করোনাইয় সংক্রমণ রোধে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ‘লকডাউন’ দাবি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে কোনো ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না। এই ভাইরাস থেকে নিজেদের নিরাপদে রাখতে তারা কোনো প্রকার নিয়ম কানুন মানছে না। ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা তাদের স্বাভাবিক চলাফেরা, আড্ডা এখনো আগের মতো চালিয়ে যাচ্ছে। যখন খুশি রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বের হচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগ দিচ্ছে শতশত রোহিঙ্গা। এ ছাড়া ক্যাম্পে কর্মরত দেশি-বিদেশি সংস্থার লোকজনও অনায়াসে আগমন প্রস্থান করছে ক্যাম্পে।

কোনোকোনো সংস্থার বিদেশি কর্মকর্তারা নিয়মনীতি না মেনে ক্যাম্পে ঢুকে কাজ করার অভিযোগ ওঠেছে। যদিও এ ব্যাপারে ক্যাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঠাসাঠাসি করে ঠাঁই নেওয়া প্রায় দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার করোনা সংক্রমণ মোকাবেলায় কতটা প্রস্তুত সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ?

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দারা চরম আতঙ্কে রয়েছে। তাদের দাবি বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাঝে এ ভাইরাসটি কোনোভাবে ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ন্ত্রণ কতটা কঠিন হবে তা কল্পনাতীত। স্বাভাবিকভাবে সব অঞ্চলের মানুষের মাঝে ভাইরাসটি সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও স্থানীয়রা যে যার মতো প্রস্তুতি নিচ্ছে পরিত্রানের জন্য। তবে ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে এ ভাইরাস নিয়ে এখনো তেমন সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের বেপরোয়া চলাচলের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।

টেকনাফ হ্নীলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী কালের কণ্ঠকে জানান, আমরা করোনাভাইরাস সম্পর্কে স্থানীয়দের মাঝে মাইকিং ও লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। জনসাধারণকে বিভিন্ন স্থানে আড্ডা, জনসমাগম থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করছি। আমি নিজেই বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করছি। তবে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে স্বাভাবিকভাবে আমরা নিজেরাও অনেকটা আতঙ্কিত। কারণ রোহিঙ্গারা সংখ্যায় এমননিতে বেশি, তাছাড়া ক্যাম্পের ভেতরে বাইরে তাদের চলাফেরা তেমন শৃঙ্খলিত নয়। রোহিঙ্গাদের মাঝে করোনা সংক্রমিত হলে ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বলে আমাদের আশঙ্কা। তবে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে আমাদের দাবি, করোনার বিস্তার রোধে এ মুহুর্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্প লকডাউন করা হোক।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার- আরআরআরসি (জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সচিব) মো. মাহবুব আলম তালুকদার জানিয়েছেন, উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প গুলোতে নতুন কোনো বিদেশি যেতে চাইলে তাকে ক্যাম্পে যাওয়ার আগে কমপক্ষে ১৪ দিন কোয়ারান্টাইনে থাকতে হবে। কোয়ারাইন্টানে থেকে আশংকা মুক্ত হলেই রোহিঙ্গা প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেতে পারবেন। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে রোহিঙ্গা প্রশাসন এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা জারি করেছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহবুব তালুকদার দাবি করেন, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৪৭টি করোনাভাইরাস আইসোলেশন বেড রেডি করা আছে। প্রয়োজন হলে আরো ১৫০ শয্যার বেড প্রাথমিকভাবে প্রাক প্রস্তুতি করে রাখা হয়েছে। তবে ক্যাম্পে এখনো পর্যন্ত কোনো করোনাভাইরাস জীবাণু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়নি। এরপরও রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র গুলো এ বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে কাজ করছে।

শনিবার সরেজমিনে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা বিভিন্ন স্থানে কেউ কেউ দলবদ্ধ হয়ে গল্পগুজবে, অনেকে গাছতলায়, রোহিঙ্গা বাজার গুলোতে আড্ডায় মশগুল রয়েছে। করোনাভাইরাস নিয়ে এখনো অনেক রোহিঙ্গা অবগত নন। অনেকে এ বিষয়ে ধারণা পেলেও বিষয়টি তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। তবে অনেক রোহিঙ্গা জানিয়েছেন এ করোনাভাইরাস সম্পর্কে তাদের মাঝে যেটুকু সচেনতা প্রয়োজন বাস্তবে তা করা হয়নি। ক্যাম্পে কর্মরত দেশি ও বিদেশি সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল ভূমিকা রোহিঙ্গাদের মুখে শোনা যায়নি।

উখিয়া উপজেলার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের যুবক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ জানান, করোনাভাইরাস সম্পর্কে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জেনেছি। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বেশির ভাগ রোহিঙ্গা এখনো এ রোগ সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের এ বিষয়ে সচেতন করা প্রয়োজন।

টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমোরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা নুর বেগম (৪৪) জানান, এ ধরনের রোগ সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। কেউ আমাদের এ বিষয়ে কোনো ধরনের তথ্য দেয়নি। আমরা আগের মতো স্বাভাবিক চলাফেরা করছি।

মোচনী গ্রামের বাসিন্দা মকবুল আহমদ জানান, ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা যখন খুশি ক্যাম্প থেকে বের হচ্ছে। তারা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অবাধে ঘোরাফেরা করছে। অনেক রোহিঙ্গা স্থলবন্দর ও উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দিনে শ্রমিক হিসেবে কাজে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে বের হওয়া এখনো বন্ধ হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দাদের করোনা বিষয়ে যতটা সচেতন দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের মাঝে তেমন কোনো সচেতনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

হ্নীলা এলাকার বাসিন্দা মোকতার আহমদ জানান, রোহিঙ্গারা ঝুঁপড়ি করে ঘনবসতির মধ্যে থাকে। অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে মিয়ানমার যায় আবার ক্যাম্পে ফিরে আসে। তাছাড়া বন্দরে শ্রমিক হিসেবে কাজ করা রোহিঙ্গাগুলো মিয়ানমার থেকে আগত পন্যবোঝাই ট্রলারের মাঝিমাল্লাদের সংস্পর্শে যাচ্ছে। তাদের মাঝে কোনোভাবে যদি করোনাভাইরাস ভর করে তাহলে পুরো উখিয়া টেকনাফে সেটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

এদিকে স্থানীয় জনসাধারণ দাবি জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে জনসমাগম বেশি হওয়ায় মহামারি করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি সেখানেই সবচেয়ে বেশি। তাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প লকডাউন করার দাবি স্থানীয়দের।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সাইফ বলেন, আমরা এই ভাইরাস সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দাদেও লিফলেট ও মাইকিং করে সতর্ক করেছি। বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলেছি। নির্দেশনা অমান্য করায় অনেককে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অর্থদণ্ড করা হয়েছে। এ বিষয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতেও ব্যাপক প্রচারণার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর