স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি কর্তব্য

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইসলাম-পূর্ব যুগে কোনো জাতি নারীকে দাসীরূপে ব্যবহার করতো, আবার কোনো জাতি নারীকে দেব-দেবীর আসনে বসিয়ে পূজা-অর্চনা করতো। নারীর প্রতি আচরণে ইসলাম এর মধ্য-পন্থা অবলম্বন করেছে।

কোরআন বলে, ‘তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরাও তাদের পোশাক; তাদের প্রতি তোমাদের যেরূপ অধিকার আছে, তোমাদের প্রতিও তাদের তদ্রুপ অধিকার আছে।’ বস্তুতঃ দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তি ভবিষ্যত সকল কিছু নির্ভর করে (স্বামী-স্ত্রীর), উভয়ের উপর। একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল না হলে সেখানেই অনর্থের সৃষ্টি হয়। সুতরাং সাংসারিক জীবনকে সুখময় করে গড়ে তোলার জন্য দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর এবং স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কতোগুলি কর্তব্য আছে।

স্বামীর কর্তব্য: স্ত্রীর সাথে উত্তম ব্যবহার করবে, তাকে ঘৃণা করবে না, স্বামীর ইচ্ছামত না চললে স্ত্রীর প্রতি কঠোর হবে না, বিশেষ বিশেষ কারণে সামান্য প্রহার ব্যতীত স্ত্রীকে বেদম প্রহার করবে না। বরং স্ত্রীর সাথে সময় সময় নির্দোষ খেলা-ধুলা এবং আমোদ-প্রমোদ করবে। স্ত্রীর গুপ্ত বিষয় গোপন রাখবে। নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতীত সন্তুষ্টির জন্য কিছু বৈধ ব্যয় করবে, একাধিক স্ত্রী থাকলে সকলের সাথে সমব্যবহার করবে, স্ত্রীকে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করবে। স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রীকে তার অংশ মত উত্তরাধিকারী বলে গণ্য করবে ইত্যাদি।

স্ত্রীর কর্তব্য: সন্তষ্টচিত্তে স্বামীর সাথে বসবাস করবে, স্বামী সঙ্গম করার জন্য স্ত্রীকে আহ্বান করলে বিনা কারণে তা প্রত্যাখ্যান করবে না, স্বামীর গৃহের যাবতীয় আসবাব-সামগ্রী নিজের ভেবে তার তত্ত্বাবধান করবে, স্বামীর মান-সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রাখবে, প্রত্যেক ব্যাপারে সর্বদা স্বামীর মনোরঞ্জন করতে চেষ্টা করবে।

১. হাদিস: হজরত আবু মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, যখন কোনো মুসলমান পূণ্য লাভের আশায় তার স্ত্রীর জন্য কিছু ব্যয় করে, তার পক্ষে একটি দানের তুল্য হয়। (বোখারী মুসলিম)

২. হাদিস: হজরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (স) বলেছেন, তাদের ওই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীর সাথে উত্তম ব্যবহার করে। স্ত্রীর প্রতি ব্যবহারে তোমাদের মধ্যে আমি উত্তম। যখন তোমার সঙ্গীর মৃত্যু হয়, তাকে ত্যাগ কর। (তিরমিজী)

৩. হাদিস: হজরত সাওবান (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (স) বলেছেন, কোন ব্যক্তির ব্যয়কৃত অর্থের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট অর্থ তা-ই যা সে তার পরিবারের জন্য ব্যয় করে, যা আল­াহর পথে তার প্রাণীর জন্য ব্যয় করে এবং যা আল­াহর পথে তার সাথীগণের জন্য ব্যয় করে। (মুসলিম)

৪। হাদিস: হজরত আবু হোরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (স) বলেছেন, কোন ব্যক্তির দু’স্ত্রী থাকলে, সে যদি তাদের উভয়ের সাথে সম-ব্যবহার না করে তবে বিচার দিবসে সে তার দেহের অর্ধেক লোপ পাওয়া অবস্থায় উপস্থিত হবে। (তিরমিজী, আবু দাউদ)

৫. হাদিস: হজরত আবদুলল্লাহ্ বিন্ আমর (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, পৃথিবীর সব কিছুই সম্পদ। এ পার্থিব সম্পদের মধ্যে উৎকৃষ্ট সম্পদ হল-সতী স্ত্রী। (মুসলিম)

৬: হাদিস: হজরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (স) বলেছেন, তিনি তার স্ত্রীদের প্রতি সম-ব্যবহার করতেন এবং বলতেন, “হে আল্লাহ্! যে বিষয়ে আমি সক্ষম, সে বিষয়ে আমি এরূপ বণ্টন করেছি এবং যে বিষয়ে আমি অক্ষম কিন্তু তুমি সক্ষম, সে বিষয়ে আমাকে তিরস্কার কর না।” (তিরমিজী, আবু দাউদ)

৭. হাদিস: হজরত আবু হোরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, কোনো বিশ্বাসী স্বামী কোনো বিশ্বাসিনী স্ত্রীকে ঘৃণা করবে না। তার একটি দোষ পেলে, অন্য গুণের কারণে তাকে ভালোবাসবে। (মুসলিম)

৮. হাদিস: হজরত আবু হোরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (স) বলেছেন, স্ত্রীগণকে সৎ উপদেশ প্রদান করবে, কেননা পাজরের হাড় দ্বারা তার সৃষ্ট। পাঁজরের হাড়ের মধ্যে উপরের হাড় সর্বাপেক্ষা বক্র। যদি একে সরল করতে চাও, তবে তা ভেঙ্গে যাবে, যদি ছেড়ে দাও, তবে ইহা আরও বক্র হবে। সুতরাং স্ত্রীগণকে উপদেশ দিতে থাকো। (বোখারী)

৯. হাদিস: হজরত আবু হোরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (স) বলেছেন, যখন কোনো স্ত্রীকে তার স্বামী শয্যায় আহ্বান করে এবং সে অস্বীকার করে এবং তজ্জন্য তার স্বামী ক্ষোভে রাত্র কাটায়, সেই স্ত্রীকে সকাল পর্যন্ত ফেরেশতাগণ অভিশাপ দেয়। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যার হাতে আমার জীবন তার শপথ! কোনো স্ত্রীকে তার স্বামী শয্যায় আহ্বান করলে, সে যদি তা অস্বীকার করে, তা হলে যিনি আকাশে আছেন, তিনি তার প্রতি অসন্তষ্ট থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তার স্বামী সন্তষ্ট না হয়। (বোখারী, মুসলিম)

১০. হাদিস: হজরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স)-এর সন্নিকটে আমি আমার সঙ্গিনীগণকে নিয়ে ঘরের মেঝেতে খেলতেছিলাম। তিনি ঘরে প্রবেশ করলে আমরা খেলা বন্ধ করে দিলাম। তিনি আবার তাদেরকে আমার কাছে পাঠালেন এবং তারা আমার সাথে খেলতে লাগল। (বোখারী, মুসলিম)

১১. হাদিস: হজরত আবু হোরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (স) বলেছেন, যদি কোনো ব্যক্তিকে অন্য ব্যক্তির সিজদাহ্ করার আদেশ দিতাম, তবে আমি স্ত্রীকে বলতাম তার স্বামীকে সিজদাহ করতে। (তিরমিজী)

১২. হাদিস: হজরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (স)-এর সাথে আমি এক ভ্রমণে ছিলাম, তখন তার সাথে দৌড়ের প্রতিযোগিতা হল। আমি দৌড়ে তাকে পরাজিত করলাম। যখন আমি স্থলূকায় হলাম, তার সাথে আবার দৌড়ের প্রতিযোগিতা হল, কিন্তু তিনি দৌড়ে আমাকে পরাজিত করলেন এবং বললেন হে আয়েশা! এটা তোমার পূর্ণ বিজয়ের প্রতিশোধ। (আবু দাউদ)

১৩. হাদিস: হজরত উম্মে সালামাহ্ (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (স) বলেছেন, যে নারীর মৃত্যুর সময় তার স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, মৃত্যুর পরে সে নারী বেহেশতে প্রবেশ করবে। (তিরমিজী)

১৪. হাদিস: হজরত হাকিম বিন্ মারিয়া (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার পিতা রাসূলুল্লাহ্ (স)-এর কাছে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের কোনো রমনীর তার স্বামীর উপর কি হক আছে? তিনি বললেন, যখন তুমি খাদ্য গ্রহণ কর তখন তাকেও খাদ্যদান করা, যখন বস্ত্র পরিধান কর তাকে বস্ত্র প্রদান করা, তার মুখমণ্ডলের উপর আঘাত না করা। তাকে তিরস্কার না করা এবং নিজ ঘর ব্যতীত অন্য ঘরে তাকে পরিত্যাগ করে না যাওয়া। (আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ্)

১৫. হাদিস: হজরত তাক বিন আলী (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (স) বলেছেন, যখন কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে সঙ্গম করার জন্য ডাকে, তখন সে উনানের কাছে থাকলেও যেন তার কাছে এসে উপস্থিত হয়। (তিরমিজী)

১৬. হাদিস: হজরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, যে ব্যক্তির স্বভাব-চরিত্র সর্বাপেক্ষা উত্তম এবং পরিবারের দয়ার্দ্র চিত্ত, সে বিশ্বাসীদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাসের অধিকারী। (তিরমিজী)

১৭. হাদিস: হজরত আবু হোরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন নারীর মনকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে অথবা কোনো দাসকে তার প্রভুর বিরুদ্ধে বিষাক্ত করে তোলে, সে আমার দলের অন্তর্গত নহে। (আবু দাউদ)

১৮. হাদিস: হজরত আবু হোরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (স) বলেছেন, বিশ্বাসীদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাসের অধিকারী এ ব্যক্তি যার স্বভাব-চরিত্র তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম। তোমাদের মধ্যে সে উত্তম যে তার স্ত্রীর প্রতি ব্যবহারে উত্তম। (মিশকাত)

১৯. হাদিস: হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (স)-এর কাছে (উপবিষ্ট) ছিলাম এমন সময় একজন নারী রাসূলুল্লাহ্ (স)-এর কাছে এসে বলল, আমি নামাজ পড়ার সময় আমার স্বামী। সাফওয়ান আমাকে প্রহার করে। আমি রোজা রাখলে তা ভঙ্গ করে দেয় এবং সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত সে ফযরের নামাজ পড়ে না। সাফওয়ান সেখানে উপস্থিত ছিল। রাসূলুল্লাহ (স) তার কাছে তা জিজ্ঞেস করলে সে বলল, হে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ ! “আমি নামাজ পড়ার সময় সে আমাকে প্রহার করে তার এ কথা সম্বন্ধে (আমার বক্তব্য এ যে), সে দুই সূরা দিয়ে নামাজ পড়ে, আমি তাকে তা নিষেধ করেছি। রাসূলুল্লাহ্ (স) তখন বললেন, যদি সে এক সূরা দিয়ে নামাজ পড়ত তবে তা মানুষের জন্য যথেষ্ট হত। “আমি রোজা রাখলে তা ভঙ্গ করে দেয় তার এই কথা সম্বন্ধে (আমার বক্তব্য এ যে,) আমি একজন যুবক, আমি (সহবাসের অপেক্ষায়) আত্ম-সংবরণ করতে পারি না। রাসূলুল্লাহ্ (স) তখন বললেন, কোনো নারী যেন তার স্বামীর অনুমতি ব্যতীত নফল (অতিরিক্ত) রোজা না রাখে। “সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত ফযরের নামাজ পড়ে না” তার এ কথা সম্বন্ধে (আমার বক্তব্য এ যে) আমি এমন পরিবারভুক্ত যারা এ জন্য সুপরিচিত। সূর্যোদয় না হলে আমরা নিদ্রা হতে জাগরিত হতে পারি না। রাসূলুল্লাহ (স) বললেন, হে সাফওয়ান! যখন দ্রিা হতে জাগ, তখন নামাজ পড়। (আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ)

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর