অন্ধ নারীর দেখানো পথেই চলে খেয়া পারাপার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ জেসমিন বেগম। হার না মানা সাহসী এক নারীর নাম। জীবনের প্রতিটি ধাপেই তিনি হারিয়েছেন কিছু না কিছু। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই হারিয়েছেন এক চোখের দৃষ্টিশক্তি। অন্য চোখে দেখার ক্ষমতাও সীমিত।

দৃষ্টিশক্তি নেই তো কি হয়েছে? স্বপ্ন দেখতে তো মানা নেই। জেসমিন বেগম ও স্বপ্ন দেখেছেন সাজানো সংসারের। বিয়ের পর স্বামী ও দুই মেয়ে নিয়ে সুখেই কাটছিল জেসমিন বেগমের সংসার। তবে তার সুখ স্থায়ী হয়নি বেশিদিন।

মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার চরাঞ্চল আধারা ইউনিয়নের বকচর গ্রামের এই অদম্য নারী। তার বয়স ৩২ বছর। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চার বছর আগে মারা যান জেসমিন বেগমের স্বামী সবুজ সিকদার। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে নিজেই কাঁধে তুলে নেন সংসারের দায়িত্ব। দুই মেয়েকে মানুষ করতে শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। তার এই কঠিন সময়ে কেউ এগিয়ে আসেনি, জোটেনি প্রতিবন্ধী ভাতা কিংবা কোনো সরকারি সাহায্য। এই অন্ধ নারী মানুষের নানা কটূ মন্তব্য উপেক্ষা করে টানছেন সংসারের ঘানি।

জেসমিন বেগম পেশায় একজন ট্রলার চালক। স্বামী মারা যাওয়ার পরই তিনি এ পেশায় আসেন। রজতরেখা নদীর চিলতলিয়া বকচর নৌরুটে খেয়া পারাপার করেন। আগে কখনো ট্রলার চালাননি জেসমিন। তার স্বামী ট্রলার চালাতেন। হাতে কলমে শিক্ষা না থাকলেও তাকে দেখেই শিখেছেন ট্রলার চালানো। এখন ইঞ্জিনচালিত এই ট্রলার চালিয়েই জীবিকা নির্বাহ করছেন এই অদম্য নারী।

জেসমিন বেগম জানান, স্বামী মারা যাওয়ার আগেও ব্রেইনস্ট্রোক করে তার বাম হাতটা অবশ হয়ে গিয়েছিলো। তাই জেসমিন বেগম নিজেই ট্রলার চালিয়ে সংসার চালাতেন। তার স্বামীর ওষুধ খাওয়ায় মাসে ছয় হাজার টাকার লাগতো। কিস্তি চালানো, মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, সংসার এসব চালিয়েছে  ট্রলার চালিয়ে।

প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নারী হিসেবে ট্রলার চালানো শুরু করাটা বেশ কঠিনই ছিল তার পক্ষে। লোকজন অনেক কথা বলতো, হাসাহাসি করতো আবার কেউ কেউ বলতো মেয়ে মানুষও আবার ট্রলার চালায়! এখনো বলে, অনেকে ধিক্কার দেয় অন্য কাজ করতে পারো না ট্রলার চালানো ছেড়ে!

স্বামীর মৃত্যুর পর একজন সাধারণ গৃহবধু থেকে ট্রলার চালকে পরিণত হন জেসমিন বেগম। তিনি বলেন তখন ভয় লাগতো, লজ্জাও করতো। যে নারী হয়ে ট্রলার চালাচ্ছি। লোকজন তাকিয়ে থাকতো। এখনো তাকিয়ে থাকে, তবে এখন আর আগের মতো লজ্জা লাগে না।

তিনি আরো বলেন, আমি তো কাজ করে খাচ্ছি, এটাতে আর কী সমস্যা? রজতরেখা নদীর এই খেয়া পারাপারে একেকজন যাত্রী ১০ টাকা করে দিয়ে থাকেন। সারাদিন ৫০ থেকে ৬০ জন যাত্রী পারাপার করেন তিনি। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয় তার।

সকাল ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে কাজ শুরু করেন তিনি। যা শেষ হতে রাত আটটা থেকে নয়টা বেজে যায়। রাতে বাড়িতে ফিরে রান্না করেন। তারপর মেয়েকে নিয়ে একসঙ্গে খাবার খান। এই খাবার পরদিনের জন্যও রেখে দেন।

ছোটবেলা থেকে একটি চোখে দেখেন না জেসমিন বেগম। অন্য চোখটির দৃষ্টিশক্তিও সীমিত। যখন তার বয়স পাঁচ বছর তখন চোখে হাম উঠেছিল। ডাক্তাররা বলেছিল এটা কাঁটা যাবে না। এটা থাকতেও পারে, আবার গলেও যেতে পারে। এখন তিনি কাছের জিনিস দেখতে পেলেও সামান্য দূরে তেমন দেখতে পান না।

কয়েক মাস আগে মুন্সীগঞ্জের সাবেক একজন জেলা প্রশাসক জেসমিনকে জেলা সদরে একটি চায়ের দোকান করে দিয়েছেন। তবে মেয়ের পড়াশোনার ক্ষতি হওয়ায় দোকানে বসতে পারেননি তিনি। সেখান থেকে তার মেয়ের স্কুল অনেক দূরে। আবার ওখানে থাকতে গেলে বাসা ভাড়া করতে হবে। এতে খরচও বাড়বে। ট্রলার চালিয়েই দুই মেয়ের একজনকে বিয়ে দিয়েছেন জেসমিন বেগম। ছোট মেয়েটিকে পড়াশোনা করাচ্ছেন।

ট্রলার নিজে চালালেও জেসমিন ইঞ্জিন চালু করতে পারেন না। এ কাজে যাত্রীরা সাহায্য করে জেসমিন বেগমকে। মাঝে মাঝে যাত্রীরা নানান কথা বলে। তখন কষ্টও পান। মাঝে মাঝে একা একা কান্না করেন। আবার লাইনের ট্রলার অনেক সমস্যা করে। যেটা দিয়ে মেশিন চালু করেন সেটা চুরি হয়ে যায়। তেল চুরি হয়ে যায়।

ফজরের নামাজের পর থেকে সারাদিন ট্রলার চালানোর মধ্যে থাকতে হয় তাকে। তবে এ কাজ তার ভালো লাগে না। সারাদিন রোদের মধ্যে কাজ করতে হয়। জেসমিন চান অন্য সবার মতো পরিবারের মধ্যে থাকতে। কষ্ট হলেও সন্তান আর সংসারের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন জেসমিন বেগম।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর