দাম বাড়ানোর পর বিদ্যুতে লোকসান ভর্তুকি কেন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পাইকারি, খুচরা ও সঞ্চালন-তিন ক্ষেত্রেই বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়িয়েছে সরকার। এর মধ্যে সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৬ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। ফলে চলতি বছর বিদ্যুৎ বিল বাবদ জনগণের ব্যয় বাড়বে ২ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। গত মাসের শেষ  সপ্তাহে এ ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
জানা গেছে, গত ১০ বছরে বিদ্যুতের দাম গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে ৯ বার। এতে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ করা বিদ্যুতের গড় দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সর্বশেষ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত দাম কার্যকর হয়েছে ১লা মার্চ। যদিও গত ১০ বছরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় ৫৬ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। আর বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে ৫২ হাজার ২৬০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও লোকসান ও ভর্তুকি কেন। তাদের মতে, অনেক সাফল্য সত্ত্বেও বিদ্যুৎ খাতে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হচ্ছে। মূলত: দফায় দফায় দাম বাড়ানোর মাধ্যমে বিদ্যুৎখাতের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অপচয়ের বোঝা এখন জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তিও বাড়ছে। তারা জানান, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্রই লাভজনক হবে। তখন বিদ্যুতের দামও বাড়াতে হবে না, সরকারকে ভর্তুকিও দিতে হবে না।
এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বিডি রহমত উল্লাহ উদাহরণ দিয়ে বলেন, সারা দেশের বিদ্যুৎ বিভাগের মেশিনারিজের জন্য ২০ থেকে ২৫ বছরের অপচয় বাবদ টাকা জমা করা হয়। অপারেটিং খরচ কেটে রাখা হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে গড়ে বিদ্যুতের মূল্য ৪ টাকা ৮ পয়সার উপরে হওয়ার কথা নয়।
কিন্তু লোকসান কেন? ভর্তুকি কেন? এর উত্তর হলো- জনগণের বারটা বাজানোর জন্য চুরি করা, বিদেশে টাকা পাচার ও দুর্নীতির জন্য দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
তথ্যমতে, ২০০৯ সালের শুরুতে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি। সে সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৭টি। বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে পাঁচগুণ হয়েছে। আর উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৬৩০ মেগাওয়াট। ২০০৯ সালে দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ১০ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে প্রায় চারগুণ হয়েছে। এ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
এদিকে, গত ১০ বছরের বিদ্যুতের দাম বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। নতুন মূল্যহার কার্যকরের ফলে এখন তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৭ টাকা ১৩ পয়সা। অর্থাৎ, ১০ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৯১.১৫ শতাংশ।
নতুন মূল্যহার কার্যকরের ফলে সাধারণ গ্রাহককে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম গুনতে হবে ৪ টাকা ১৯ পয়সা। এছাড়া ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ৫ টাকা ৭২ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ও ৩০১ থেকে ৪০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৩৪ পয়সা হারে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া ৪০১ থেকে ৬০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৯ টাকা ৯৪ পয়সা ও ৬০০ ইউনিটের ওপরে প্রতি ইউনিটে ১১ টাকা ৪৬ পয়সা হারে বিল গুনতে হবে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছর সারা দেশে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হবে ৭ হাজার ১৩৫ কোটি ইউনিট। এতে গ্রাহকদের ব্যয় বাড়বে প্রায় ২ হাজার ৬২৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
০০
তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) গ্রাহকরা। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী এ সংস্থার প্রতি ইউনিটে গড় বিদ্যুৎ বিল ছিল ৬ টাকা ২৬ পয়সা। এখন থেকে তা বেড়ে হয়েছে ৬ টাকা ৫৮ পয়সা। অর্থাৎ বিদ্যুৎ বিল গড়ে বেড়েছে ৫.১১ শতাংশ।
চলতি বছর আরইবির বিদ্যুৎ বিক্রির সম্ভাব্য পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৫৮১ কোটি ৯০ লাখ ইউনিট। এতে আরইবির গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল বাবদ ব্যয় বাড়বে ১ হাজার ১৪৬ কোটি ২১ লাখ টাকা।
বিদ্যুৎ ব্যবহারের দিক থেকে এর পর রয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পিডিবির বিদ্যুৎ বিল গড়ে বেড়েছে ৫.৭৩ শতাংশ। ২০২০ সালে পিডিবির গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল বাবদ ব্যয় বাড়বে ৫১৩ কোটি ১১ লাখ টাকা।
সূত্রমতে, ঢাকা শহরের দক্ষিণাংশে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) বিদ্যুৎ বিল গড়ে বেড়েছে ৫.৯০ শতাংশ। ডিপিডিসির গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল বাবদ ব্যয় বাড়ছে ৪৩৫ কোটি ১০ লাখ টাকা।
এদিকে ঢাকা শহরের উত্তরাংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা ইলেকট্রিক সাল্পাই কোম্পানির (ডেসকো) বিদ্যুৎ বিল গড়ে বেড়েছে ৫.৭৭ শতাংশ। ডেসকোর গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল বাবদ ব্যয় বাড়ছে ২৫২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
দেশের উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) বিদ্যুৎ বিল গড়ে বেড়েছে ৫.৪৪ শতাংশ। চলতি বছর নেসকোর গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল বাবদ ব্যয় বাড়ছে ১৪৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
এদিকে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। এখানে (ওজোপাডিকো) বিদ্যুৎ বিল গড়ে বেড়েছে ৫.৪০ শতাংশ। চলতি বছর ওজোপাডিকোর গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল বাবদ ব্যয় বাড়ছে ১৩৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
উল্লেখ্য, খুচরা পর্যায়ের পাশাপাশি পাইকারি (বাল্ক) বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রতি ইউনিটে ৪০ পয়সা বা ৮.৪ শতাংশ। এর পরও বাল্ক খাতে প্রতি ইউনিটে পিডিবির ঘাটতি রয়ে গেছে ৪৭ পয়সা। এ ঘাটতি পোষাতে সরকারকে বিদ্যুৎ খাতে চলতি বছর ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।
এদিকে তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০১০ সালের মার্চে প্রথম বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। পরের বছর (২০১১ সাল) গ্রাহক পর্যায়ে দুই দফা বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাড়ানো হয় ৫ শতাংশ ও ডিসেম্বরে ১৩.২৫ শতাংশ। এতে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪ টাকা ৬৭ পয়সা। ২০১২ সালেও খুচরা বিদ্যুতের দাম দুই দফা বাড়ানো হয়। এর মধ্যে ফেব্রুয়াারিতে বাড়ে ৭.০৯ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে বাড়ে ১৫ শতাংশ। এদিকে, ২০১৭ সালে ডিসেম্বরে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫.৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্যহার ৫.৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। এতে গড় মূল্যহার দাঁড়িয়েছে ৭ টাকা ১৩ পয়সা।
ভোক্তা সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে ‘অযৌক্তিক’ ব্যয় না কমিয়ে সরকার জনগণের ব্যয়ভার বাড়িয়ে দিয়েছে। বরাবরই গতানুগতিক ঐকিক নিয়মে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রয়োজন না থাকলেও বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ দেয়া হচ্ছে। এ কারণেই পিডিবির ঘাটতি বাড়ছে। এ ধরনের কাজের দায়ভার চাপানো হচ্ছে জনগণের ওপর।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর