হাওর বার্তা ডেস্কঃ সরকারের পক্ষ থেকে আগামী ১ এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের ওপর সুদ ৬ শতাংশ বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ঋণের সুদহার একক অঙ্কে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এটি বাস্তবায়ন হলে ঋণগ্রহীতারা ৯ শতাংশ হারে ঋণ পাবে।
পক্ষান্তরে, যারা ব্যাংকে টাকা আমানত রাখবে, বিপরীতে তারা পাবে ৬ শতাংশ সুদ। বিগত দিনে এই সুদের হার সরকারের পক্ষ থেকে বেঁধে দেয়া হলেও, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অনীহার ফলে এটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তবে এবার সরকার খুব কঠোর অবস্থানে আছে। যে কোনো মূল্য নয়-ছয় সুদের হার বাস্তবায়নে সরকার বদ্ধপরিকর।
এটি বাস্তবায়ন করার পেছনে সরকারের যুক্তি আছে। ঋণের ওপর সুদের হার কম হলে ব্যবসায়ীরা স্বল্প সুদে ঋণ পাবে। যার ফলে ব্যবসায়, শিল্প এবং ক্ষুদ্র শিল্পখাতের প্রসার ঘটবে। উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে, আমদানি-রফতানি বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে, বেকারত্ব দূর হবে, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে ইত্যাদি।
আরও একটি বড় আর্থিক বাজার আছে; সেটি হল পুঁজিবাজার। এই পুঁজিবাজারও ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীল। ব্যক্তিক বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন। বিনিয়োগকারীরা স্বল্পসুদে ঋণ নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবে। ফলে পুঁজিবাজারের উন্নতি ঘটবে। এসবকিছু আমলে নিয়েই সরকার সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু এরও নেতিবাচক অনেক দিক আছে। ব্যাংককে তার ঋণগ্রহীতাদের ঋণ দিতে হলে টাকা দরকার। কিন্তু ব্যাংকের ঋণ দেয়ার জন্য টাকার উৎস কী? অবশ্যই জনগণের আমানত। কথা হচ্ছে, মাথাব্যথা দূর করতে গিয়ে, মাথাটাই যেন কেটে ফেলা না হয়; সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আমানতের ওপর সুদহার কমালে সাধারণ জনগণ ব্যাংকে টাকা রাখতে চাইবে না।
ফলস্বরূপ ব্যাংকের আমানত কমে যাবে। যার ফলে ব্যাংকের ঋণদান ক্ষমতা অত্যধিক হারে কমে যাবে। পুরো অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ব্যাংকগুলোর আমানত কমে গেলে ঋণদান ক্ষমতা কমে যাবে এবং ব্যাংকের আয়ও কমে যাবে। আর আয় কমে গেলে তার প্রভাব পড়বে রাজস্ব আদায়, শেয়ারবাজার ও কর্মসংস্থানে।
আমানতের সুদহার কমিয়ে দেয়ায় ব্যাংকগুলো পর্যাপ্ত আমানত পাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দেবে। আমানতের সুদ কমে গেলে সাধারণ মানুষ বেশি সুদের আশায় এখন সমবায়, এমএলএমসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখবে। ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ব্যাপারে সবাই অবগত আছে। খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে; যার ফলে ব্যাংকগুলোর আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কিন্তু ঋণখেলাপিদের শাস্তির পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে।
খেলাপি ঋণ, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং খাত উঠে দাঁড়াতে পারছে না। ইতিমধ্যে অনেক ব্যাংক আমানতের ওপর ৬ শতাংশ হারে সুদ কার্যকর করা শুরু করেছে। ব্যাংকিং খাতের অবস্থা এমনিতেই নড়বড়ে; তার ওপর যদি এতবড় একটি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে যাবে। যে উদ্দেশ্যে সুদের হার কমানো হয়েছে, সেটিই যদি অর্জন না হয় তাহলে এটি বাস্তবায়ন করাই বৃথা।
আমরা জানি, আর্থিক বাজার একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটির প্রভাব আরেকটিতে পড়ে। ডাকঘর সঞ্চয় স্কিম বা কর্মসূচির সুদের হার কমিয়ে অর্ধেক করেছে সরকার। বলা যায়, এটি হচ্ছে ‘নয়-ছয়’-এর প্রথম ধাক্কা। মূলত সাধারণ মানুষই ডাকঘরের মাধ্যমে অর্থ সঞ্চয় করে। আর এই সঞ্চয় কর্মসূচি শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলেই বেশি জনপ্রিয়। মূলত স্বল্পআয়ের মানুষরাই ডাকঘরে টাকা রাখতে যায় বেশি। এ মানুষগুলোর যাওয়ার জায়গা সীমিত হয়ে গেল। এমনিতে বাংলাদেশে অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্র খুবই সীমিত। প্রথমত, ব্যাংকে আমানত রাখা যায়। তবে ব্যাংক আমানতের সুদের হার সাধারণত কমই থাকে।
আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে নানা ধরনের জাতীয় সঞ্চয়পত্র। সাধারণ মানুষ, অবসর নিয়েছেন যারা, গৃহিণী, কিছুটা অসহায়- এসব মানুষের জন্য দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে এই স্কিম। কারণ, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কিছুটা বেশি এবং নিরাপদ। যারা ঝুঁকি নিতে চান না, তারাই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন বেশি। আর যারা ঝুঁকি নিতে জানেন, তাদের জন্য রয়েছে শেয়ারবাজার। তবে বাংলাদেশে শেয়ারবাজার এখনও কারসাজির বড় বাজার, যেখানে নজরদারির অভাব প্রচণ্ড।
এর বাইরে অন্যান্য দেশে সাধারণ মানুষের জন্য থাকে বন্ড বাজার। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একটি ভালো বন্ড বাজার তৈরি করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ পোস্ট অফিস তথ্যানুযায়ী, সঞ্চয়পত্রে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের স্থায়ী আমানত ছিল প্রায় ১৫,৫০০ কোটি টাকা। সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে গত বছরের জুলাই-ডিসেম্বরে এর পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১১,৭০০ কোটিতে। এখানকার আমানতকারীদের প্রায় ৭০ শতাংশ নিু ও মধ্যবিত্ত পরিবারের, যারা গ্রাম ও উপশহরে বসবাস করে।
সঞ্চয়পত্রের স্থায়ী আমানতের সুদের হার অর্ধেক কমানোয় তাদের আয় কমে যাবে এবং তাদের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে হিমশিম খাবে। ফলস্বরূপ জীবনযাত্রার মানের অবনতি ঘটবে।
ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণও বেড়ে গেছে। ফলে বেসরকারি খাতে ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। এতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, সুদের হার আর্থিক বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। বাজার অর্থনীতিতে সুদের হার নির্দিষ্ট করে দেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত, তা ভাবার বিষয়। সাধারণ মানুষ ব্যাংক বিমুখ হয়ে পড়বে এবং ব্যাংকিং খাতে এর প্রভাব মারাত্মকভাবে পড়তে পারে। তবে আশার কথা এই যে, ঋণের সুদের হার যদি ৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয় তাহলে ব্যবসায়ীদের ঋণ নেয়ার সক্ষমতার পরিমাণ বেড়ে যাবে; যার ফলে ব্যবসার সম্প্রসারণ হবে, উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু শর্ত একটাই, সেটি হল- আমানতের ওপর যেন নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে।
আমানতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়লে ঋণদানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সামগ্রিকভাবে এটি বাস্তবায়ন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং পুরো অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শক্তিশালী অর্থনীতি তৈরি করতে হলে ব্যাংক খাত শক্তিশালী করতে হবে। তাই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের এ বিষয়ে গভীরভাবে ভাবা উচিত।