জীবনের গল্প বাকি রেখেই বিদায়

হাওর বার্তা ডেস্কঃ চার দশক আগে ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ গেয়ে দেশজুড়ে মানুষের কাছে পৌঁছে  গিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। ৪১ বছর ধরে বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠান ও দেশ-বিদেশের মঞ্চে গেয়ে বেড়িয়েছেন ‘প্রাণসজনী’ ছবির এ গান। অবশেষে দয়াল তাঁর আরজি শুনেছেন, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল তাঁহারে’। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে রাজশাহীতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তির এই গায়ক। খবরটি কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন সংগীত পরিচালক ফরিদ আহমেদ, ইথুন বাবুসহ একাধিক সূত্র। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। তাঁর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।

এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে দেশজুড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রিয় গায়কের জন্য শোকগাথা লিখে পোস্ট দিচ্ছে। সংগীতাঙ্গনে এন্ড্রু কিশোরের দীর্ঘদিনের সহকর্মী সাবিনা ইয়াসমিন কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘খবরটা শোনার পর আমার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না। এন্ড্রু কিশোরের মতো শিল্পী আবার কবে আসবে, আদৌ আসবে কি না, আমি সন্দিহান।’

‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর এই সত্যটা জেনে গিয়েছিলেন গণমানুষের গায়ক। সিঙ্গাপুরে ৯ মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। একটা সময় যখন চিকিৎসকরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখন হুইলচেয়ারে বসে সজল চোখে শেষবার গানটি গেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। গানটি গাওয়ার সময় তাঁর চোখের জলই বলে দেয়, জীবনের গল্পে আরো কিছু পৃষ্ঠা জুড়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। বাধা হয়ে দাঁড়াল মারণব্যাধি ক্যান্সার। সেই অজানা গল্পগুলো অসমাপ্ত রেখেই দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে সময়ের আগেই রওনা হয়েছেন অসীমের উদ্দেশে।

১১ জুন এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সযোগে দেশে ফিরেছিলেন এন্ড্রু কিশোর। উঠেছেন রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাথান এলাকায় বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের বাসায়। বোনজামাই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। অবশ্য সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরার আগেই ‘শেষ কথা’ বলে দিয়েছেন চিকিৎসকরা, এক মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছর বাঁচবেন এই শিল্পী। তখনই এন্ড্রু কিশোর সিদ্ধান্ত নেন নিজের জন্মশহরে ফিরে আসার। স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রুকে বলেছেন, নিজের দেশে গিয়েই মরবেন। যাওয়ার আগে সহধর্মিণীকে বলে যান, মায়ের কবরের পাশেই যেন তাঁকে সমাহিত করা হয়।

গত বছর ৯ সেপ্টেম্বরে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশ ছেড়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। শরীরে নানা ধরনের জটিলতা নিয়ে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় গিয়েছিলেন সিঙ্গাপুর। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৮ সেপ্টেম্বরে জানা যায়, তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে নন-হজকিন লিম্ফোমা। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক লিম সুন থাইয়ের অধীনে তাঁর চিকিৎসা চলে। বিভিন্ন ধাপে টানা ২০টিরও বেশি কেমোথেরাপি দিতে হয়েছে তাঁর শরীরে। সুস্থও হয়ে উঠেছিলেন প্রায়। চলতি বছরের এপ্রিলে চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, দেশে ফিরে যেতে পারবেন এন্ড্রু কিশোর। একদিকে বিশ্বব্যাপী করোনার প্রকোপ, অন্যদিকে শারীরিকভাবে ভীষণ দুর্বল বোধ করছিলেন শিল্পী। তাই দেশে ফেরার সাহস পাচ্ছিলেন না। ২ জুন পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোনো ওষুধই আর কাজ করছিল না শরীরে। পিইটি স্ক্যান রিপোর্টে দেখা গেল লিম্ফোমা ভাইরাস ডান দিকের লিভার ও স্পাইনালে ছড়িয়ে গেছে। রণে ভঙ্গ দিয়ে চিকিৎসকরা জানিয়ে দিলেন, আর কিছু করার নেই।

১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাবার নাম ক্ষিতিশ বাড়ই। মায়ের নাম মিনু বাড়ই। প্রিয় গায়ক কিশোর কুমারের নামে ছেলের নাম কিশোর রাখেন মা মিনু বাড়ই। বড় বোনের গানের শিক্ষক আবদুল আজিজ বাচ্চুর অধীনে সংগীতে হাতেখড়ি। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক, লোক, দেশাত্মবোধকসহ প্রায় সব ধারার গানে রাজশাহী বেতারে তালিকাভুক্ত শিল্পী হন তিনি। অনার্সে পড়ার সময়েই ঢাকা বেতার কেন্দ্রে আসেন গাইতে। স্কুলের বড় ভাই হাবলু তাঁর গান শুনে বললেন, ‘শোন, তোকে দিয়ে রেডিওতে কিছু হবে না, তোর যে কণ্ঠ, সিনেমায় তুই ফাটিয়ে দিবি।’ এন্ড্রু কিশোর তখন বললেন, ‘কে আমাকে সুযোগ দেবে?’ বড় ভাই আশ্বাস দিলেন, ‘আমরা তো আছি।’ সেই কিশোর একদিন সত্যিই ‘প্লেব্যাকসম্রাট’ উপাধি পেয়েছিলেন। পরে চলচ্চিত্রের বাইরে খুব কমই গেয়েছেন। চার দশকে চলচ্চিত্রের প্রায় ১২ হাজার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। হাতে গোনা দু-একটি অডিও অ্যালবামে গেয়েছেন, এ ছাড়া গেয়েছেন হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’তে। ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রে প্রথম সুযোগ পান। ছবির ‘অচিনপুরের রাজকুমারী, নেই যে তার কেউ’ গানটি জনপ্রিয় না হলেও সংগীত পরিচালকরা তাঁর মধ্যে ভারতীয় কিংবদন্তি গায়ক কিশোর কুমারের ছায়া দেখেছিলেন। দুই বছর পরই পান সবচেয়ে বড় সাফল্য। তাঁর গাওয়া ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ পৌঁছে গেল কায়িক শ্রমিক থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মুখে মুখে। তারপর একে একে গেয়েছেন ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যিখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘তুমি আমার কত চেনা’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়’সহ অগণিত গান।

চার দশক ধরে চলচ্চিত্রে যত নায়ক এসেছেন সবার ঠোঁটেই শোভা পেয়েছে এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠ। রাজ্জাক, ফারুক, ওয়াসিম, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, জাফর ইকবাল, ওমর সানী, সালমান শাহ, রিয়াজ, ফেরদৌস, শাকিব খানরা তো আছেনই, হালের সাইমন, বাপ্পী চৌধুরীরাও ঠোঁট মিলিয়েছেন তাঁর গানে। স্বীকৃতিস্বরূপ গানে আটবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। শুধু ঢালিউডই নয়, গেয়েছেন টালিগঞ্জ এমনকি হিন্দি চলচ্চিত্রেও। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘শত্রু’র হিন্দি ভার্সনে আর ডি বর্মণের সুরে দুটি গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। কথিত আছে, এন্ড্রু কিশোরকে ভারতেই থেকে যেতে বলেছিলেন আর ডি বর্মণ। কিন্তু নিজের জন্মভূমি ছেড়ে ভারতে স্থায়ী হতে অস্বীকার করেছিলেন গণমানুষের এই গায়ক।

এন্ড্রু কিশোরের এক ছেলে ও এক মেয়ে। দুজনই অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা সিডনিতে গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে পড়ছেন, ছেলে জে এন্ড্রু সপ্তক মেলবোর্নে পড়ছেন ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে।

এন্ড্রু কিশোর যদিও বলে গেছেন, মায়ের কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করতে, তবু গতকাল মধ্যরাত পর্যন্ত পরিবারের সদস্যরা জানাননি আজ কখন এবং কোথায় তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে।

তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, সদর আসনের এমপি ফজলে হোসেন বাদশা, শব্দসৈনিক তিমির নন্দী, সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. বিশ্বজিত রায়, অনুষ্ঠান নির্মাতা হানিফ সংকেতসহ বিভিন্ন সংগঠন ও নেতারা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর