চোখে ঘুম নেই কৃষকের, হাঁটুপানিতে ডুবলো পানবরজ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ঠিক কত বছর পর বর্ষার এমন রূপ দেখা গেলো তা স্মরণ করে বলতে পারছেন না কেউই। তবে এ কথা ঠিক যে, এবারের বর্ষা যেই ক্ষতচিহ্ন রেখে যাবে তা ভুলতে অনেক বছর লাগবে! মৌসুমের শুরু থেকে প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে রাজশাহীতে।

অবস্থার উন্নতি না হলে পানবরজের মড়ক বাড়বে। এতে একদিকে স্থানীয় পানচাষি ও ব্যবসায়ী যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তেমন সারাদেশের পানের বাজারেও ধস নামবে। সরবরাহ কমতে থাকলে পানের দাম আকাশচুম্বি হবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বর্ষার বারিধারায় এরই মধ্যে রাজশাহীর পানের বরজগুলোতে হাঁটুপানি জমেছে। ফলে পান গাছের গোড়া পচন ধরেছে। এতে পানের পাতাও ঝরে পড়ছে। এই ঝরা পান স্থানীয় বাজারে নিয়েও বিক্রি করতে পারছেন না কৃষকরা। কারণ করোনা পরিস্থিতির কারণে রাস্তার পাশে থাকা খিলি পানের দোকানে আরা বেচাকেনা নেই। মুখে মাস্ক দিয়ে বাইরে বের হওয়ার কারণে অনেকেই বাইরে পান খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। আর করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে অনেক পানের দোকান এরই মধ্যে বন্ধও হয়ে গেছে। তাই স্থানীয় বাজারে পান নিয়েও বিক্রি করা যাচ্ছে না।

বলতে গেলে বৃষ্টি, বন্যা ও করোনা; এসব নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছেন পানচাষিরা। পানবরজ নিয়ে এরই মধ্যে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।

পানচাষিদের ভাষ্যমতে এমন দুর্দিন এর আগে কখনও দেখেননি তারা। এবার পান চাষে অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

অথচ মিষ্টিপানের জন্য প্রসিদ্ধ রাজশাহী অঞ্চলে এবারও পানের উৎপাদন ভালো ছিল। কিন্তু শীতের পরপরই দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। এর পরবর্তী সময়ে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে বর্ষা। নদ-নদীর পানি বাড়ায় সর্বত্র বন্যার প্রকোপও বেড়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেক পানবরজে পানি ঢুকে গেছে। এতে দেখা দিয়েছে মড়ক। এই অবস্থায় নিচু এলাকায় থাকা পানবরজ থেকে দ্রুত পানি বের করে দেওয়ার পরামর্শ ছাড়া আর অন্যকোনো পরামর্শই আপাতত: দিতে পারছে না স্থানীয় কৃষি কৃষিবিভাগ।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী জেলায় চার হাজার ৩১১ হেক্টর জমিতে পানবরজ আছে। এসবই জেলার মোহনপুর, বাগমারা ও দুর্গাপুর উপজেলায়। এবছর জেলায় পান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৮ হাজার ৯৭৬ মেট্রিক টন। গড়ে প্রতি বিড়া পানের দাম ৪০ টাকা ধরে এক টন পানের দাম আসে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। সেই হিসাবে রাজশাহীতে প্রতি বছরে গড়ে এক হাজার ১শ কোটি টাকার পান বেচাকেনা হয়। সম্ভাবনাময়ী এই কৃষিপণ্যের চাষের সঙ্গে বর্তমানে রাজশাহীর প্রায় ৭০ হাজার কৃষকের জীবন ও জীবিকা জড়িয়ে আছে। এ অবস্থায় তারা চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন!

রাজশাহীর তিন উপজেলার পানচাষিরা বলছেন, পানচাষের জন্য বৃষ্টিপাত অবশ্যই ভালো। এতে পানবরজে বাড়তি করে সেচ দিতে হয় না। তাদের সেচের খরচটাও সাশ্রয় হয়। কিন্তু এবার যেন অন্যরূপেই হাজির হয়েছে বর্ষা। শুরু থেকেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। অতি বর্ষণে তাই লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হচ্ছে। টানা বৃষ্টিতে একদিকে বাজারে পানের দাম কমছে আরেক দিকে পানবরজে পানি ঢুকে গোড়ায় পচন ধরিয়েছে।

মোহনপুরে উপজেলার মৌগাছি গ্রামের পানচাষি শুকুর আলী বলেন, এবার বর্ষার অতিবর্ষণ তাদের জন্য দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছে। করোনার মধ্যে বৃষ্টি ও বন্যা নিয়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ৬৪টি পানে এক বিড়া হয়। বাজারে বিক্রির জন্য সাধারণত ৩২ বিড়া করে পান বাঁধা হয়। আর এখন ৩২ বিড়া পান বিক্রি হচ্ছে, এক হাজার থেকে এক হাজার ২শ টাকায়। অথচ গেলো বছর বর্ষায়ও সমপরিমাণ পান দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। তবে কম দামে পান বিক্রি হলেও স্থানীয় চাষিদের পানবরজটি টিকে ছিল। কিন্তু অতিবর্ষণে তাও শেষ হচ্ছে।

বাগমারা উপজেলার মোহনগঞ্জ এলাকার পানচাষি মহিবুল্লাহ সরকার বলেন, একটি  আদর্শ পানবরজ করতে কমপক্ষে এক বিঘা জমি প্রয়োজন। আর এক বিঘা জমির ওপর পানবরজ করতে বছরে প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়। এই পান উৎপাদনের পর পাইকারি হিসেবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহর জেলায় পাঠানো হয়। মিষ্টিপানের খ্যাতি থাকায় এক নামেই রাজশাহীর পান বিক্রি হয়। এতে এক মৌসুমে বিঘায় প্রায় পাঁচ লাখ টাকার ব্যবসা হয়। অর্থাৎ লাভের অংক প্রায় দ্বিগুণ। এজন্য কৃষকরা এখনও পানবরজগুলো ধরে রেখেছেন। তবে এবার যা অবস্থা তা দেখে মনে হচ্ছে লাভ তো দূরের কথা তার মত অনেকেই পুঁজি হারাবেন।

জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামসুল হক বলেন, রাজশাহীর পান মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেত। করোনার জন্য সব বন্ধ। আর করোনার সংক্রমণরোধে অধিকাংশ পান দোকান বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় পানের খুচরা কেনাবেচা কমেছে।

আর খুচরা ব্যবসা কমায় পাইকারি কেনাবেচাও ধস নেমেছে। এর ওপর অতিবর্ষণে বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানি ঢুকেছে। এতে অনেক পানবরজে পচন দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব সরাসরি পড়েছে পানচাষি ও ব্যবসায়ীদের ওপর।

তাই কৃষিবিভাগ থেকে পানবরজের পানি দ্রুত বের করে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। অতিবৃষ্টি বন্ধ না হলে পানি নামবে না। আর পানি না নামলে পানবরজের পচন বন্ধ হবে না বলেও মন্তব্য করেন ওই কৃষি কর্মকর্তা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর