মধ্যাঞ্চলেও ছড়াল বন্যা, ১৫ জেলায় দুর্ভোগ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বন্যা অব্যাহত আছে। ৯টি নদীর পানি বইছে বিপদসীমার উপরে। এতে অন্তত ১৫ জেলায় বন্যা চলছে। ইতোমধ্যে যমুনার পানি নেমে পদ্মার দু’টি পয়েন্টে বিপদসীমা পার করেছে। এতে মধ্যাঞ্চলের জেলা রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুরে বিস্তৃত হয়েছে বন্যা।

কুড়িগ্রামে পানিতে ডুবে একজনের মৃত্যু হয়েছে। সরকারি ত্রাণ দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বন্যায় বিপাকে পড়েছে দিনমজুর আর নিম্ন আয়ের মানুষ। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। মেডিকেল টিম করে বন্যাদুর্গত এলাকায় খাবার স্যালাইন ও বিভিন্ন ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছে প্রশাসন।

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে সোমবার বৃষ্টি না হওয়ায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানির সমতল বাড়ছে না। তাই বন্যা পরিস্থিতি আরও ২৪ ঘণ্টা স্থিতিশীল থাকতে পারে। তবে বাড়ছে গঙ্গা-পদ্মার পানি। ইতোমধ্যে মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকূল পয়েন্টে পদ্মা বিপদসীমা পার করেছে। আরও ৪৮ ঘণ্টা এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে। মানিকগঞ্জের আরিচায়ও যমুনা বিপদসীমার উপরে বইছে।

অপরদিকে মেঘনা অববাহিকা বা সিলেট থেকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত নদনদীতে পানির সমতল হ্রাস পাচ্ছে। এটা আরও ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে দেশের পূর্বাঞ্চলে বা সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে।

কিন্তু আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতি একই রকম থাকবে। আর পরিস্থিতি অবনতি ঘটবে টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী ও ফরিদুপর জেলায়।

সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) বলেছে, সোমবার ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বৃষ্টিপাত হয়নি। এ কারণে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও মেঘনা অববাহিকায় পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার আশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মঙ্গলবার আসাম ও সিকিমে বৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে আসামের সিলচরে ২৪ ঘণ্টায় ১১৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। ফলে ব্রহ্মপুত্রে পানিপ্রবাহ ফের বেড়ে যাবে। দেশের ভেতরেও কমবেশি বৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে ছাতক, সুনামগঞ্জ, লাটু, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ ও লাল্লাখালে ১৭৫ থেকে ৪৮ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। ফলে দেশের ভেতরের বৃষ্টিও বন্যা পরিস্থিতিতে অবদান রাখছে।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ভারতের পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টি কমে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির আশা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু ফের বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তাই এই বন্যা আরও এক সপ্তাহ চলতে পারে। তিনি বলেন, গত ৫ বছরের মধ্যে ৪ বছরই বন্যা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় ‘রোল মডেল’ বলা হলেও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে এখন ‘রোল চ্যালেঞ্জ’-এ পরিণত হচ্ছে। মৌসুমের শেষের দিকে আরেক দফা হতে পারে। এবার আউশের ক্ষতি হল। এরপর আমনের ক্ষতি হবে। এমন হলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। তাই আমাদেরকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি চলতি বন্যায় দুর্গতদের শুকনা খাবার, ওষুধ, গো খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থাপনা করা দরকার। এফএফডব্লিউসি জানিয়েছে, দেশের ৯টি নদীর পানি বিপদসীমার উপরে বইছে। এগুলো হচ্ছে, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ঘাঘট, ধরলা, আত্রাই, ধলেশ্বরী, পদ্মা, সুরমা ও পুরাতন সুরমা। এসব নদী ১৪ স্থানে বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। নদ-নদীর পানি সামান্য কমলেও ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে ডুবে নতুন করে জামাল ব্যাপারী (৫৫) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।

এ নিয়ে জেলায় পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ৪ জনে। বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, জ্বালানি ও গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, বুধবার ধরলার পানি বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া দুধকুমার নদীর পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৫২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ৮৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ২১ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহা জানান, জেলার দুর্গত মানুষদের সহায়তার জন্য ৯ উপজেলায় ৩০২ মে.টন চাল ও ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ঘাঘট নদীর পানি সামান্য কমলেও জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রিত পরিবারগুলো এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পায়নি বলে অভিযোগ করেছেন।

বুধবারেও ব্রহ্মপুত্রের পানি ৭৮ সেন্টিমিটার ও ঘাঘট নদীর পানি ৫০ সেন্টিমিটার বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ পর্যন্ত ফসলসহ প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। সাঘাটা-গাইবান্ধা সড়কের ভাঙ্গামোড় এলাকায় সড়কের গাইড ওয়াল ধসে যায়।

বগুড়া : বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলা যমুনা নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে বন্যাদুর্গত মানুষদের দুর্ভোগ বেড়েছে। আক্রান্তদের অনেকে গবাদিপশু ও আসবাবপত্র নিয়ে আশপাশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও আশ্রয়ণ প্রকল্পে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও গবাদিপশুর খাবার সংকট দেখা দিয়েছে।

বুধবার দুপুরে সারিয়াকান্দির মথুরাপাড়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৬৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে সোনাতলা উপজেলায় যমুনা ও বাঙ্গালি নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) : ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া উপজেলার পোড়াকান্দুলিয়ার মানুষ বছরে কমপক্ষে ৪ মাস বন্যার পানির সঙ্গে বসবাস করে। বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টি শুরু হলেই উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যার সৃষ্টি হয়।

কলমাকান্দা (নেত্রকোনা) : নেত্রকোনার কলমাকান্দায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে প্লাবিত এলাকার মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। ঘরবাড়ির চারপাশে এখনও পানি থাকায় কার্যত পানিবন্দি হয়ে আছেন পনেরো হাজার মানুষ। দুর্গত মানুষের অভিযোগ, খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সোহেল রানা জানান, বন্যার্তদের মধ্যে চল্লিশ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।

চুনারুঘাট (হবিগঞ্জ) : হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ির জাতীয় উদ্যানের পাহাড়ের ঢাল ও চূড়ায় ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে ২৪টি ত্রিপুরা পরিবার। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে টিপরা পল্লীতে ব্যাপক ধস দেখা দিয়েছে। এতে অস্তিত্ব বিলীনের হুমকিতে রয়েছেন ত্রিপুরা পল্লীতে বসবাসরত পরিবারগুলো।

দেওয়ানগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী (জামালপুর) : যমুনার পানি কমলেও দেওয়ানগঞ্জ বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পৌর এলাকাসহ ৮টি ইউনিয়নে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ প্রায় ৫ দিন ধরে পানিবন্দি রয়েছে। বুধবার দুপুরে দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টের যমুনার পানি ২৪ ঘণ্টায় ৩ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৮২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে সড়ক ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে গত ২৪ ঘণ্টায় ২টি ইউনিয়নের ২০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ইউনিয়নগুলো হল- সাতপোয়া ও পোগলদিঘা।

সিলেট : সিলেটে বুধবার ভোরে ও সকালের বৃষ্টিতে সিলেটে আবারও বাড়তে শুরু করেছে নদ-নদীর পানি। তবে মঙ্গলবার বৃষ্টি না হওয়ায় অনেক জায়গায় পানি কমতে শুরু করে। বুধবার পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুজ্জামান সরকার যুগান্তরকে জানান, মঙ্গলবার পানি কমলেও বুধবার নদ-নদীর পানি আবার বাড়তে শুরু করেছে। এখন পানি বাড়বে, কমবে। তবে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা নেই। জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে এ অঞ্চলের বন্যাকবলিত লোকজনের জন্য ১৮ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৭২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

সুনামগঞ্জ ও দোয়ারাবাজার : সুনামগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত রয়েছে। বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল কমে যাওয়ায় দ্রুত নামতে শুরু করেছে সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পানি। বুধবার সুনামগঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৩ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর