রসনাবিলাস ও পুষ্টির হিসাব-নিকাশ

 

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মানুষ প্রতিদিন খাদ্য গ্রহণ করে। কেউ বেঁচে থাকার জন্য খেয়ে থাকে, আবার কেউ বা নিজের রসনাবিলাস সাধনের জন্য খেয়ে থাকে। খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর না তুললে কী খাওয়া হলো, ভাবে অনেকে। বাংলাদেশ তার নানা বৈচিত্র্যের জন্য অতুলনীয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো খাবারের বৈচিত্র্য। একেক অঞ্চলের খাবার তার অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য কমবেশি বিখ্যাত। যেমন—মুক্তাগাছার মণ্ডা, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, বগুড়ার দই। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কলাইয়ের রুটি। চট্টগ্রামের মেজবানের খাবার। সিলেটের সাতকড়া। দিনাজপুরের সুগন্ধি চাল বা বিভিন্ন অঞ্চলের মাছের বৈচিত্র্য। শুধু ইলিশ মাছ খেয়ে অনেকেই এর স্বাদ ভুলতে পারে না; আবার অনেকে সরষে ইলিশ বা ইলিশের পাতুরি না খেলে আবার ইলিশ খাওয়া কেন, তাই ভাবে। এদিকে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের তো তুলনা মেলা ভার। তেহারি, নেহারি, ডালপুরি, মালাই চা আরো কত কী। এমন উদাহরণ তো ভূরি ভূরি মেলে। বাঙালির আরেক প্রিয় জিনিস আড্ডা। সে আড্ডার অন্যতম আলাপও কখনো হয় খাবারকে কেন্দ্র করে। সে জন্যই বোধ করি পুরান ঢাকায় প্রচলিত কথা—‘নলি ডুবাইয়া খাইছি’! শুধু পুরান ঢাকা কেন, কবজি ডুবিয়ে খাওয়ার কথা তো অনেক বৈঠকি আড্ডা বা সাহিত্যেও পাওয়া যায়। ফলে অনেকের মধ্যে কেউ বা নিজে খেয়ে আবার অন্য কেউ বা গল্প-উপন্যাসের পাতায় বিভিন্ন উপাদেয় খাবারের স্বাদ পেয়েছে।

এই যে খাবারদাবারের বিষয়ে এত কথা বলা হলো তা কি শুধুই রসনাবিলাসের জন্য, নাকি এর অন্য কোনো দিকও আছে? আছে বৈকি। আচ্ছা, কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি খাদ্যচয়নে (food choice) কী করেন? এ ক্ষেত্রে কি পুষ্টিগুণের কথা ভাবে? নিশ্চিতভাবেই  বেশির ভাগের উত্তর হবে, খাদ্যচয়নের ক্ষেত্রে খাওয়ার তৃপ্তি বা জিভের স্বাদই মুখ্য। তবে দু-একজন হয়তো বলবে, তারা পুষ্টিগুণের কথাও বিবেচনায় নেয়। পুষ্টিগুণের পাশাপাশি জানা প্রয়োজন ‘স্বাস্থ্যকর খাবার’ কী এবং ‘অস্বাস্থ্যকর খাবার’ কী? এ বিষয়ে পুষ্টিবিজ্ঞানী বা স্বাস্থ্যবিদের মত কী? ‘অস্বাস্থ্যকর খাবার’ হলো সেই খাবার যা উচ্চ ক্যালরি ও চিনিযুক্ত,  লবণের পরিমাণ বেশি, খাদ্যে আঁশ কম, অণুপুষ্টি (micronutrient) অপর্যাপ্ত। এই খাবারগুলো নিরাপদ নয়। অন্যদিকে খাদ্যের মান অর্থাত্ ভেজালমুক্ত, আঁশযুক্ত, পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পরিমাণমতো অর্থাত্ দেহের দৈনন্দিন চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে গ্রহণ করলেই তাকে বলা যায় ‘স্বাস্থ্যকর খাবার’। খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে সময় ও পরিমাণটাও গুরুত্বপূর্ণ। না খেয়ে যতজন মারা যায়, বেশি খেয়ে তার চেয়ে অধিকসংখ্যক লোক মারা যায়—এটিই সত্যি। পরিসংখ্যানও সে কথার সাক্ষ্য দেয়। দেশে ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে ওজনাধিক্যের সংখ্যা এবং অসংক্রামক রোগীর (NCD-Non-Communicable Disease) সংখ্যা। অসংক্রামক রোগের (উচ্চ রক্তচাপ, হূদেরাগ, লিভারজনিত, কিডনির জটিলতা, ডায়াবেটিস) কারণই হলো ‘অস্বাস্থ্যকর খাবার’ গ্রহণ এবং অধিক পরিমাণে এই খাবার খাওয়া, যা ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণও বটে। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৫৯ শতাংশ মারা যায় অসংক্রামক রোগের কারণে। ১৯৯৭ সালে ১৮ বছরের বেশি বয়সের স্থূলকায় মানুষ ছিল মোট জনসংখ্যার ১.১ শতাংশ; ২০১৭ সালে বেড়ে হয়েছে ৩.৪ শতাংশ (সূত্র : এফএও : বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি প্রতিবেদন)। ২০০৪ সালে দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীর মধ্যে ৯ শতাংশ স্থূলকায়, এখন তা ২৪ শতাংশ (সূত্র : WFP : Fill the Nutrient Gap, 2019)।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যচয়নে (healthy food choice) যে বিষয়গুলো কাজ করে, তা হলো ক্ষুধা, স্বাদ, খাবারের মূল্য, ক্রয়ক্ষমতা, বাজার, ব্যক্তির পছন্দ-অপচ্ছন্দ, মানসিক অবস্থা, পরিবারের সংস্কৃতি, বিশ্বাস, খাদ্যজ্ঞান, পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা ইত্যাদি। ফলে দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্যকর খাবার নির্বাচন সহজ কাজ নয়। কোন খাবারে কোন পুষ্টিগুণ আছে সে বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান থাকা জরুরি। কিন্তু মুশকিল হলো মানুষের স্বাস্থ্যসচেতনতা এবং সুষম খাদ্য নির্বাচন একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে যায় না। পারিবারিক সংস্কৃতি, জিভের স্বাদ ও তৃপ্তি—এ  বিষয়গুলো এমনভাবে আকৃষ্ট করে যে খাওয়ার সময় পুষ্টিজ্ঞান সেখানে গৌণ হয়ে যায়।
আমাদের মোটামুটি একটা ধারণা আছে পুষ্টি কী এবং কোন কোন খাবার থেকে কী কী পুষ্টিগুণ পাওয়া যায়। পুষ্টি হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে গৃহীত খাদ্য শোষিত হয়ে শরীরে তাপ ও শক্তি উত্পন্ন করে, শরীরের বৃদ্ধি সাধন করে এবং শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এসবের ব্যাবহারিক দিক কী? সে কারণে ফলিতপুষ্টির জ্ঞানও থাকা আবশ্যক। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সঠিক খাদ্য নির্বাচন, নির্বাচিত খাবার সঠিক উপায়ে রান্নার জন্য প্রস্তুতকরণ, সঠিক উপায়ে রান্না করা এবং সঠিক উপায়ে খাবার গ্রহণ—এসবের যোগফলই হলো ফলিতপুষ্টি। কোন কোন খাবার থেকে তাপ ও শক্তি পাওয়া যায়? ভাত, রুটি, আলু, চিনি, তেল, মাখন, ঘি, মধু, বাদাম থেকে তাপ ও শক্তি পাওয়া যায়। আমিষজাতীয় খাবার যেমন—মাছ, মাংস, ডাল, দুধ, ডিম, মাছ, কলিজা শরীর বৃদ্ধি ও ক্ষয় পূরণ করে। ভিটামিন ও খনিজসমৃদ্ধ খাবার, যেমন—শাকসবজি, পাকা আম, পাকা পেঁপে, পাকা কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, আমলকী, আমড়া, লেবু, গাজর, মিষ্টিকুমড়া, দুধ, ডিম, কলিজা রোগ প্রতিরোধ করে।
ওপরের জ্ঞান এবং খাবারের তালিকা দেখে অনেকের মনে হতেই পারে যে আরে এ আর এমন কী? আমি তো এসব খাবার খেয়েই যাচ্ছি। কিন্তু একবার ভাবুন তো। সত্যিই কি আমি এসবই খাচ্ছি, নাকি কোনো খাবার বেশি খাচ্ছি, আবার কোনো খাবার একেবারেই খাচ্ছি না। এটিই জরুরি। সব কিছুই পরিমাণমতো খেতে হবে। খাবারের সময়ও নির্দিষ্ট হতে হবে। এ ক্ষেত্রে বয়স এবং নারী বা পুরুষ—এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, আপনি কি কিছুটা হলেও শারীরিক ক্রিয়াকর্ম (physical activies) করছেন? নাকি শুয়ে-বসে আরাম-আয়েশে দিন গুজরান করছেন।
আমাদের মাঝে যাঁরা রান্নাবান্নায় সব সময় সম্পৃক্ত থাকেন, তাঁদের আরো কিছুটা জ্ঞান থাকলে ভালো হয় বৈকি। যেমন—শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও খনিজ উপাদানসমৃদ্ধ খাবারের কোনো বিকল্প নেই। শাকে যে পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ থাকে তা দিয়েই আমাদের দিনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। শাকে ভিটামিন ধরে রাখার সর্বোত্তম উপায় হলো ভাপে বা প্রেসার কুকারে রান্না করা। ভাপে অন্য পুষ্টি উপাদানেরও (ক্যারোটিন, ‘বি’ ভিটামিন, ফাইটোকেমিক্যালস ইত্যাদি) অপচয় কম হয়। সবজি কাটার সময় আমরা কতটা যত্ন নেই? কাটতে হবে ধারালো বটি বা ছুরি দিয়ে। ভোঁতা ছুরি বা বটি দিয়ে কাটলে ভিটামিন  নষ্ট হয়। শাকসবজি কাটতে হবে বড় বড় টুকরা করে, এতে আলো ও বাতাসের সংস্পর্শে ভিটামিনের ক্ষয় কম হয়। ভিটামিন ‘সি’, ভিটামিন ‘বি’ ও খনিজ উপাদানের অপচয় রোধে সবজির খোসা ছাড়ানো ও টুকরা করার পর আবার ধোয়া যাবে না, পানিতে ভিজিয়ে রাখা যাবে না। খোসাসহ সবজি রান্না করলে পুষ্টি উপাদান বেশি মাত্রায় ধরে রাখা যায়। পুষ্টির উপাদান ধরে রাখতে রান্নার ঠিক আগ মুহূর্তে কাটতে হবে। ঢাকনা দেওয়া পাত্রে রান্না করা ভালো। এতে রান্না দ্রুত হয়, খাবার অক্সিজেনের সংস্পর্শে কম আসে বলে ভিটামিন  নষ্ট কম হয়। রান্নায় যতটা সম্ভব কম পানি ব্যবহার করতে হবে। দীর্ঘ সময় ও উচ্চতাপে রান্নায় শাকসবজির ভিটামিন নষ্ট হয়। সামান্য তেল দিয়ে শাকসবজি রান্না করলে ক্যারোটিন অক্ষুণ্ন থাকে। সেই সঙ্গে চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিনগুলোও সহজেই দেহে শোষিত হয়। শাকসবজি রান্নার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে খেতে হবে। কি খুব বেশি কঠিন মনে হচ্ছে? আমার মনে হয় একটু চেষ্টা করলেই পুষ্টি উপাদান রক্ষা করে রান্না করা সম্ভব।
পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশি মানুষের জন্য প্রতিদিন দুই হাজার ৪০০ কিলোক্যালরি খাবার গ্রহণের জন্য পরামর্শ প্রদান করেছেন। তবে মানুষের বয়স, ওজন এবং তিনি শারীরিক পরিশ্রম করেন কি না ইত্যাদি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে তিনি কি পরিমাণ কিলোক্যালরির খাবার গ্রহণ করবেন। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরে নেই—একজন মানুষের প্রতিদিন দুই হাজার ৪০০ কিলোক্যালরি খাবার গ্রহণ করতে হবে। তার খাবার গ্রহণের পরিকল্পনা হতে পারে নিম্নরূপ : [Food Composition Table for Bangladesh]
সকালের খাবার—আনুমানিক ৭০ গ্রামের দুটি আটার রুটি (২০০ কিলোক্যালরি), ২০০ গ্রামের এক বাটি মিশ্র সবজি (১০০ কিলোক্যালরি), ৬০ গ্রামের একটি ডিম (৭০ কিলোক্যালরি), ৫০ গ্রাম ওজনের একটি কলা (৫০ কিলোক্যালরি), চিনিসহ এক কাপ রং চা (২৯ কিলোক্যালরি)। সকাল ১১টার পর ৫০ গ্রাম ওজনের চীনাবাদাম (২৯৩ কিলোক্যালরি) খেতে পারেন। [মোট ৭৪২ কিলোক্যালরি]
দুপুরের খাবার—২০০ গ্রাম ওজনের এক বাটি ভাত (২০০ কিলোক্যালরি), ১০০ গ্রাম ওজনের দুই টুকরা মুরগির মাংস (১২৮ কিলোক্যালরি), ২০০ গ্রাম ওজনের এক বাটি শাক (১০০ কিলোক্যালরি), ২০০ গ্রামের এক বাটি মিশ্র সবজি (১০০ কিলোক্যালরি), ২০০ মিলি ওজনের এক বাটি ঘন ডাল (১৮০ কিলোক্যালরি) খাওয়া যেতে পারে। [মোট ৭০৮ কিলোক্যালরি]
বিকেলের নাশতা—২৫ গ্রাম ওজনের এক বাটি মুড়ি (৯০ কিলোক্যালরি), ৫০ গ্রাম ওজনের এক বাটি ছোলা (১৮০ কিলোক্যালরি), ১০০ গ্রাম ওজনের কয়েক টুকরা পেয়ারা (৬৩ কিলোক্যালরি), ৫০ গ্রাম ওজনের একটি কলা (৫০ কিলোক্যালরি), চিনিসহ এক কাপ রং চা (২৯ কিলোক্যালরি) পান করতে পারেন। [মোট ৪১২ কিলোক্যালরি]
রাতের খাবার—২০০ গ্রাম ওজনের এক বাটি ভাত (২০০ কিলোক্যালরি), ৮০ গ্রাম ওজনের এক টুকরা মাছ (১০০ কিলোক্যালরি), ২০০ গ্রামের এক বাটি মিশ্র সবজি (১০০ কিলোক্যালরি), ১৫০ মিলি ওজনের এক কাপ দুধ (১০০ কিলোক্যালরি) এবং ১১৫ গ্রাম ওজনের মৌসুমি ফল (৩৮ কিলোক্যালরি) খেতে পারেন। [মোট ৫৩৮ কিলোক্যালরি]
[উচ্চতা এবং ওজনের ভিত্তিতে নির্ণয় করা হয় Bodz Mass Index (BMI) এবং BMI-এর ওপর নির্ভর করা হয় একজন মানুষের কত কিলোক্যালরি খাবার দিনে গ্রহণ করবেন]
এতক্ষণ ধরে যে খাবারের কথা উল্লেখ করা হলো তার মধ্যে নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে অত্যন্ত লোভনীয় খাবার ফাস্ট ফুড নেই, নেই কোমলপানীয়! আরো মজার খাবার শিঙাড়া, পুরি, আলুর চপ, সমুচা, ডিমের চপ, বেগুনি, পেঁয়াজু, ডালপুরি কোথায়? আপনাদের জানা আছে কি, বিখ্যাত সব খাবার দোকানের ফ্রিজারে থাকে চিকেনের পিসগুলো হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রায়। এগুলো যখন ফুটন্ত তেলে ভাজা হয় তখন তাত্ক্ষণিক তাপমাত্রার হেরফের হয়, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। আর মজার সব খাবার যে তেলে ভাজা হয় সেই তেল বারবার উত্তপ্ত করা হয়। সে জন্যই খাবার এত মজার হয়। কিন্তু বিপদ অন্য জায়গায়। একই তেল বারবার ব্যবহার করলে উচ্চমাত্রায় এলডিহাইড তৈরি হয়, যা ক্যান্সার, হূদরোগ, আলঝিমাইর (Alzheimer), স্মৃতিভ্রংশ (Dementia) এবং পারকিনসন (Parkinson) রোগ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। এ ছাড়া একই তেল বারবার ব্যবহার করলে প্রোটিনের কার্যাবলি সম্পাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। একই উদ্ভিজ্জ তেল বারবার ব্যবহার করলে ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ট্রান্স ফ্যাট সম্পৃক্ত ফ্যাট থেকে বেশি ক্ষতিকর, কারণ এরা একদিকে যেমন দেহে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে ভালো কোলেস্টেরলের পরিমাণ হ্রাস করে। ট্রান্স ফ্যাট হূদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার এবং লিভারজনিত রোগগুলোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। একই উদ্ভিজ্জ তেল বারবার উত্তপ্ত করলে ফ্রি রেডিক্যাল অণুগুলো সৃষ্টি হয়, যা ভালো কোষগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তাদের কার্যাবলিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। ফ্রি রেডিক্যাল ক্যান্সার সৃষ্টির অন্যতম একটি উপাদান। এ ছাড়া হার্টে ব্লক তৈরিতে এই ফ্রি রেডিক্যালের ভূমিকা রয়েছে।
যখন খাদ্য, বিশেষ করে মাছ, মাংস উন্মুক্তভাবে জ্বলন্ত আগুনে রান্না করা হয়, তখন মাছ বা মাংসের কিছু অংশ আগুনে পুড়ালে পাইরোলাইসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পলিএরোমিক হাইড্রোকার্বন (PHA) তৈরি হয়। যদি মাছ বা মাংস উত্তপ্ত আগুনের সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শে না থাকে, তবে মাছ বা মাংস থেকে চর্বিগুলো জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে খাদ্যের ওপর  PHA-এর আবরণ তৈরি হয়। স্মোকিং ও গ্রিলিং প্রক্রিয়ায় উত্পন্ন খাদ্যে PHA সবচেয়ে বেশি তৈরি হয়। স্বাস্থ্যের ওপর PHA-এর স্বল্পমেয়াদি প্রভাবের কারণে চোখ ও ত্বক চুলকানো, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, প্রদাহের সৃষ্টি হতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হিসেবে ত্বক, ফুসফুস, মূত্রথলি এবং পৌষ্টিকনালিতে ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের ক্ষয়সাধন ইত্যাদি হতে পারে। আরো একটি বিষয় জানা থাকা দরকার। ঢাকার বাজারে বিক্রি হওয়া বেকারির পণ্যে ক্ষতিকর অসম্পৃক্ত চর্বির (টিএফএ-ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) পরিমাণ নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে প্রায় ১৯ গুণ বেশি। দৈবচয়নের ভিত্তিতে সংগৃহীত ১২ ধরনের বিস্কুট নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় ৫ থেকে ৩৯ শতাংশ পর্যান্ত টিএফএর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এই মাত্রা ২ শতাংশের কম রাখতে WHO সুপারিশ করেছে। [বিসিএসআইআরের কয়েকজন গবেষক এই গবেষণা করেন]
খাবার সুস্বাদু ও মচমচে করতে ডুবো তেলে অনেক খাবার ভাজা হয়। এ ছাড়া প্যাকেটজাত বিস্কুট, চানাচুর, চিপস, মার্জারিনে ব্যবহূত হয় ডালডা বা বনস্পতি ঘি। এই ডালডা বা বনস্পতি ঘিতে থাকে উচ্চমাত্রায় টিএফএ (এতে ২৫-৪৫ শতাংশ পর্যন্ত অসম্পৃক্ত চর্বি থাকে)। খাবার সংরক্ষণের সুবিধার্থে এবং বিভিন্ন ভাজাপোড়া ও বেকারি খাদ্যের স্বাদ, ঘ্রাণ এবং স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য এই ডালডা ব্যবহূত হয়। এই চর্বি শরীরের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা আশঙ্কাজনক মাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে হূদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং মোটা হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। প্রতিবছর বাংলাদেশে দুই লাখ মানুষ হূদরোগে মারা যায়। সব শেষে যে কথাটি বলব, তা হলো খাবার গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে এ কথা সত্য; কিন্তু কী খাব? জেনেশুনে এবং বুঝে খাব। জিবকে সংবরণ করব। জিবকে সংবরণ করতে পারলে সুষম খাবার যেমন খেতে পারা যাবে, তেমনি জিবের যখন-তখন বা যেখানে-সেখানে অযাচিত ব্যবহারের কারণে জীবনের অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকেও মুক্তি মিলবে, নয় কি? ভেবে দেখুন।

 লেখক : পরিচালক, বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট 

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর