পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে উত্তরাঞ্চলের অনেক নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে নদীতীরবর্তী এলাকার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। অনেক এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। আমন ধানের বীজতলার পাশাপাশি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

বন্যাকবলিত এলাকায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গ্রামীণ সড়কগুলো ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে অনেক এলাকায়। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এখন নৌকা ও কলার ভেলা ব্যবহার করছেন চরের বাসিন্দারা। শুকনো জায়গার অভাবে অনেকেই রান্না করতে পারছেন না। বন্যার কারণে পুকুরের মাছ বের হওয়ার ফলে মৎস্যচাষীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

তিস্তার পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার, ধরলার ১৩ ও ব্রহ্মপুত্রের ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়ছে দুধকুমারেও। উজানের ঢল সামাল দিতে খুলে রাখা হয়েছে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট। রংপুরের গঙ্গাচড়ায় বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। যুগান্তর ব্যুরো, স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

ডিমলা (নীলফামারী) : শুক্রবার সকাল ৬টায় তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার বিকাল ৬টায় তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলে শুক্রবার ভোররাত থেকে তা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। গত ৪৮ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২৪০ মিলি লিটার।

টানা ২ দিনের বৃষ্টির ফলে তিস্তাসহ জেলার সব নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে লোকালয়ে বন্যা দেয়া দিয়েছে। পানি বৃদ্ধির ফলে তিস্তার চরাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। তিস্তাপারের মানুষজন বলছেন, তিস্তা নদীর পানি ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা জানান, ১০ ইউনিয়নের তিস্তা অববাহিকার ১৫টি চর ও গ্রাম তিস্তার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ওই সব এলাকায় বসবাসকারীদের নিরাপদে উঁচু স্থানে সরে থাকার জন্য বলা হয়েছে।

কুড়িগ্রাম, চিলমারী ও ফুলবাড়ী : ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এ দুটি নদীর অববাহিকার দুই শতাধিক চরের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অন্তত ৫০ হাজার মানুষ।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, দুপুর ১২টায় তিস্তা ও দুধকুমারের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে, তা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানি যে হারে বাড়ছে তাতে জেলার বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে। কুড়িগ্রামের শহররক্ষা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সাম্প্রতিক সময়ে সংস্কার করায় এবার ধরলার পানি শহরে প্রবেশ করতে পারবে না। আর পানি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে নদীভাঙনের মাত্রা কিছুটা কমেছে।

কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় দুই শতাধিক চর ও দ্বীপচরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার নিমজ্জিত হয়েছে ফসল ও গ্রামীণ সড়ক। প্রবল বর্ষণেও রাস্তার ওপর চালা করে অনেকে আশ্রয় নিচ্ছেন। সারডোব বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ কয়েকটি এলাকায় বাঁধ ও সড়ক ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

ব্রহ্মপুত্রের চরমশালের বাসিন্দা মুসা মিয়া, হায়দার আলী ও ভগবতির চরের জাহাঙ্গীর আলম, মানিক, ফয়জার রহমান জানান, চরের অধিকাংশ ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে। অনেকেই উঁচু ভিটায় থাকলেও নিচু ভিটার বাসিন্দারা নৌকা ও চৌকির ওপর আশ্রয় নিয়েছেন।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল করিম জানিয়েছেন, বন্যা মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। চিলমারীর অষ্টমীরচর ও নয়ারহাট ইউনিয়নে গত কয়েকদিনে নদীভাঙনে শতাধিক পরিবার ও একটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ২টি ব্যারাক নদীতে বিলীন হয়েছে।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্যানুযায়ী, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানি সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। করতোয়া ও ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে নদীতীরবর্তী চরগুলোর নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। ফলে এসব এলাকার বসতবাড়ির লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

ফুলছড়ির উড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহাতাব উদ্দিন জানান, কয়েকদিনের ভাঙনে উড়িয়া ইউনিয়নের উত্তর উড়িয়া ও কাবিলপুর এলাকার ৪৬টি পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা অববাহিকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে।

গঙ্গাচড়া (রংপুর) : রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট বন্যায় চরাঞ্চলের প্রায় ৫শ’ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তিস্তার পানি বৃহস্পতিবার বাড়তে থাকে। কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা এলাকায় বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বিনবিনা থেকে তুষভাণ্ডার যাওয়া পাকা রাস্তার প্রায় ৫শ ফুট ভেঙে গেছে। বাড়িঘরেও পানি ওঠায় বিনবিনা এলাকায় কিছু লোক গবাদি পশুসহ রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে।

ঠাকুরগাঁও : ঠাকুরগাঁওয়ের টাঙ্গন, সেনুয়া, শুক, নাগর ও কুলিকসহ সব নদীর পানি বেড়েছে। এতে শহরের কলেজপাড়া নয়াবস্তি ও খালপাড়াসহ বিভিন্ন মহল্লার কয়েকশ’ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আফতাব হোসেন জানান, বর্ষণে বেশ কিছু ক্ষেত তলিয়ে গেছে। তবে দু-এক দিনের মধ্যে পানি সরে গেলে তেমন ক্ষতি হবে না। জেলা প্রশাসক কেএম কামরুজ্জামান সেলিম জানান, ঠাকুরগাঁও উঁচু এলাকা। পানি সরে যেতে দু-এক দিন সময় লাগবে। তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

দিনাজপুর : দিনাজপুরের প্রধান প্রধান নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হচ্ছে। দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন জানান, দিনাজপুরে শুক্রবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আর পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১৯২ দশমিক ৫ মিলিমিটার। আগামী ২৮ জুন পর্যন্ত এ বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর