স্বাস্থ্য খাতের ‘স্বাস্থ্য’ কোনোকালেই ভালো ছিল না

হাওর বার্তা ডেস্কঃ শিরোনামটি এমন হতে পারত, ‘আদৌ বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাত বলে কিছু ছিল কিনা?’ তাতে নানাজন অখুশি হতেন বিধায় সে পথ মাড়াইনি। বাস্তব অবস্থার প্রতি সদাচরণ করলে বলতে হবে, গত ৫ দশক ধরে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর কোনো ভাবনাই ছিল না। তারপরও যদি বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি।

তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রয়াত মেজর জেনারেল শামসুল হকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে (গণস্বাস্থের ট্রাস্টি ডা. মো. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন সদস্য ছিলেন) যে নীতিমালা তৈরি করা হয়েছিল, তা দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছিল। আজ দেশে অনেকেই ওষুধ শিল্পের সঙ্গে জড়িত হতে পেরেছেন, যা ওই নীতিমালার ফসল। ব্যস। আর কোনো সফল উদ্যোগ সরকারিভাবে নেয়া হয়নি। আপনি অনায়াসেই বলতে পারেন, কোন খাতটি অক্ষত আছে? পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি, শিল্প খাতে ঋণখেলাপি, শিক্ষা খাতে নিয়োগ-বাণিজ্য, কৃষি খাতে মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য- কোন খাতে অরাজকতা নেই? আপনার সঙ্গে একমত হয়েই বলতে পারি, দুর্নীতি, অদক্ষতা, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, স্বজনপ্রীতি আর অপরিকল্পনায় স্বাস্থ্য খাতের প্রাণ যায় যায়। দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য খাতে এরকম দুরবস্থা বিরাজমান; কিন্তু তা ওপর মহলকে বিচলিত করেনি। কারণ তাদের চিকিৎসা হয় লন্ডন-সিঙ্গাপুর-ব্যাংককে। আর যারা দেশে চিকিৎসা নেন, তাদের অভিজ্ঞতা না বলাই ভালো।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোথা থেকে শুরু করবেন? ‘সর্ব অঙ্গে ব্যথা, মলম দিব কোথা’। স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই; যেখানে অবকাঠামো আছে সেখানে ডাক্তার নেই; যেখানে ডাক্তার আছে সেখানে নার্স নেই; যেখানে নার্স আছে সেখানে চিকিৎসা-সরঞ্জাম নেই; যেখানে সরঞ্জাম আছে সেখানে টেকনিশিয়ান নেই; করোনার সময়ে ভেন্টিলেটর নেই, আইসিউ নেই, ২৪ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মীর পিপিই নেই, পর্যাপ্ত টেস্টিং কিট নেই। খালি নেই আর নেই। তবে আছে; দুর্নীতি আছে, অনিয়ম আছে, অব্যবস্থাপনা আছে, অদক্ষতা আছে আর পরিকল্পনার অভাব আছে। যা নেই তো নেই আর যা আছে তা-ও নেতিবাচক। মোদ্দাকথা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্গতি নিয়ে ভাবতে গেলে আপনি খেই হারিয়ে ফেলবেন।

করোনাভাইরাসের চেয়েও আকারে অনেক ছোট একটি সমস্যার কথা তুলে ধরা যাক। ২৮ জুনের যুগান্তর বলছে, ‘করোনার মহামারীতে ভেজাল, নকল নিম্নমানের সুরক্ষাসামগ্রীতে বাজার ছেয়ে গেছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে মানহীন পণ্য সরবরাহ করছে। এসবের অধিকাংশ চোরাই পথে বিদেশ থেকে আসছে।’ এ অতি সামান্য অনিয়মকে রোধ করা গেল না? তাহলে সরকার পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার কতখানি কী করতে পারবে? আগেই বলেছি, সরকার কেবল করোনাকালীন অবস্থাকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে, সমগ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন নয়। যে কারণে চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে (যদিও আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম কমপক্ষে ৬০ হাজার কোটি টাকা); থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। যদিও থোক বরাদ্দ কোনো পরিকল্পিত ব্যয় নয়। আমাদের প্রত্যাশা পূরণ না হলেও অনেকেই মনে করেন বরাদ্দকৃত ২৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৫০ শতাংশেরও সদ্ব্যবহার হবে না। এ রকম ধারণার পেছনে কাজ করছে বিগত দিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা- পর্দা কেলেঙ্কারি, চেয়ার কেলেঙ্কারি, সরঞ্জামাদি ক্রয় কেলেঙ্কারিসহ নানা অপকর্ম। কোনো অভিযোগেরই এ পর্যন্ত কোনো ধরনের সুষ্ঠু সুরাহা হয়নি। যে কারণে সরকারের ওপর মহল থেকে যে ‘জিরো টলারেন্স’ বাণী বর্ষিত হচ্ছে, তার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা নেই।

বলতে দ্বিধা নেই, আজ বিত্তশালীরা আতঙ্কিত হয়েছেন বলেই স্বাস্থ্য খাত নিয়ে দু’চারটা কথা হচ্ছে, যা দেশ করোনামুক্ত হওয়ার পর ষোল আনাই মিলিয়ে যাবে। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে প্রান্তিক জনগণের স্বাস্থ্যসেবার স্বরূপটি হয় সরকারি মহল জানে না, নতুবা জেনেও না জানার ভাব করছে এবং তা অবশ্যই স্বাস্থ্যবণিকদের স্বার্থে। শহরকেন্দ্রিক স্বাস্থ্যসেবার একটি প্রত্যক্ষ উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। একজন ৬০ বছর বয়সী রোগীর অস্থাবর সম্পদ বলতে একখানা ছাগল। প্রত্যাশা ছিল, আসছে কোরবানির ঈদে পশুর হাটে বিক্রি করবেন। অনুমান করেছিলেন, সে সময়ে ছাগলটির দাম হবে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা। কিন্তু ঈদের তিন মাস আগেই রোগের আক্রমণ। প্রথমে তো বর্তমান, তারপর না হয় ভবিষ্যৎ; পরিপক্ব হওয়ার আগেই ছাগলটিকে মাত্র ৪ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিলেন। ৪ হাজার টাকা হাতে নিয়ে পল্লী চিকিৎসকের (স্থানীয় ভাষায় কোয়াক ডাক্তার বলে) সহায়তায় একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এলেন। ডাক্তারের ভিজিট ৫০০ টাকা। ডাক্তার সাহেব তিনটি টেস্ট দিলেন, প্রয়োজনে আর তিনটি দিলেন মালিকের চাপে। টেস্ট বাবদ গেল ২৫০০ টাকা। যাতায়াত ভাড়া ১০০ টাকা। হাতে আছে মাত্র ৯০০ টাকা। ডাক্তার এক মাসের ওষুধ লিখে দিলেন, দাম তার ২৮০০ টাকা। তাহলে উপায়! উপায় কিছু নেই, বাদবাকি টাকা দিয়ে এক সপ্তাহের ওষুধ নিয়েই বাড়ি ফিরতে হল। বাকি ওষুধের ব্যবস্থাও নেই, রোগ থেকে মুক্তিও নেই। ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন অপ্রয়োজনীয় টেস্টের কাজটি করলেন? তিনি অসহায়ভাবে বললেন, মালিক আমাকে চেম্বারে বসতে দেবে না। মালিককে জিজ্ঞেস করলাম অনৈতিক চাপের বিষয়ে। তিনি একটি অবাক করা বাণিজ্যিক বয়ান দিলেন। তার ভাষায়, কোয়াক ডাক্তারকে কমিশন না দিলে গ্রাম থেকে রোগী আসবে না; রোগী না এলে ডাক্তার টেস্ট দিতে পারবেন না; টেস্ট না হলে আমার আয় হবে না। তাই যদি হবে তাহলে ডাক্তারকে চেম্বার দিয়ে লাভ কী? কে খণ্ডাবে এ যুক্তি?

করোনাকালীন ডাক্তারদের সাহসী ভূমিকাকে আমরা বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু একজন ভালো ডাক্তার দিয়ে তো পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যাবে না। এর জন্য চাই একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রতিজ্ঞা, যার দায় সরকারের ওপর বর্তায়। অনেকেই সমাধানের ভেতরে একটি দায়সারা গোছের জবাব দিতে চেষ্টা করেন- আমরা গরিব দেশ। এর উত্তরে বলব, বাংলাদেশে যে মাপের বিত্তশালী আছে তা দেখে কেউ বলবে না এটি একটি গরিব দেশ। আবার দরিদ্রদের প্রকৃত অবস্থা দেখে বলবে না যে এটি কোনো গণতান্ত্রিক দেশ। তবে একটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা গরিব-ধনীতে তফাৎ করে না। নির্ভর করে সাধারণ নাগরিকদের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি কী এবং জনগণকে তারা কোন অবস্থার মধ্যে রাখতে চান তার ওপর। আমি একটি তুলনামূলক আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে নেব প্রভাবশালী দেশ হিসেবে, ভারতকে নেব প্রতিবেশী এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে, আর কিউবাকে নেব অনন্য উদাহরণ হিসেবে। বিশ্বের মানচিত্রে কিউবার অবস্থান কোথায় তা অনেকেরই অজানা। একমাত্র ফিদেল কাস্ত্রো আর চে গুয়েভারা হলেন আমাদের কাছে কিউবা!

যে কারণে কিউবাকে কেউ আমলে নেয় না তা হল, সামরিক শক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে ১ নম্বরে, ভারত ৪ নম্বরে, বাংলাদেশ ৪৬ নম্বরে আর কিউবা ৭৬ নম্বরে; আয়তনের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ৯৮ লাখ বর্গকিলোমিটার, ভারত ৩২ লাখ বর্গকিলোমিটার, বাংলাদেশ ১ লাখ ৪৮ হাজার বর্গকিলোমিটার আর কিউবা মাত্র ১ লাখ ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার; লোকসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩৩ কোটি, ভারতে ১৩৫ কোটি, বাংলাদেশে ১৭ কোটি আর কিউবায় মাত্র ১ কোটি। জিডিপি বা অর্থনীতির আকার যদি বিবেচনায় নেন তাহলে দেখবেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কিউবার চেয়ে ২১০ গুণ বড়, ভারতের অর্থনীতি ৩০ গুণ বড়, এমনকি আমাদের অর্থনীতি কিউবার চেয়ে ৩ গুণেরও বেশি বড়। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই কিউবাকে কারও আমলে নেয়ার কথা নয়। কিন্তু জনগণের রাষ্ট্র বিবেচনায় সেই দেশটিকে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই, যা একটি পরিকল্পিত স্বাস্থ্যব্যবস্থার ধারক। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৩৩০ জন নাগরিকের বিপরীতে একজন ডাক্তার, ভারতে ১ হাজার ৬০০ নাগরিকের বিপরীতে একজন ডাক্তার, বাংলাদেশে ১ হাজার ৯০০ জনের বিপরীতে একজন ডাক্তার আর কিউবায় মাত্র ১০৫ জন নাগরিকের বিপরীতে একজন ডাক্তার। তারপরও বলতে হয়, তারা ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর’ নীতিতে বিশ্বাস করায় স্কুলজীবন থেকেই স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাঠ নিয়ে থাকে। হাসপাতালগুলোতে যদি বেডের সংখ্যা বিবেচনায় নেন তাহলে দেখবেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১ হাজার নাগরিকের বিপরীতে আছে ২.৮টি বেড, ভারতে ২.৭টি বেড, বাংলাদেশে একটিরও কম- ০.৮৭টি বেড এবং কিউবায় ৫টি বেড। প্রত্যাশিত গড় আয়ু যুক্তরাষ্ট্রে ৭৮.৫৪ বছর, ভারতে ৬৯.১৬ বছর, বাংলাদেশে ৭২ বছর আর কিউবায় ৭৮.৬৬ বছর। করোনার আক্রমণ যদি বিবেচনায় নেন তাহলে দেখবেন, ২ জুলাই পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত হয়েছেন প্রতি লাখে ৮৪৭ জন, ভারতে ৪৯ জন, বাংলাদেশে ৯০ জন আর কিউবায় ২১ জন। যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ হয়েছেন ৪২ শতাংশ, ভারতে ৫৯ শতাংশ, বাংলাদেশে ৪৪ শতাংশ এবং কিউবায় ৯৪ শতাংশ। এ কারণেই বললাম, কোনো দেশ গরিব না ধনী তার ওপর স্বাস্থ্যনীতি নির্ভর করে না। স্বাস্থ্যনীতি নির্ভর করে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে।

আমরা একযুগ ধরে ‘উন্নয়ন’ আর ‘প্রবৃদ্ধির’ গল্প শুনে আসছি। এ সময়ে চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের একটি বাণী স্মরণে আনতে চাই। তিনি বলেছেন, ‘তরতর করে উপরে ওঠার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই, কৃতিত্ব হল গর্তে পড়ে গেলে উঠে আসতে পারো কিনা।’ অতীতের কথা এ সময়ে টেনে আনার প্রয়োজন বোধ করছি না, তবে ভবিষ্যতে যেন এমন অন্ধকারে না পড়তে হয়, সেদিক বিবেচনায় একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর