গতি ফিরছে পোশাক খাতে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ করোনা ভাইরাসের শুরুর দিকে বিপর্যস্ত তৈরি পোশাক খাত এখন অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। করোনার প্রভাবে বাতিল ও স্থগিতাদেশ হওয়া পোশাকের ক্রয়াদেশের পণ্য নিতে শুরু করেছেন বিদেশি ক্রেতারা। আবার নতুন করে আসছে ক্রয়াদেশও। এরই মধ্যে অনেক কারখানাতেই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাজ করার মতো পর্যাপ্ত ক্রয়াদেশ চলে এসেছে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খোলা, ক্রেতাদের আস্থা ফিরে আসা ও শ্রমিকদের আন্তরিকতার ফলে এটি সম্ভব হয়েছে। দেশে করোনা ভাইরাস শুরুর পরই শ্রমিকদের বেতন দিতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণেদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। সর্বশেষ জুলাই মাসে আরো ৩ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ দেয় সরকার। এর ফলে এ খাতে অর্থনৈতিক সংকট অনেকাংশেই কেটে যায়। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আপাত দৃষ্টিতে সার্বিক পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেখা গেলেও পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে এখনো অনেক সময়ের প্রয়োজন।

তৈরি পোশাক খাতের ঘুরে দাঁড়াতে এখনো অনেক দূর যেতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভালো খবর হলেও করোনা মহামারির কারণে অর্থনীতি যতটা পেছনে চলে গেছে সেখান থেকে ফিরে আসতে আরো অনেক সময় লাগবে। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, পোশাক খাতের বাতিল হয়ে যাওয়া ক্রয়াদেশ ফিরে এসেছে। তবে করোনা মহামারির আগে যে পরিমাণ রপ্তানি হতো তার থেকে অনেক দূরে আছে। তিনি বলেন, কয়েক লাখ লোক বর্তমানে চাকরিহারা হয়েছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় বিপর্যয়। এটাকে কাটিয়ে ওঠাই এখন প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। পোশাক খাত এখনো আগের জায়গায় যায়নি। তবে বছর শেষে আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, আমরা সতর্কতার সঙ্গে বিষয়গুলো যাচাই করছি। তবে মার্কিন-চায়না দ্বন্দ্বের সুফল আমরা কাজে লাগাতে পারব। কিন্তু পোশাক খাতে বিশ্বে আমরা দ্বিতীয় পজিশন ধরে রাখতে পারব কিনা সন্দেহ আছে। কারণ ভিয়েতনাম অনেক এগিয়ে রয়েছে।

জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস ও টিকা আবিষ্কার না হওয়ায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে গত মার্চে সেখানকার বড় ক্রেতারা একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করতে থাকেন। এদিকে দেশেও ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর মাসখানেক পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল। তাতে এপ্রিলে মাত্র ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়, যা গত ২ দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। পরের মাসে রপ্তানি হয় ১২৩ কোটি ডলারের পোশাক। জুনে সেটি বেড়ে ২২৫ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপরও বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৭৯৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়, যা তার আগের বছরের চেয়ে ৬১৮ কোটি ডলার কম। চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলেও ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ কম প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। কিন্তু আগস্ট মাসের চিত্র এখন পর্যন্ত ভালো। চলতি মাসের ১৯ দিনে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তার মানে করোনার মধ্যে রপ্তানি আয়ের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধিতে ফিরতে সক্ষম হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত।

বাংলাদেশি পোশাকের অন্যতম বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান সুইডেনের এইচএন্ডএম। এই ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বা ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার পোশাক কিনে থাকে। এইচএন্ডএমের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইথিওপিয়ার প্রধান জিয়াউর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, গত ২ থেকে আড়াই মাসে আমরা ৫০ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ দিয়েছি। আমাদের ৩০০ সরবরাহকারী কারখানার সবাই ক্রয়াদেশ পেয়েছে। এইচএন্ডএমের ক্রয়াদেশ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। চীন ও তুরস্ক থেকে যেসব ক্রয়াদেশ সরছে, তার একটি অংশ বাংলাদেশে আসছে। কারণ, বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম।

জানতে চাইলে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, পোশাক খাত ভালো হয়েছে বা ঘুরে দাঁড়িয়েছে- এ কথা ঠিক নয়। কারণ পোশাকগুলো তৈরি করে আমেরিকা, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের বাজারে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ পণ্য আমরা রপ্তানি করে থাকি। কিন্তু ইউরোপ, আমেরিকার বাজারে অনলাইনভিত্তিক লেনদেনে কিছুটা গতি দেখা গেলেও শপিংমল ও মার্কেটগুলোতে লোকসমাগম নেই বললেই চলে। অর্ধেক গ্রাহকও এখন পর্যন্ত আসেনি। মূল চাহিদা যদি সৃষ্টি না হয় তাহলে তার স্থায়িত্ব থাকে না। তিনি বলেন, এখনো বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে আবার নতুন করে করোনা মহামারির প্রকোপ বাড়ছে। অনেক দেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে নতুন করে কোয়ারেন্টাইনের শর্ত জুড়ে দিয়েছে। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত করোনা মহামারি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা কোনো কিছুকেই ভালো বলতে পারব না। মহিউদ্দিন বলেন, তবে সুখবর হচ্ছে, অনেকগুলো ভ্যাকসিন এখন পরীক্ষামূলক অবস্থায় আছে। আমরা যত দ্রুত এসব ভ্যাকসিন বাজারে আনতে পারব, আমাদের অর্থনীতি ঠিক তত দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াবে এবং স্থায়ীত্ব পাবে।

দুই দফায় ৮ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা : কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় সারাদেশে লকডাউন ঘোষণার পর সরকার রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের ২ মাসের (এপ্রিল-মে) বেতনভাতা দিতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল। এরপর দেশের গার্মেন্ট শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠনগুলো সরকারের ওই প্রণোদনা সুবিধা আরো বাড়ানোর দাবি জানান। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের শিল্প খাতের সুরক্ষায় আরো ৩ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা সুবিধা ঘোষণা করে সরকার। সচল রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের জুলাই মাসের বেতনভাতা হিসেবে ‘শেষবারের মতো’ ওই প্রণোদনা সুবিধা দেয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘শেষবারের মতো’ শব্দবন্ধ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূলত স্পষ্ট করে দিয়েছে এরপর বেতনভাতা বাবদ সরকার আর কোনো প্রণোদনা সুবিধা দেবে না। এছাড়া এর আগে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা সুবিধা ২ শতাংশ সুদে দেয়া হলেও এবারের প্রণোদনা সুবিধার সুদ হার হবে ৯ শতাংশ, যার অর্ধেক সাড়ে ৪ শতাংশ সরকার ভর্তুকি দেবে।

মাস্ক ও পিপিই রপ্তানি বাড়ছে বাংলাদেশের : করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) ও মাস্কের চাহিদা বেড়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকাতেও এ দুটি পণ্য বৈচিত্র্য এনেছে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে সুরক্ষা পণ্যের রপ্তানি। বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগও করছেন। উদ্যোক্তারা জানান, তৈরি পোশাক খাতে এ ২ পণ্যের মাধ্যমে বৈচিত্র্য আনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। যে পরিমাণ রপ্তানি আদেশ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন ক্রেতারা তা পূরণ করা গেলে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি করবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ৩ মাসে মাস্ক রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ৩১ লাখ ডলারের। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল মাত্র ১০ লাখ ডলার। পুরো অর্থবছরের হিসাবে ৫ গুণ বেড়ে মোট রপ্তানি হয়েছে আড়াই কোটি ডলারের। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ৫৫ লাখ ডলার। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর তথ্য অনুযায়ী, প্রচলিত বাজারের মধ্যে কানাডায় মাস্কের রপ্তানি বেশি হারে বেড়েছে। মোট রপ্তানির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ৫০ লাখ ডলারের মাস্ক গেছে দেশটিতে। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ডলার। দেশটিতে সার্বিক পোশাক রপ্তানি ২৬ শতাংশ কমলেও মাস্কের এ চাহিদায় বড় সম্ভাবনা দেখছেন উদ্যোক্তারা। জার্মানি, ফ্রান্সসহ ইউরোপের সব দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রেও চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। এমনকি ভারত, থাইল্যান্ডের মতো বাজারেও চাহিদা অনেক বেড়েছে। অন্যদিকে গত অর্থবছর পিপিই রপ্তানি হয়েছে ৫১ কোটি ডলারের। সবচেয়ে বেশি ১১ কোটি ডলারের পিপিই গেছে জার্মানিতে। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৮ কোটি ডলারের।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় করোনায় পোশাক শ্রমিক আক্রান্ত কম : দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ছড়ানোর পর সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিল পোশাক খাতের লাখ লাখ কর্মী। তাদের মধ্যে সংক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যু অনেক বেশি হবে বলেই বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তবে প্রায় ৬ মাসের কাছাকাছি সময়ে এসে এখন দেখা যাচ্ছে, পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে সংক্রমণের মাত্রা তুলনামূলক খুবই কম। এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও খুবই কম। তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারদের সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্রে জানা যায়, দেশে ৪ হাজারের বেশি পোশাক কারখানায় প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। সরকারের স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে কারখানা খোলা, বিজিএমইএ অডিট টিমের নিয়মিত কারখানা পরিদর্শন, সুরক্ষার বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ কার্যকর করার ফলে পোশাক কারখানাগুলোতে তেমন সংক্রমণ ছড়ায়নি। সর্বশেষ তথ্য মতে, বিজিএমইএর তালিকাভুক্ত কারখানাগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫১১ জন। এর মধ্যে ৪৪৫ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। বাকিরা চিকিৎসাধীন। জানতে চাইলে রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা পরিচালনা করায় করোনার প্রভাব তেমন একটা প্রতিফলিত হয়নি পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে। এছাড়া যারা পরিশ্রম করে, তাদের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কম। শারীরিক সক্ষমতার কারণে আক্রান্ত হলেও অনেকে বুঝতেও পারেনি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর