বাউফলে বৃষ্টিতে ভিজছে খাদ্য গুদামের শতাধিক টন ধান

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পটুয়াখালীর বাউফলে সরকারিভাবে কেনা বগা খাদ্যগুদামের শতাধিক টন ধান পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। খাদ্যগুদাম থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে একটি পরিত্যক্ত ইটভাটায় প্রায় দেড় সপ্তাহ ধরে পড়ে থাকা ওই ধান এরই মধ্যে দুই দফা ভিজেছে বৃষ্টিতে। খাদ্যগুদামের ধান কেন খোলা আকাশের নিচে তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি বগা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাসান কবির। এদিকে সরকারিভাবে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার কথা থাকলেও বাউফলে সেই নির্দেশ পালিত না হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

উপজেলা কৃষি বিভাগের করা কালাইয়া ইউনিয়নের কৃষক তালিকায় ১ নম্বরে রয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবেক চিফ হুইপ আসম ফিরোজের আপন ভাই একেএম ফরিদ মোল্লার নাম। যদিও তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার। বর্তমানে কালাইয়া খাদ্যগুদামের সরবরাহ ঠিকাদারিও তিনিই করছেন। এছাড়াও তিনি কাজ করেন এলজিইডিসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে। অভিযোগ উঠেছে, কালাইয়া খাদ্যগুদামের বেশিরভাগ ধান মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে তিনিই কৃষকের কাছ থেকে কম দামে কিনে বেশি দামে সরকারকে সরবরাহ করেন। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। নিজেকে কৃষক দাবি করে ফরিদ মোল্লা বলেন, ‘আমি মাত্র ৩ টন ধান সরকারের কাছে বিক্রি করেছি।’

বাউফল উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দফতর সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, গত বছরের ৯ ডিসেম্বর থেকে ২৬ টাকা কেজি দরে কৃষকের কাছ থেকে আমন ধান কেনার কর্মসূচি শুরু করে সরকার। এ হিসাবে ৪০ কেজির এক বস্তা ধানের দাম দাঁড়ায় ১ হাজার ৪০ টাকা। সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এ বছর বাউফলের কালাইয়া এবং বগা খাদ্যগুদামের ধান কেনার কথা ছিল ২ হাজার ৬২৪ টন। ৫ মার্চ শেষ দিন পর্যন্ত ২ হাজার ৭৪ টন ধান কেনার কথা জানায় উপজেলা খাদ্য বিভাগ। যদিও এ পরিমাণ ধানের মজুদ ছিল না দুটি খাদ্যগুদামে।

বিধান অনুযায়ী, কৃষক সরাসরি খাদ্যগুদামে ধান নিয়ে আসবে এবং গুদাম কর্মকর্তারা ধান বুঝে নেয়ার পর তা গুদামে ঢোকাবে। ক্রয়কৃত ধান গুদামের বাইরে থাকার কোনো সুযোগ নেই। ক্রয়কৃত ধান এবং গুদামের মজুদে হেরফের থাকার তথ্য পাওয়ার পর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বগা খাদ্যগুদামের কয়েকশ’ টন ধান পড়ে আছে খাদ্যগুদাম থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে আলতাফ মিয়ার একটি পরিত্যক্ত ইটভাটায়। শুক্রবার দুপুরে তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে গিয়ে এ তথ্যের সত্যতা মেলে। সেখানে তখন বেশ কিছু শ্রমিক সাধারণ বস্তায় থাকা ধান ঝেড়ে পরিষ্কার করে খাদ্যগুদামের সিলযুক্ত প্রতিটি ৪০ কেজির বস্তায় ভরছিলেন।

এ দৃশ্যের ভিডিও ও ছবি তুলতে গেলে প্রথমে বাধা দেন শ্রমিকরা। ধানের মালিক স্থানীয় মোতাহার হাওলাদারের অনুমতি ছাড়া কোনো ছবি তোলা বা ভিডিও করা যাবে না বলে জানান তারা। এ সময় সেখানে মোতাহার হাওলাদারের ছোট ভাই আতাহার হাওলাদারও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই বগা খাদ্যগুদামে ধান দেন। কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে গুদামে সরবরাহ করেন তিনি।’ সেখানে কর্মরত শ্রমিকরা জানান, ‘ধান পরিষ্কার করে সরকারি বস্তায় ঢোকানোর জন্য বস্তাপ্রতি ১২ টাকা করে পাই আমরা। সরকারি এই বস্তাও মোতাহার হাওলাদারই এনে দিয়েছেন।’

পরিত্যক্ত ইটভাটার আশপাশে থাকা লোকজন জানান, ৮-১০ দিন ধরে এ ধান এখানেই রয়েছে। ধানের ওপর একটি পাতলা পলিথিন দেয়া থাকলেও তাতে কোনো লাভ হয়নি। বৃহস্পতি ও শনিবার দুই দিন দুই দফা বৃষ্টিতে ভিজেছে ধান।

উপজেলা খাদ্য দফতর সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, মোতাহার হাওলাদার এবার এক ছটাক ধানও বিক্রি করেননি খাদ্যগুদামে। এমনকি তার নাম উপজেলা কৃষি বিভাগের কৃষকের তালিকায়ও নেই। সেক্ষেত্রে তিনি কী করে এসব ধান মজুদ এবং সরকারি গুদামে দিচ্ছেন- জানতে চাইলে বগা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাসান কবির বলেন, ‘উনি (মোতাহার) কৃষক নন। তবে কৃষকরাই তার মাধ্যমে ধান পরিষ্কার করে খাদ্যগুদামে এনে বিক্রি করেন।’

ধান ক্রয় করার সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে বৃহস্পতিবার অথচ শুক্রবার (মোতাহার হাওলাদারের জিম্মায়) ধান পরিষ্কার এবং তা খাদ্যগুদামের সরকারি বস্তায় ভরা হচ্ছে। এ ধান আপনারা কী করে কিনবেন? তাছাড়া খাদ্যগুদামের সরকারি বস্তাই বা তার কাছে গেল কী করে- জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি হাসান কবির।

মোতাহার হাওলাদার বলেন, ‘আমি কৃষক নই, ধানের ব্যবসা করি। ওই ধান খাদ্যগুদামের। আমার শ্রমিকরা আবর্জনা পরিষ্কার করে সরকারি বস্তায় ভরে গুদামে পৌঁছে দেন। এজন্য আমি পারিশ্রমিক পাই।’ বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে পটুয়াখালী খাদ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ধান পরিষ্কার করে গুদামজাত করার জন্য লোক নিয়োগের কোনো বিধান খাদ্য বিভাগে নেই। এজন্য আলাদা কোনো বরাদ্দও দেয় না সরকার।’ জানা যায়, বাউফলের এমপি আ স ম ফিরোজের ভাই ফরিদ মোল্লার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত এই মোতাহার মোল্লা।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বাউফলের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকারিভাবে ধান-চাল কেনার মৌসুম এলেই এখানে সক্রিয় হয়ে ওঠে একটি পরিচিত সিন্ডিকেট। বহু বছর ধরে সক্রিয় এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা সাধারণ কৃষকদের খাদ্যগুদামের আশপাশে ভিড়তে দেয় না। এরা কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি বস্তা (৪০ কেজি) ধান ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায় ক্রয় করে সরকারের কাছে বিক্রি করে ১ হাজার ৪০ টাকায়। এক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে প্রতি বস্তায় তারা লাভ করে ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ টাকা। কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার ক্ষেত্রে নানা ভয়ভীতিও দেখায় তারা। ধান ক্রয়ের ক্ষেত্রে আদ্রতা যাচাইসহ নানা বিষয়ের কথা উল্লেখ করে তারা বলে যে, কৃষক সরাসরি খাদ্য বিভাগের কাছে গেলে ধান বিক্রি করতে পারবে না। কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে মধ্যস্বত্বভোগীরা এ ধান বিক্রি করতে পারবে।

এভাবে ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে ধান কেনার পাশাপাশি কৃষকের সই রাখা হয় ব্যাংকের চেকে। পরে ব্যাংক থেকে সেই টাকা তুলে নেয় সিন্ডিকেটের সদস্যরা। বাউফলে এ বছর সরকারিভাবে যে ধান ক্রয়ের হিসাব দেয়া হয়েছে, তার প্রায় পুরোটাই প্রকৃতপক্ষে এভাবেই সংগৃহীত হয়েছে। বিষয়টি খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারাও জানেন। কিন্তু সব জেনেশুনেও তারা পক্ষে ছিলেন মধ্যস্বত্বভোগীদের। মাঝখান থেকে লোকসানের শিকার হলেন নিরীহ কৃষকরা।’

সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে কিনে বেশি দামে সরকারের কাছে বিক্রি করার বিষয়ে জানতে চাইলে কালাইয়া খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ দত্ত বলেন, ‘আমরা প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকেই ধান কিনেছি। এক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি। তাছাড়া ধান বিক্রয়ের টাকা আমরা ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করি। এখানে অন্য কারও সুযোগ নেয়ার কোনো উপায় আছে বলে আমি মনে করি না।’

প্রকৃত কৃষক প্রশ্নে এমপি আ স ম ফিরোজের ভাই একেএম ফরিদ মোল্লা কী করে কৃষক হলেন- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কৃষি বিভাগ ভালো বলতে পারবে। কৃষকের ওই তালিকা তারা করেছে।’ এ ব্যাপারে বাউফলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের পর যেমন ধান ক্রয় করার কোনো সুযোগ নেই, তেমনি খাদ্যগুদামের ধান বাইরে রাখাও বিধানবর্হিভূত। পুরো বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে আমরা ব্যবস্থা নেব।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর