ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশে ধর্ষণ-নারী নির্যাতন ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। ধর্ষণের প্রতিবাদে সারাদেশে চলছে লাগাতার আন্দোলন। সব শ্রেণিপেশার মানুষের এ ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের মুখে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২০ চ‚ড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে মন্ত্রিসভায়। অধ্যাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি করা হয়েছে মৃত্যুদন্ড। মামলা শুরু থেকে বিচার শেষ করতে হবে ৬ মাসের (১৮০ দিন) মধ্যে। বিচারক বদলি হলেও মামলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। আজ মঙ্গলবার এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট অধ্যাদেশ জারি করবেন বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিশ্বে মৃত্যুদন্ডের বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও পরিস্থিতির কারণে আইনে সংশোধনীতে এনেছি। যদিও ধর্ষণের ফাঁসির দাবির আন্দোলনের মধ্যেও কেউ কেউ ‘ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড’ বিরোধিতা করছেন। তাদের বক্তব্য ফাঁসি দেয়া হলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে না। বরং নৈতিক শিক্ষা, সংস্কৃতির বিকাশ, ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়াদি পাঠ্যপুস্তকে জোর দেয়ার মাধ্যমে ধর্ষণ অপরাধ সমাজে কমানো যেতে পারে। নোয়াখালীতে বিবস্ত্র করে নির্যাতন, সিলেটের এমসি কলেজে তুলে নিয়ে ধর্ষণসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নের ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে। ধর্ষণের অপরাধে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ডের বিধান করার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে বিচার ও রায় কার্যকর করার জন্য আইন সংশোধনের দাবি রয়েছে বিভিন্ন সংগঠনের। এই প্রেক্ষাপটে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ড করার প্রস্তাব গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হয়।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ধর্ষণ মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত আছে। তদন্ত বিচার পদ্ধতি সব কিছুই এর মধ্যে উল্লেখ রয়েছে। নারী শিশু নির্যাতন ট্র্যাইব্যুনাল এটি করবে এবং শেষ করতে হবে ১৮০ দিনের মধ্যে। বিচারক যদি কোনো কারণে বদলি হয়ে যান সে ক্ষেত্রেও বিলম্ব হয় অনেক সময়। তবে কোনো বিচারক চলে গেলে তিনি মামলা যে অবস্থায় রেখে যাবেন সে অবস্থা থেকে মামলা চালিয়ে যেতে হবে। এখানে ক্ষতিপূরণের বিষয়ও রয়েছে, বিচারকরা যেন সেদিকে নজর দেন। এটিতে আইন আছে ১ লাখ টাকার। কিন্তু তার বাইরেও কিন্তু ক্ষতিপূরণের বিধান আছে। যেমন ১৫ ধারায় আছে অর্থদন্ডের বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি যাতে দন্ডিত ব্যক্তির থেকে বা তার বিদ্যমান সম্পদ থেকে আদায় করা যাবে, এ সম্পদ আদায় করতে হবে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, গত কিছু দিনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০০০-এর খসড়া অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হয়। আইনের ৯(১) ধারায় পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করা হয়েছিল। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ প্রতিরোধে এ ধারায় ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এতে প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) উপধারায় অধীন ধর্ষণের অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড প্রদানের লক্ষ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ সংশোধন করা প্রয়োজন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যেহেতু বর্তমানে সংসদের অধিবেশন নেই এবং আশুব্যবস্থা গ্রহণ খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে সে জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় তাহলে তিনি সংবিধানের ৯৩(১) প্রদত্ত ক্ষমতাবলে অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করতে পারবেন। যেহেতু সংসদ কার্যকর নেই সে জন্য এটা অধ্যাদেশের মাধ্যমে জারি করা হবে। লেজিসলেটিভ বিভাগের ভেটিংয়ের প্রেক্ষিতে চ‚ড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ (গ), ২০ (৭) উপধারা সংশোধন করতে হবে। ধর্ষণ ছাড়া সাধারণ জখম হলে কম্পাউন্ড করা যাবে। আগের আইনে ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের রেফারেন্স ছিল। ২০০৩ সালে শিশু আইন প্রচলন করা হয়। এ বিষয়টি সংশোধন করা হচ্ছে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এ সংশোধনী শুধু আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নয়, বিভিন্ন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আমরা দেখেছি, আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিসহ সব কিছু মিলিয়েই এ সিদ্ধান্ত এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এটি আলোচনায় এসেছে। মানুষের সচেতনতাটাই গুরুত্বপূর্ণ। এ আইন সংশোধনীর ফলে মৃত্যুদন্ডের বিষয়ে ব্যাপক ক্যাম্পেইন হচ্ছে। ফলে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের মধ্যে। যারা এ ক্রাইমটি করবে তারা চিন্তা করবে এতে তো মৃত্যুদন্ডের আদেশ রয়েছে। সে কিন্তু একটু হলে স্ক্যারট (ভীত) থাকবে।

এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলাগুলোর দ্রæত নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচাপরপতিকে ‘প্র্যাকটিস নির্দেশনা’ জারির অনুরোধ করা হবে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, সাজা বাড়ানোর যে ব্যাপারটা, এটা পরিস্থিতির কারণে। আপনারা জানেন- বিশ্বে মৃত্যুদন্ডের ব্যাপারে অনেক বিতর্ক আছে। তারপরেও আমাদের দেশে এই ঘৃণ্য অপরাধটির যে চিত্র দেখতে পাচ্ছি, সে কারণে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন এটা বাড়ানো উচিত। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মৃত্যুদন্ডের ব্যাপারটি সংশোধনীতে এনেছি। মঙ্গলবারই ওই অ্যধ্যাদেশ জারি করা হবে। এখন আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শুধু যে মামালাগুলো পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে সেগুলো নয়, যেগুলো পেছনে আছে সেগুলোও ধর্ষণের পুরোনো মামলাগুলো আগে করা হবে। নতুনগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করা হবে আইনি প্রক্রিয়ায়। আমরা আইনে বিশ্বাস করি। আইনি প্রক্রিয়ায় যতটুকু সময় লাগে সেই সময়ের মধ্যে ধর্ষণ মামলাগুলোর বিচার যাতে সম্পন্ন করা যায়, সেই চেষ্টা সরকার করবে।

তবে ধর্ষণের শাস্তি বাড়ালেই এ ধরনের অপরাধ কমবে কি না, সেই প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, সাক্ষীর সুরক্ষা আইন নিয়ে কাজ করছি। ধর্ষণের সাজা যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদন্ড করায় এই অপরাধটি কমে আসবে, না হলে (শাস্তি) বাড়ানোর প্রশ্নে আসতাম না। আমি প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করব, তিনি যেন প্র্যাকটিস নির্দেশনা দেন যেন বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এইসব মামলাগুলোর বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেন। অপরদিকে আইন মন্ত্রণালয় থেকে আমরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে যে স্টেশন পিপিরা আছেন, তাদের নির্দেশনা দেব যে মামলাগুলো শেষ করার জন্য ইমিডিয়েট পদক্ষেপ নেয়ার।

মন্ত্রিসভা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধনের অনুমোদন দেওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা সাংবাদিকদের বলেন, ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ড করে এই আইনের প্রয়োগ হলে দেশ ধর্ষণমুক্ত হবে। সারাদেশে অব্যাহত ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখে শাস্তি বাড়ানোর দাবি যেমন উঠেছে, তেমনি আইনের যথাযথ প্রয়োগের আহ্বানও আসছে। তিনি বলেন, আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করার মাধ্যমে ইনশাল্লাহ আমাদের এ দেশে ধর্ষণমুক্ত হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর