ইস্তাম্বুল বিজয়ীদের কাফেলায় মেন্দারিস, এরদোগান

হাওর বার্তা ডেস্কঃ তুরস্কের প্রাচীন নগরী ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক আয়া সোফিয়া জাদুঘরকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরে আইনত আর কোনো বাধা নেই বলে গত ১০ জুলাই রায় জানিয়েছেন দেশটির একটি আদালত।

রায়ের পর তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগান এটিকে মসজিদ বানানোর নির্বাহী আদেশে সই করে ঘোষণা দিয়েছেন যে, এখন থেকে আয়া সোফিয়া ‘দিয়ানাত’ তথা তুর্কি ধর্মীয় বিষয়ক দফতরের সম্পদ।

এরপর নতুনপ্রাণ মসজিদটিতে প্রায় শতাব্দীকাল পরে ফের আজান দেয়া হয়েছে।

প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আয়া সোফিয়ার ইতিহাস আজ অবধি বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণভাবে আবর্তিত হয়ে আসছে।

৩৬০ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম খ্রিস্টান সম্রাট কনস্টান্টিনোপল। বর্তমান কাঠামো তৈরি করেন সম্রাট জাস্টিনিয়ান।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১২০৪ সাল পর্যন্ত আয়া সোফিয়া ছিল ইস্টার্ন অর্থডক্স ক্যাথিড্রাল। ১২০৪ থেকে ১২৬১ সাল পর্যন্ত রোমান ক্যাথলিক চার্চ, ১২৬১তে এটি আবার ইস্টার্ন অর্থডক্স ক্যাথিড্রালে ফিরে আসে এবং ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত অর্থডক্স গির্জা হিসেবেই বহাল ছিল আয়া সোফিয়া।

অতঃপর ঘটনাবহুল ঐতিহাসিক এক যুদ্ধে ইস্তাম্বুল জয়ের সময় এটিও জয় করেন উসমানি খলিফা সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ। এরপরই এটিকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়।

উসমানি শাসনামলে আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের বিষয়ে বিধর্মীদের সঙ্গে অবচেতন কিছু মুসলমানও এই বলে আপত্তি করেন যে, গির্জা কেন মসজিদে রূপান্তরিত হল?

এই প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর হল, যুদ্ধে বিজিত অন্য যে কোনো ধর্মীয় উপাসনালয় মসজিদ বানানো ইসলামী আইনে বৈধ, পক্ষান্তরে সন্ধির মাধ্যমে যদি এরকম কোনো স্থাপনা মুসলিম শাসকের হস্তগত হয় তাহলে সেটিকে মসজিদে রূপ দেয়ার বৈধতা ইসলামী শরীয়ত প্রদান করেনি।

সুতরাং আয়া সোফিয়া তরবারির যুদ্ধে মুসলমানরা এর মালিক হয়েছে- এরই পরিপ্রেক্ষিতে এটিতে সম্পূর্ণই তাদের অধিকার- এখানে এ সব প্রশ্ন অবান্তর।

ঐতিহাসিক সূত্রের বরাতে আলজাজিরা জানায়, সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ ইস্তাম্বুল জয় করার পর যাজকদের কাছ থেকে আয়া সোফিয়া বিক্রি করার আবেদন জানান এবং যাজকরা রাজী হলে নিজের টাকায় গির্জাটি ক্রয় করেন।

তিনি বিজয়ী হিসেবে গির্জা ছিনিয়ে নিতে পারতেন, রাষ্ট্রীয় টাকায় কিনতে পারতেন, কিন্তু সেসব না করে চুক্তিনামা করে নিজের টাকায় গির্জাটি ক্রয় করে নেন। এখনও সেই ঐতিহাসিক চুক্তিনামা সংরক্ষিত আছে।

এ জন্য নির্দ্বিধায় বলা যায়, আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করতে ইসলামী আইন ও রাষ্ট্রীয় আইনে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।

কিন্তু পরিতাপের ব্যাপার হল, ১৯৩৪ সালে ইহুদি খ্রিস্টানদের বহুমুখী ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে খেলাফতের যখন পতন হয়, তখন ‘কথিত আধুনিক তুরস্কের রূপকার’ মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক (পাশা) ইউরোপের অন্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তালমিলাতে ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি ও নিদর্শনসমূহকে তুরস্কের জন্য বড় অন্তরায় মনে করেন এবং তাকে ক্ষমতাপ্রদানকারী ইউরোপীয় প্রভুদের সন্তুষ্ট করতে আয়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপ দেন।

শুধু তাই নয়; শাসক নিযুক্ত হওয়ার পরে প্রকাশ্যে কুরআন পাঠ, আরবিতে আজান দেয়া এবং অসংখ্য মসজিদ তালাবদ্ধ করাসহ ইসলামের আরও একাধিক মৌলিক নির্দেশনাবলীর ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করে তার সরকার। এভাবেই বিশ্বের সবশেষ ইসলামী খেলাফতের কেন্দ্রকে একটি নব্য সেক্যুলার রাষ্ট্রে পরিণত করেন কামাল পাশা।

এ সময় তুর্কি জনগণের বৃহৎ একটি অংশ ইসলামী ভাবাপন্ন হলেও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা কোনঠাসা হয়েছিল।

তারা একজন যোগ্য ইসলামপন্থী নেতার অপেক্ষা করতে করতে ১৯৫০ সালে ক্ষমতায় আসীন হন আদনান মেন্দারিস। মেন্দারিস ঐতিহ্যবাহী জীবন পদ্ধতি এবং ইসলাম চর্চার প্রতি সহনশীল ছিলেন।

১৯৫০ সালের নির্বাচনের সময় তিনি আরবি ভাষায় আজান দেয়ার অনুমতি প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। তা ছাড়া ইতিপূর্বে বন্ধ করা কয়েক হাজার মসজিদ পুনরায় চালু করেন তিনি। সময় বিবেচনায় তার এ সব কাজ ছিল অত্যন্ত দুঃসাহসিক!

পরপর তিনবার ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও যথেষ্ট তৎপর ছিলেন তিনি। তার অর্থনৈতিক নীতির কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে তিনি খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিলেন।

কিন্তু শহীদ আদনান মেন্দারিস তার এই কল্যাণযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারেননি, যখনই তার মাধ্যমে তুর্কিরা নতুন সূর্যোদয়ের স্বপ্ন দেখছিল, তখনই তার বিরোধীরা ১৯৬০ সালের ২৭ মে সামরিক অভ্যুত্থানে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং দলের অন্য নেতাদের সঙ্গে তাকেও গ্রেফতার করা হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তার ইসলামপ্রিয়তা মেনে নিতে পারেনি।

উপরোক্ত বিষয়ে দোষারোপ করে প্রতিপক্ষ ১৯৬১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ইমরালি দ্বীপে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।

অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়া স্বপ্ন তুর্কিদের অন্তর থেকে হারিয়ে যায়নি। তারা আবার অপেক্ষা করতে থাকেন আরেকজন স্বপ্ন পুরুষের- যিনি শহীদ মেন্দারিসের অবশিষ্ট কাজের পূর্ণতা দিবেন।

এরইমধ্যে তুরস্কের ক্ষমতা গ্রহণ করেন বর্তমান বিশ্বের তুমুল জনপ্রিয় মুসলিম নেতা রিসেপ তায়্যিপ এরদোগান। তিনিও মেন্দারিসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কাজ করেছেন- এরমধ্যে সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ‘আয়া সোফিয়া ইস্যু’।

তুর্কিরা দীর্ঘদিন যাবৎ দাবি জানিয়ে আসছেন, এটিকে তার পুরনো ও আসল পরিচয় মসজিদে ফিরিয়ে নেয়ার। এরদোগান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং আদালতের রায়ের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করেছেন।

আগামী ২০২৩ সাল উসমানী খেলাফত শেষ হওয়ার এক শতাব্দী পূর্ণ হবে। কয়েক বছর আগে তিনি বছরটিকে তুর্কি যুবকদের জন্য চমক হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমরা সবাই অপেক্ষা করছি, তিনি মুসলিম উম্মাহর জন্য কি উপহার নিয়ে আসেন ২৩ সালে?

ইস্তাম্বুলের বিজয়রথ শুরু হয়েছিল হজরত মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.)-এর হাত ধরে এবং মহান আল্লাহ এর চূড়ান্ত বিজয় দান করেছিলেন সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহের হাতে।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভবিষ্যৎবাণী, ‘লাতাফতাহুন্নাল কুসতুনতিনিয়াতা, ফালা নে’মাল আমীরূ আমীরূহা ওয়ালানে’মাল জাইশু জালিকাল জাইশু।’

অর্থাৎ নিশ্চিতরূপে তোমরা কুসতুনতিনিয়া জয় করবে। সুতরাং তার (বিজয়কারী) সেনাপতি কতই না উত্তম হবে এবং তার জয় লাভকারী সৈন্যরাও কতই না উত্তম হবে! (মুসনাদে আহমদ)।

ওলামায়ে কেরাম একমত যে, উপরোক্ত হাদিস শরিফে সম্মোধিত মহামানবগণ হলেন সেনাপতি আল ফাতিহ এবং তার সৈন্যরা- যারা ইস্তাম্বুলের আকাশে ইসলামী পতাকা উঁচুতে তুলে ধরেছেন।

কিন্তু এর পরে কালপরিক্রমায় সেই ইস্তাম্বুলে আবার শেয়ালের থাবা পড়েছে- সেই থাবা প্রতিহতের প্রচেষ্টাকারী মেন্দারিস, এরদোগান ও তাদের সহযোগীরা জান্নাতে ইস্তাম্বুল বিজয়ী সেনাপতির কাফেলায় শামিল হোন- এই দোয়া করি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর