তখন বিশ্বখ্যাত রাজা অশোকের দাদা ‘চন্দ্রগুপ্ত’ এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রজাদের মধ্যে বৈষম্য না ঘটিয়ে একটি সুষম পুষ্টিকর খাদ্য তৈরির পরিকল্পনা করে চমক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। একটি খাবারে চাল-ডাল দিয়ে এই খাবার দারুণ সাড়া ফেলেছিল সে সময়।
উল্লেখ্য, তার শাসনামলে গ্রিক রাজা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের পর ‘রাজা সেলুকাস’ ভারত সফরে এসে খিচুড়ি সম্পর্কে ধারণা নিয়ে তার দেশে এই ধরনের পুষ্টিকর খাবারের বর্ণনা প্রজাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। গ্রিসে এখনো এ ধরনের ‘ খিচুড়ি’ বেশকিছু আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করে বিদ্যমান রয়েছে।
খিচুড়ির পুষ্টিগুণ ও একক প্রধান খাবারের প্রচলন বিশ্বব্যাপী ছড়াবার নেপথ্যে ‘মঙ্গোল’দের অবদান রয়েছে। তৎকালীন সময়ে এই অঞ্চলে মঙ্গোল সৈন্যদের শক্তিবৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য খিচুড়িকে প্রধান খাদ্য হিসেবে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। তারপর তারা বিশ্বে খিচুড়ির প্রচলন করে।
এ ধরনের খাদ্যে আমিষ, ফ্যাট, ভিটামিন পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে। সঙ্গে রয়েছে মিনারেল ও তরল পদার্থ। যার ফলে এই একক উপাদানে শরীর পুষ্টির জন্য যথেষ্ট ধরা হয়।
১৩০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ভারতবর্ষে আলাউদ্দিন খিলজীর শাসনামলে মঙ্গোলদের পরাজয়ের পর দীর্ঘ বছর পর মোগল সাম্রাজ্যের সময় খিচুড়ি আবারও জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

ভারতবর্ষে সে সময়ও প্রধান খাদ্য উপাদান ছিল চাল ও ডাল।
রাজা অশোকের সময় তার সাম্রাজ্য বিস্তার চিল আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল যেখানে লোকালয় ছিল সে সময় থেকে খিচুড়ির প্রচলন এবং তা এখনো জনপ্রিয়।
খিচুড়িপ্রিয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, দিনাজপুর, তারপর অন্যান্য অঞ্চল ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও ঢাকার কিছু অঞ্চল। মোগল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর এর শাসনামলে খিচুড়িকে সকালের নাশতা হিসেবে প্রাধান্য দেয়া হতো। বাংলাদেশের উল্লিখিত অঞ্চল ছাড়াও প্রায় অনেক অঞ্চলেও এখনো প্রচলন রয়েছে। ১৩৫০ এর দিকে মরক্কোর দার্শনিক ও গবেষক ‘ইবনে বতুতা’ ভারত সফরে এসে খিচুড়ির জনপ্রিয়তা বর্ণনা করেন। তার অনেক লেখায় তিনি তা লিপিবদ্ধ করেছেন। আকবরের উজির ‘আবু-ই-ফাজি ইবনে মুবারক’ তাদের সময়ের খিচুড়ি রান্নার উপকরণ, মিশ্রণ পদ্ধতি, রান্নার কলাকৌশলে একটি পুষ্টিজাত রূপ দিয়েছেন সেটির বিষয়ে বেশকিছু বিষয় লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই পদ্ধতি এখনো অনেক অঞ্চলে ঐতিহ্যকে প্রচলিত রাখা হয়েছে এবং প্রচলন আছে। ইবনে মুবারকের বর্ণনা মোতাবেক খিচুড়ির তৎকালীন প্রকারভেদ গুলো নিম্নরূপ:
১। ডাল খিচুড়ি
২। ডিম খিচুড়ি
৩। পাতলা খিচুড়ি/তরল খিচুিড়
৪। সবজি খিচুড়ি
৫। মাংস খিচুড়ি
৬। কলিজা খিচুড়ি
৭। এরোমেটিক খিচুড়ি (পাশ্চাত্যে এরোমেটিক প্রাইড রাইস হিসেবে প্রসিদ্ধ)
আমাদের বাংলাদেশে বিদেশ হতে উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেক দেশি-বিদেশি ‘সেফ’ রয়েছে যাদের সাহায্যে বাংলাদেশি বহু রাঁধুনীরা এই ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাদ্য ও বিভিন্ন পুষ্টিগুণসম্পন্ন সবজি, ডিম বা মাংস মিশ্রিত খাদ্য উপস্থাপন করে বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে। তাছাড়া বিদেশে রন্ধন প্রতিযোগিতায়ও পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশে সরকারিভাবেও সংস্থা রয়েছে যারা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে রন্ধন বিষয়ের উপর। খাদ্য পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে দূরদর্শন শিক্ষা (উরমরঃধষ খবধৎহরহম) প্রশিক্ষণ এখন সহজে করা যায় এই ডিজিটাল যুগে। খিচুড়ি নিয়েও অনেক গবেষণা চলছে কীভাবে এর পুষ্টিগুণ আরো উন্নত করা যায়। শিশুদের বর্ধিতকরণ ব্যবস্থাপনায় একটি সুষম খাদ্য সহজলভ্য ও সহজ প্রক্রিয়া এই খিচুড়ি। এ ধরনের পুষ্টিজনিত খাদ্য হজমের জন্য সুবিধাজনক তবে সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার হিসেবে গ্রহণ করা সর্বোত্তম। রাতের খাবার হিসেবে গ্রহণ করতে হলে ঘুমানোর কমপক্ষে দু’ঘণ্টা আগে আহার করা হজমের জন্য সুবিধাজনক। যাদের ইউরিক এসিড বেশি থাকে তাদের জন্য মশুরি ডাল মার্জিত বা না খাওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। বাংলাদেশের পুষ্টিগুণ বিশিষ্ট রন্ধনশিল্পী অনেক রয়েছেন। অনেকে দেশীয় প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন। ডিজিটাল প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই শিল্পকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর