আজ শুভ জন্মদিন পপ সম্রাট

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলা পপসংগীতের অবিসংবাদিত সম্রাট আজম খান। তার মাধ্যমেই উন্মোচিত হয়েছিল এ সংগীতের এক অন্যধারা। দেশীয় পপগানের আকাশে তিনি ঘটিয়েছিলেন নতুন সূর্যোদয়। যে কারণে বাংলাদেশের পপসংগীতাঙ্গনের সব তারকা নির্দ্বিধায় ভালোবাসা আর অসীম শ্রদ্ধায় তাকে বসিয়েছেন আকাশসম সম্মানের আসনে। আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের পপ সঙ্গীত জগতের সেই কিংবদন্তী পুরুষ জনপ্রিয় গায়ক গুরু আজম খানের জন্মদিন।

আজম খানের ছেলেবেলা
১৯৫০ সালের এই দিনে পুরান ঢাকার আজিমপুরে আজম খানের জন্ম হয়। তার পুরো নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান, মা জোবেদা খাতুন। শৈশবে তার পাঁচটি বছর কাটে আজিমপুর কলোনিতে। তারা চার ভাই ও এক বোন ছিল। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু দেশের প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে তিনি সঙ্গীত গুরু হিসেবে পরিচিত। আজম খানের জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ (রেল লাইনের ওই বস্তিতে), ওরে সালেকা, ওরে মালেকা, আলাল ও দুলাল, অনামিকা, অভিমানী, আসি আসি বলে ইত্যাদি।

১৯৫৫ সালে তিনি প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে বেবিতে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তার বাবা কমলাপুরে বাড়ি বানান। এরপর থেকে সেখানে বসতি তাদের। সেখানে তিনি কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে প্রাইমারিতে এসে ভর্তি হন। তারপর ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মুক্তিযুদ্ধের পর পড়ালেখায় আর অগ্রসর হতে পারেননি।

মুক্তিযোদ্ধা আজম খান
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে আজম খান পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তখন তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসঙ্গীত প্রচার করেন। ১৯৭১ সালে আজম খানের বাবা আফতাব উদ্দিন খান সচিবালয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন। বাবার অনুপ্রেরণায় যুদ্ধে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে, তিনি পায়ে হেঁটে আগরতলা চলে যান। আগরতলার পথে সঙ্গী হন তার দুই বন্ধু। এ সময় তার লক্ষ্য ছিল সেক্টর ২ এ খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে যোগদান করা। আজম খান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ২১ বছর বয়সে। তার গাওয়া গান প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণ যোগাতো। তিনি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতের মেলাঘরের শিবিরে। যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সমুখ সমরে অংশ নেয়া শুরু করেন। কুমিল্লার সালদায় প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন। এর কিছুদিন পর তিনি পুণরায় আগরতলায় ফিরে আসেন। এরপর তাকে পাঠানো হয় ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। আজম খান ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইন-চার্জ। আর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্ণেল খালেদ মোশাররফ। ঢাকায় তিনি সেকশান কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন। আজম খান মূলত যাত্রাবাড়ি-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল তার নেতৃত্বে সংঘটিত “অপারেশান তিতাস”। তাদের দায়িত্ব ছিল ঢাকার কিছু গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করার মাধ্যমে বিশেষ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান শেরাটন হোটেল), হোটেল পূর্বাণী’র গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো। তাদের লক্ষ্য, ওইসব হোটেলে অবস্থানরত বিদেশীরা যাতে বুঝতে পারে যে দেশে একটা যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে তিনি তার বাম কানে আঘাতপ্রাপ্ত হন। যা পরবর্তীতে তার শ্রবণক্ষমতায় বিঘ্ন ঘটায়। আজম খান তার সঙ্গীদের নিয়ে পুরোপুরি ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। এর আগে তারা মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে সংগঠিত যুদ্ধে পাক সেনাদের পরাজিত করেন।

গায়ক আজম খান
আজম খানের কর্মজীবনের শুরু প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকের শুরুতে। ১৯৭১ সালের পর তার ব্যান্ড উচ্চারণ এবং আখন্দ (লাকী আখন্দ ও হ্যাপী আখন্দ) ভাতৃদ্বয় দেশব্যাপী সঙ্গীতের জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেক ড্রামে আর নিজেকে প্রধান ভোকাল করে করলেন অনুষ্ঠান। ১৯৭২ সালে বিটিভিতে সেই অনুষ্ঠানের এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে ও চার কালেমা সাক্ষী দেবে গান দু’টি সরাসরি প্রচার হলো প্রচার হলো। ব্যাপক প্রশংসা আর তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দিলো এ দু’টো গান। দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়ে গেলো তাদের দল। ১৯৭৪-১৯৭৫ সালের দিকে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাংলাদেশ (রেললাইনের ঐ বস্তিতে) শিরোনামের গান গেয়ে হৈ-চৈ ফেলে দেন। তার পাড়ার বন্ধু ছিলেন ফিরোজ সাঁই। পরবর্তীকালে তার মাধ্যমে পরিচিত হন ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজের সাথে। এক সাথে বেশ কয়েকটা জনপ্রিয় গান করেন তারা। এরই মধ্যে আরেক বন্ধু ইশতিয়াকের পরামর্শে সৃষ্টি করেন একটি এসিড-রক ঘরানার গান জীবনে কিছু পাবোনা এ হে হে! তিনি দাবী করেন এটি বাংলা গানের ইতিহাসে- প্রথম হার্ডরক!

পারিবারিক জীবন
১৯৮১ সালের ১৪ই জানুয়ারি ঢাকার মাদারটেকে তিনি সাহেদা বেগম কে বিয়ে করেন। তখন তার বয়স ছিল ৩১ বছর। তার এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। প্রথম সন্তানের নাম ইমা খান এবং দ্বিতীয় সন্তানের হৃদয় খান এবং তৃতীয় সন্তানের নাম অরণী খান। সহধর্মিনী মারা যাবার পর থেকে একাকী জীবনযাপন তার। আজম খান দুই মেয়ে এবং এক ছেলের জনক। এছাড়া আছেন চার ভাই ও এক বোন।

মৃত্যু
পপসম্রাট আজম খান দীর্ঘদিন দূরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধির সঙ্গে লড়াই করে ৫ জুন, ২০১১ইং তারিখ, রোববার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর