কভিড-১৯ মহামারি ও কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাপনা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বাংলাদেশের সার্বিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং কৃষি উপকরণে ব্যাপক ভর্তুকি ও বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়ার ফলে দেশ ২০১৩ সালের মধ্যেই দানাজাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। অন্য  ফসলসহ শাকসবজি, দুধ, ডিম, পোল্ট্রি ও মৎস্য উৎপাদনেও ধারাবাহিক ক্রমবর্ধমান চিত্র পরিলক্ষিত হয়। দেশের সার্বিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাপনার এমন সুসময়েই বিশ্বে আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভাব ঘটল কভিড-১৯ নামক করোনাভাইরাস মহামারি। করোনা পরিস্থিতিতে বর্তমান কৃষি উত্পাদন ধারা অব্যাহত রাখতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকেই কৃষি সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছেন যে ‘খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আবাদি কোনো জমি ফেলে না রেখে প্রতি ইঞ্চি জমিতে ফসল ফলাতে হবে।’ জরুরি সহায়তা হিসেবে ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বাবদ ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। এর আওতায় সারা দেশে ধান কাটা সহজতর করতে এক হাজার ৩২২টি কম্বাইন হারভেস্টর ও ৯০৮টি রিপার, ২২টি রাইস ট্রান্সপ্লানটারসহ বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ৭৫ শতাংশ ভর্তুকিতে হাওর অঞ্চলে কৃষকদের ফসল কাটার যন্ত্রাংশ দেওয়া হয়েছে। বিএডিসিকে কৃষকদের বীজ, চারা, সেচ ইত্যাদি সরবরাহ করার জন্য ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চলতি আউশ মৌসুমে বিএডিসির সেচ চার্জের হার ৫০ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে এবং ছয় হাজার ৫০০ মেট্রিক টন হাইব্রিড ও উফশি জাতের বীজ এরই মধ্যে কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনার বাইরেও কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষি পুনর্বাসন, ফসলের নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য প্রদর্শনী স্থাপনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করছে।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক (বিশ্ব ব্যাংক) আউটলুকের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী কভিড-১৯-এর প্রভাবে বিশ্বে ২০২০ সালে প্রায় পাঁচ কোটি লোক চরম দারিদ্র্যসীমায় অবস্থানকারীদের দলভুক্ত হবে। এর মধ্যে প্রায় ১.৬ কোটি (১৫.৬ মিলিয়ন) লোক দক্ষিণ এশিয়া থেকে অন্তর্ভুক্ত হবে। অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ছাড়াও এই মহামারি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশাজীবী মানুষের রুটিরুজির ওপর চরম আঘাত হেনেছে। এ দেশেও লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন জীবন যাপন করছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং উৎপাদন ব্যবস্থাকে আবার সচল করতে এরই মধ্যে এক লাখ এক হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এ বরাদ্দ দেশের মোট জিডিপির ৩.৬ শতাংশ। রপ্তানিমুখী শিল্প, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটিরশিল্প, কৃষি, মত্স্যচাষ, হাঁস-মুরগি, পশুপালন খাতসহ ১৮টি অর্থনৈতিক খাতকে এসব প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় আনা হয়েছে। কর্মহীন অসহায় মানুষের জন্য খাদ্য ও নগদ অর্থ সহায়তা বাবদ সরকার এরই মধ্যে এক লাখ ৬২ হাজার ৮৬৭ মেট্রিক টন চাল এবং ৯১ কোটি ৪৭ লাখ ৭২ হাজার টাকা বরাদ্দ প্রদান করেছে।

কৃষি ও পল্লীঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচিতে উল্লিখিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বর্তমান কৃষির উত্পাদন ধারা অব্যাহত রাখতে ৪ শতাংশ হারে কৃষিঋণ প্রদানের লক্ষ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা হিসেবে বরাদ্দ প্রদান করেন। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে সার্বিক কৃষি খাতের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার কৃষিঋণের সুদহার ৯ শতাংশের স্থলে ৪ শতাংশ পুনর্নির্ধারণ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি ও পল্লীঋণ নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর মোট লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ৬০ শতাংশ শস্য ও ফসল খাতে ঋণ বিতরণের নির্দেশনা রয়েছে। অন্যদিকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের প্রতিটিতে লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ১০ শতাংশ ঋণ বিতরণের নির্দেশনা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলায় কৃষকের অনুকূলে প্রণোদনা সুবিধারই আওতায় শস্য ও ফসল খাতে ৪ শতাংশ রেয়াতি সুদহারি কৃষিঋণ প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়। যদিও এর আগে আমদানি বিকল্প ফসলগুলো, যেমন—ডাল, তৈলবীজ, মসলাজাতীয় ফসল ও ভুট্টা শুধু দুগ্ধ উৎপাদন ও কৃত্রিম প্রজনন খাতে সুদহার সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ নির্ধারিত ছিল। এবার নতুন যুক্ত হলো ধান, গমসহ সব দানাশস্য, অর্থকরী ফসল, শাকসবজি ও কন্দাল ফসল। অন্যদিকে শুধু দুগ্ধ উত্পাদন ও কৃত্রিম প্রজনন খাতে সুদহার সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ নির্ধারিত আছে। কিন্তু মত্স্য, পোল্ট্রি ও গবাদি পশু উত্পাদনকারী কৃষকদের এই সুবিধার আওতায় আনা হয়নি।

কভিড-১৯ মহামারি পূর্ববর্তী সময়ে এ দেশের কৃষি উত্পাদন ব্যবস্থাপনা এমন একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছে ছিল যে খাদ্য সংকট নামক পরিস্থিতি সৃষ্টির বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য ছিল না। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি সংকট মোকাবেলার জন্য সার্বিক কৃষির উত্পাদন ব্যবস্থপনাকে সুচারুভাবে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। প্রায় ১.৫ কোটি কৃষি পরিবারের খামার (farm) ও অখামার (bon-farm) কার্যক্রমের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করে সার্বিক কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতে হবে।

ক্রমহ্রাসমান কৃষিজমির আয়তন যেহেতু উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি সম্ভব নয়, সেহেতু প্রতি ইঞ্চি আবাদি জমি চাষের আওতায় আনার নির্দেশনা বাস্তবায়নে  কৃষিমন্ত্রী নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই প্রথমেই দেশে বিদ্যমান ২.২৩ লাখ হেক্টর আবাদযোগ্য পতিত জমিতে ফসল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি দেশের নিট ফসলি জমির প্রায় ২৮ শতাংশ একফসলি জমি, যাকে দুই এবং সম্ভব হলে তিনফসলি জমিতে রূপান্তরের উদ্যোগ নিতে হবে। ফসলের নিবিড়তাকে বাড়াতে হবে কমপক্ষে ২০০ শতাংশ, যা বর্তমানে ১৯৪ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে সমন্বিত খামার পদ্ধতি গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মসূচিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করতে হবে। ফলন ফারাক (yield gap) কমানোর লক্ষ্যে ডিএইর অধীনে চুক্তিবদ্ধ কৃষকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে ফসলের উন্নত জাত ও আধুনিক প্রযুক্তির মাঠ প্রদর্শনী স্থাপন করতে হবে। বৈদেশিক বাজার বিবেচনায় স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে উচ্চমূল্য ফসল উত্পাদনে গুরুত্ব দিতে হবে। আমদানিনির্ভর নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য, যেমন—গম, ডাল, তেল, মসলাজাতীয় ফসলের উত্পাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। শহর ও উপশহরের জনগণকে ছাদকৃষিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

বাণিজ্যিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় যান্ত্রিকীকরণ কর্মসূচির সফল প্রয়োগ সম্ভব হলে কৃষকের একক প্রতি উত্পাদন খরচ হ্রাস পাবে। গবেষণায় দেখা যায়, যেকোনো ফসলের মোট উত্পাদন খরচের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ খরচ হয় শ্রমিক খাতে। তাই চলমান কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কর্মসূচিতে ট্রান্সপ্লান্টার, কম্বাইন হারভেস্টর ও রিপারের ব্যবহার বৃদ্ধির কর্মসূচিকে দ্রুত দেশব্যাপী সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে। ফলস্বরূপ ফসলের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাবে এবং কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে বেশি লাভবান হবে। শুধু এই করোনাকালেই নয়, পরবর্তী বছরগুলোতেও সব শস্য ও ফসল উৎপাদনে কৃষিঋণের সুদ হার সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ করা উচিত। মত্স্য চাষ ও গবাদি পশু পালনে (বিশেষ করে গরু মোটাতাজাকরণ) বর্তমান ৯ শতাংশ সুদহার হ্রাস করে ৪ শতাংশ পুনর্নির্ধারণ করে সমতা আনয়ন অপরিহার্য। এতে করে দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।

উল্লেখ্য, বেশির ভাগ ভোগ্যপণ্য আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। কাজ হারানো গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে অখামার কার্যক্রমের পরিসর বৃদ্ধির সহায়ক কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন আবশ্যক। আর এ সব কিছুর জন্য প্রয়োজন কৃষির সব দপ্তর/অধিদপ্তর/বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ গৃহীত কার্যক্রমের সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন। বিশেষ করে কৃষি গবেষণা ও কৃষি সম্প্রারণের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কার্যকর সমন্বয়ের বিষয়টি সবার আগে প্রাধান্য দিতে হবে। তবেই সরকারের পক্ষে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সহজতর হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর