আজ প্রধানমন্ত্রী হাওরের বিস্ময় অলওয়েদার সড়ক উদ্বোধন করবেন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ হাওর-বাওর নদী বেষ্টিত জেলা কিশোরগঞ্জ। কি শুকনো কি বর্ষাকাল। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সৌন্দর্যের বিপুল পসরা সাজিয়ে বসে থাকে কিশোরগঞ্জের হাওর। হাওরের এই সৌন্দর্যে এখন এক ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে নান্দনিক এক সড়ক। হাওরের বিশাল জলরাশির বুক চিরে বাস্তবায়িত হয়েছে ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি। সড়কের দু’পাশে থৈ থৈ পানি, আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। মেঘ আর জলের এই মনোরম মিতালির সামনে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকা। সড়কের পাশে বসে বুকভরে নির্মল বাতাস উপভোগ আর হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না।

গভীর হাওরের তিন উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের জন্য তৈরি করা নান্দনিক এই সড়কটি এখন সৌন্দর্যপিপাসুদের কাছে হয়ে ওঠেছে এক দুর্নিবার আকর্ষণের নাম। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এরই মাঝে আগামীর পর্যটন ঠিকানা হিসেবে দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছে সড়কটি।

এর মাধ্যমে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায় পর্যটন সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। একটি মাত্র সড়ক বদলে দিয়েছে হাওরের সামগ্রিক দৃশ্যপট। সড়কটি নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন ‘ভাটির শার্দুল’ রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

হাওরবাসীর কষ্ট লাঘবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এর অভিপ্রায় এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার মধ্যে সারা বছর চলাচলের লক্ষ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কর্তৃক ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণ প্রকল্প গৃহীত হয়।

রাষ্ট্রপতির হাত ধরেই শুভ সূচনা হয় এর নির্মাণ কাজের। ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আনুষ্ঠানিকভাবে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক প্রকল্পের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।

নির্মাণ কাজ শেষে এবার হাওরের বিস্ময়খ্যাত অলওয়েদার সড়কটির উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনা পরিস্থিতির কারণে সশরীরে উপস্থিত হতে না পারলেও বৃহস্পতিবার (৮ অক্টোবর) সকালে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হাওরবাসীর স্বপ্নের এ সড়ক উদ্বোধন করবেন তিনি।

কিশোরগঞ্জের সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশেদুল আলম জানান, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এর অধীনে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ৮৭৪.০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে।

২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই অলওয়েদার সড়কে ৫৯০.৪৭ মিটার দীর্ঘ ৩টি পিসি গার্ডার নির্মাণ, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ৬২টি আরসিসি বক্স কালভার্ট নির্মাণ, ২৬৯.৬৮ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রীজ নির্মাণ ও ৭.৬০ লক্ষ বর্গমিটার সিসি ব্লক দ্বারা স্লোপ প্রটেকশন কাজ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬১.৮১ মিটার দীর্ঘ ভাতশালা সেতু, ১৭১.৯৬৪ মিটার ঢাকী সেতু এবং ১৫৬.৭২ মিটার দীর্ঘ ছিলনী সেতু এই তিনটি সেতু সড়কটির সৌন্দর্য্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা কিশোরগঞ্জের পূর্ব প্রান্তে বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা নিয়ে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার অবস্থান। হাওর অধ্যুষিত এই তিনটি উপজেলা বছরে অর্ধেকের বেশি সময় জলমগ্ন থাকায় এলাকাটি অনগ্রসর ও দুর্গম হিসেবে পরিচিত। হাওর এলাকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে।

ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ না থাকায় বর্ষাকাল ও শুষ্ক মৌসুমে তিনটি উপজেলার জনগণকে অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হতে হত। হাওরবাসীর এই কষ্ট লাঘবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ হাওরের বুক চিরে অলওয়েদার সড়ক নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন। তাঁর অভিপ্রায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সায় দিয়ে উদ্যোগ নেন বিশাল এই কর্মযজ্ঞের।

সড়কটি ইটনা উপজেলা সদর হতে শুরু হয়ে ধনু ও বাউলাই নদীর সমান্তরালে সম্পূর্ণভাবে বিস্তীর্ণ হাওরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে মিঠাইন উপজেলা সদর হয়ে অষ্টগ্রাম উপজেলা সদরে সমাপ্ত হয়েছে।

বর্ষাকালে হাওরের পানির প্রচণ্ড স্রোতে যেন নির্মিত সড়ক বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সড়কের সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্যে সড়ক বাঁধের উভয় পাশের স্লোপে সিসি ব্লক দিয়ে প্রতিরক্ষা কাজ ও সড়ক বাঁধের স্থায়িত্বের জন্য টো-ওয়াল বরাবর সিসি ব্লক দ্বারা ফলিং এপ্রোনের কাজ করা হয়েছে।

বর্ষায় সড়কের দু’পাশের গ্রামসমূহে নৌপথে যাতায়াতের লক্ষ্যে সড়কের বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে কৃষি জমিতে যেন সেচ কাজ বাধাগ্রস্ত না হয় এবং হাওরের উৎপাদিত ফসলবাহী যানবাহন যেন সড়কের নীচ দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে, সেজন্য সড়কের বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে।

হাওরবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন সদ্য নির্মিত ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কটি এরই মধ্যে পরিচিতি পেয়েছে হাওরের বিস্ময় হিসেবে। সড়কটি নির্মিত হওয়ায় অনুন্নত হাওর এলাকায় আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। সড়কটিতে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটকের আগমনে এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ায় ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম তিন উপজেলার মধ্যে সারা বছর চলাচলের উপযোগী সড়ক নেটওর্য়াক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অদূর ভবিষ্যতে মিঠামইন উপজেলার সাথে একটি ফ্লাইওভারের মাধ্যমে করিমগঞ্জ উপজেলার সাথে এবং অষ্টগ্রাম উপজেলার মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার সাথে তথা ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য জেলার সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে।

হাওরের বিস্ময়খ্যাত এই সড়কটি এখন পরিণত হয়েছে পর্যটনের তীর্থক্ষেত্রে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই সড়কটি দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন সৌন্দর্য্য আর ভ্রমণপিপাসুরা। হাজারো পর্যটকের পদচারণায় এখন মুখরিত হাওরের একসময়ের অবহেলিত আর প্রত্যন্ত এই জনপদ।

বাংলাদেশের কোথাও হাওরের মাঝখানে এত দীর্ঘ সড়ক নেই। দিগন্ত বিস্তৃত এ সড়ককে ঘিরে দুঃখ ঘুচেছে হাওরবাসীর। বর্ষায় কর্মহীন অনেক মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। করোনাভাইরাসের সময়েও সৌন্দর্য্য, বিনোদন আর প্রশান্তির এক অনন্য ঠিকানা হয়ে ওঠেছে হাওরের এ সড়কটি।

এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে অনেক ভিআইপিরা আসছেন মিঠামইনে। মন্ত্রী, আইজিপি, সচিব, যুগ্মসচিব থেকে শুরু করে বিচার বিভাগসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ কেউ না কেউ প্রতি সপ্তাহে আসছেন। বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। এরকম পরিস্থিতিতে ভিআইপিদের প্রটোকল দিতে হিমশিম খাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন।

জানা গেছে, অলওয়েদার সড়কটি নির্মিত হওয়ায় এসব এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে হাজারো মানুষের। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাভবান হয়েছেন এসব উপজেলার মানুষ। হাওরের বুকচিরে নির্মিত দীর্ঘ নান্দনিক সড়ক দেখতে হাজারো মানুষ ভিড় করেন। ফলে এলাকায় ক্ষুদ্র দোকানি, রেঁস্তোরা মালিক, নৌকার মাঝি, নসিমন-করিমন-লেগুনা-অটোরিকশা-মিশুকের চালক মিলিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য মানুষের।

বছরে ৬ মাস যে হাওরবাসী অলস বসে থাকতো এখন তারা পর্যটকদের সেবায় মহাব্যস্ত। ইটনা থেকে মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের সড়ক দেখতে যেতে হয় পানি পথ পাড়ি দিয়ে। ফলে মাঝিরা খুঁজে পেয়েছেন আয়ের উৎস। সবাই ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক দেখতে আসছেন।

একটি মাত্র রাস্তা কীভাবে একটি জনপদের অর্থনৈতিক অবস্থা বদলে দিচ্ছে তা বিস্ময়কর। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি, নয়নাভিরাম সড়ক ও হাওরের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকদের ঢল নামে সেখানে। দিনের আলো থাকা পর্যন্ত অসাধারণ স্মৃতি সাথে নিয়ে যেতে ব্যস্ত থাকেন পর্যটকরা। সমুদ্রে সূর্য ডোবার দৃশ্যের সঙ্গে অদ্ভুত মিল এখানে। সূর্যাস্তের সময় লালচে আকাশে ফুটে উঠে ভিন্ন রূপ।

হাওরের ঢেউ আর বাতাসের শ-শ শব্দের দিগন্তবিস্তৃত এ সড়কের সৌন্দর্য ধরে রাখতে চান স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা। এ জন্য প্রশাসন ইতোমধ্যে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে।

মিঠামইনের ইউএনও প্রভাংশু সোম মহান বলেন, অলওয়েদার সড়ক হাওরের সৌন্দর্য্যকে বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া সড়কটি নির্মিত হওয়ায় হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে এখানকার অনেক মানুষ দিনে ৫০০ টাকা আয় করতে পারতো না। অথচ এখন একই ব্যক্তি দিনে কমপক্ষে ২০০০ হাজার টাকা আয় করছেন।

তাঁর মতে, মিঠামইনে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। একইভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অষ্টগ্রাম ও ইটনায়ও। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা এত দ্রুত বদলে যাবে তা কল্পনাও কেউ করেনি।

কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য ও রাষ্ট্রপতির বড় ছেলে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, এ সড়কটি হওয়ার ফলে তিন উপজেলার মানুষের যোগাযোগসহ পরস্পরের প্রতি সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে হাওরের অলওয়েদার সড়কটি সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কের সাথে সংযোগ স্থাপন করা হবে। এছাড়া হাওরে ফ্লাইওভার নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর