বাংলাদেশ ব্যাংকের মত চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত জানতে চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ নেয়ার খুঁটিনাটি বিষয় ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করে দেখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আলোচনা বা অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে কোনো সমীক্ষা করা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অর্থ জমা হওয়া ও এ থেকে খরচ করার একটি পদ্ধতি রয়েছে। সে অনুযায়ী এখন যেমন অর্থ জমা হচ্ছে, তেমনি প্রয়োজন অনুযায়ী খরচও হচ্ছে। এর বাইরে গিয়ে নতুন কিছু করতে হলে এর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও সমীক্ষা করা দরকার। সেটি একটু দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।

৬ জুলাই অনুষ্ঠেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ নেয়ার প্রস্তাব দেন। বাংলাদেশ ব্যাংককে তিনি বিষয়টির প্রভাব ও সম্ভাবনার খুঁটিনাটি যাচাই-বাছাই করে দেখতে বলেছেন। ওই দিন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘এটা প্রধানমন্ত্রীর কোনো অর্ডার নয়। তিনি একটা আইডিয়া তুলে ধরেছেন। এটি আলোচনা-পর্যালোচনা এবং বিচার-বিশ্লেষণ শেষে সিদ্ধান্তে আসা যাবে।’

একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ‘আমরা বিদেশ থেকে ডলারে ঋণ নিই। আমাদের যেহেতু ডলার আছে, সেহেতু আমরা নিজেদের ডলার থেকে নিজেরাই ঋণ নিতে পারি। বাংলাদেশ ব্যাংক জনগণের পক্ষে এ রিজার্ভ সংরক্ষণ করে।’

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিশেষ করে বেশি রিজার্ভ থাকলে টাকার মান স্থিতিশীল থাকে। মুদ্রার অবমূল্যায়নজনিত মূল্যস্ফীতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ে। তারা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন। বিদেশি ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে নিরাপদে রফতানি বাণিজ্য কার্যক্রম চালাতে পারে। বিদেশ থেকে বাণিজ্যিক ঋণ পেতেও সুবিধা হয়।

রিজার্ভ কম থাকলে বিদেশি ব্যাংকগুলো তৃতীয় পক্ষের গ্যারান্টি ছাড়া সরাসরি কোনো এলসি নিতে চায় না। তৃতীয় পক্ষের গ্যারান্টি নিতে হলে কমিশন দিতে হয়। এ হার শতকরা ১০ পয়সা থেকে ৪০ পয়সা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ফলে এলসির খরচ বাড়ে। এতে বেড়ে যায় ব্যবসা খরচ। যা বিদেশের বাজারে নেতিবাচক বার্তা দেয়। হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর সোনালী ব্যাংকের এলসি সরাসরি বিদেশি ব্যাংকগুলো নিচ্ছিল না। তৃতীয় পক্ষের গ্যারান্টি দিতে হতো। একই অবস্থা হয়েছে বেসিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা এলে সেগুলো রিজার্ভে যুক্ত হয়। ব্যাংকগুলোর কাছে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা এলে তারা প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেদের কাছে যেমন রাখতে পারে, তেমনি খরচও করতে পারে। এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা রয়েছে। প্রতিটি ব্যাংকের জন্য ওপেন পজিশন লিমিট (দিনের শুরুতে কি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিজেদের কাছে রাখতে পারবে) দেয়া আছে। সাধারণত ব্যাংক ভেদে এ হার ৮ থেকে ১৫ শতাংশ। প্রতিদিনকার লেনদেন শেষে এর বেশি বৈদেশিক মুদ্রা কোনো ব্যাংকের কাছে থাকলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করতে হয়। এগুলো রিজার্ভে জমা হয়। এভাবে রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রা জমা হয়।

আবার প্রয়োজন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখান থেকে খরচ করে। বাজারের ডলারের সংকট থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে বাজারে জোগান বাড়ায়। সেই ডলারে ব্যাংকগুলো এলসির দেনাসহ তাদের বিভিন্ন দেনা শোধ করে। সরকারের পক্ষে বিভিন্ন বৈদেশিক দেনাসহ ঋণের কিস্তি কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে পরিশোধ করে।

এছাড়া বাজারের ডলারের চাহিদার চাপ কমাতে এবং কম খরচে উদ্যোক্তাদের জোগান দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা ধরনের তহবিল গঠন করে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে চারটি তহবিল গঠণ করেছে। এগুলো হচ্ছে ২০০ কোটি ডলার তহবিল, ২০০ কোটি ইউরো তহবিল, ৫০০ কোটি ডলারের রফতানি উন্নয়ন তহবিল এবং ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন অ্যান্ড ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (আইপিএফএফ) ৪২ কোটি ডলারের একটি তহবিল। প্রথম তিনটি তহবিলের সব বৈদেশিক মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জোগান দেয়া হয়েছে। শেষ তহবিলটির ৬ কোটি ডলার রিজার্ভ থেকে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাকি ৩৬ কোটি ডলার বিশ্বব্যাংক দিয়েছে।

রিজার্ভ থেকে সরাসরি ঋণ দেয়ার কোনো পদ্ধতি বর্তমানে চালু নেই। কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হলে গ্রাহক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে এলসি খুলবে। ব্যাংকে যথেষ্ট ডলার না থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে এ ডলারের জোগান দেবে। এভাবেই রিজার্ভের অর্থ খরচ করা হয়।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৩ হাজার ৬৬৩ কোটি ডলার। বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় হয় ৪৭০ কোটি ডলার। এ হিসাবে ওই রজিার্ভ দিয়ে প্রায় ৮ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) রিজার্ভের নিরাপদ মান অনুযায়ী একটি দেশের সাধারণত ৩ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। এ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ বেশ স্বস্তিদায়ক। তবে করোনার কারণে এ রিজার্ভ কতটুকু ধরে রাখা যাবে এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। কেননা, করোনার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে গেছে ভয়ানকভাবে। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে যে কোনো সময় রিজার্ভে চাপে পড়তে পারে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের অর্থ ব্যবহারে বেশ সতর্ক রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর