আ.লীগের অনেক নেতা পাপিয়া কানেকশনে উদ্বিগ্ন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রিমান্ডে মুখ খুলতে শুরু করেছেন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যুব মহিলা লীগ থেকে  আজীবনের জন্য বহিষ্কৃত শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দলের একাধিক সিনিয়র নেতা, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও ধনীর দুলালদের নাম বলেছেন তিনি। তারকা হোটেল ওয়েস্টিনের স্যুট, বার ও সুইমিংপুলে যাদের সঙ্গে আড্ডা জমত তাদের ব্যাপারেও মুখ খুলছেন পাপিয়া ও তার স্বামী। ৩ মামলায় ১৫ দিনের রিমান্ডে বিমানবন্দর থানায় পুলিশ হেফাজতে পাপিয়াকে দফায় দাফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে  সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। এছাড়া অপর ২ আসামি সাব্বির খন্দকার ও শেখ তায়্যিবা রয়েছে রিমান্ডে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা পাপিয়া দম্পতির ঘন ঘন বিদেশ যাতায়াত এবং বিদেশ কানেকশন খতিয়ে দেখছেন। বিদেশ থেকে অনেক তরুণী এনে ওয়েস্টিন হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে রেখে প্রভাবশালীদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করতেন বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। পাপিয়ার বন্ধু তালিকায় বেশ কয়েকজন বিদেশি তরুণী রয়েছে। তাদের দেশে এনে ওয়েস্টিনের স্যুটে রাখা হতো। তারা পাপিয়ার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গ দিতেন। হোটেলের মদ ও সিসা বারে পাপিয়ার অবাধ যাতায়াত ছিল। তার আড্ডা আসরে আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতা, মন্ত্রী ও এমপিদের দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে। ওয়েস্টিন হোটেলের একাধিক স্টাফ র‌্যাব-পুলিশকে জানিয়েছেন, পাপিয়া ও তার লোকজন হোটেলের নিয়ম-কানুন তোয়াক্কা করতেন না। প্রভাবশালীদের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় পাপিয়াকে সমীহ করে চলতেন হোটেলের সব পর্যায়ের স্টাফ। দাপটের কারণে বেশির ভাগ স্টাফই হয়ে পড়েছিলেন তার হাতের পুতুল। তাছাড়া বিভিন্ন সময় বয় ও ক্লিনারদের ভালো বখশিশও দিতেন তিনি।

এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল মঙ্গলবার জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরই যুব মহিলা লীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়াকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে। তিনি আরো বলেন, অন্যায় যারাই করবে, অপকর্ম যারাই করবে, তাদের পরিচয় যেটাই হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

দলীয় সূত্র বলছে, পাপিয়া গ্রেপ্তার এবং ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যের পর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন আওয়ামী লীগের অনেক প্রথম সারির নেতা। কারণ ওয়েস্টিন হোটেলে পাপিয়ার আখড়ায় নিয়মিতই যাতায়াত ছিল তাদের অনেকের। অসমর্থিত আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, পাপিয়ার মোবাইলে কয়েকজন মন্ত্রীর মোবাইল নম্বর পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত নানা সময়ে এদের সঙ্গে কথা বলেছেন পাপিয়া। এছাড়া তার মোবাইলে ৩৩ এমপির তালিকা পাওয়া গেছে। এই ৩৩ এমপির সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। এ অবস্থায় নিজেদের নাম প্রকাশ হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন তারা। কেননা, এতে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার পাশাপাশি হুমুকির মুখে পড়বে রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও।

জাল মুদ্রা সংক্রান্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) কায়কোবাদ কাজী বলেছেন, রিমান্ডে পাপিয়াকে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনি যুব মহিলা লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক এক নারী সাংসদের সঙ্গে তার সখ্যতার কথা বলছেন। ওই ৩ জনের ছত্রছায়ায় থেকে তিনি রাজনীতিতে সরব ছিলেন বলেও দাবি করছেন। এক প্রশ্নের জবাবে কায়কোবাদ জানান, মুদ্রা পাচারের ব্যাপারে পাপিয়া ও তার স্বামী সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলছেন না। ঘুরিয়ে পেচিয়ে জবাব দিচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। গতকাল ছিল রিমান্ডের প্রথম দিন।

অন্যদিকে পাপিয়ার জলকেলির একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে ৫ জন মেয়ের সঙ্গে সুইমিং পুলে জলকেলি করতে দেখা যায় তাকে। এ সময় বিভিন্ন গানের সঙ্গে পানির মধ্যেই তাল মিলিয়ে সহযোগীদের সঙ্গে নেচেছেন পাপিয়া। এর আগে পাপিয়ার একটি টিকটক ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। একটি পিস্তল হাতে সেই টিকটক ভিডিও বানিয়েছিলেন পাপিয়া নিজেই। এতে ‘গোলাবি আঁখে’ শিরোনামের হিন্দি গানে পারফর্ম করতে দেখা যায় তাকে। পাপিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ভাইরাল হয়।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাপিয়ার সান্নিধ্য পেতে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি নিয়মিত ওয়েস্টিনে যেতেন। অনেকে সকালের নাস্তা করতেন সেখানে। প্রশাসনের অনেকের সঙ্গে ছিল তার দহরম মহরম সম্পর্ক। নরসিংদীর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও মাসের অধিকাংশ সময় তার কাটত ঢাকায়। বাসার চেয়ে ওয়েস্টিনে সময় দিতেন বেশি। বিমানবন্দর থেকে লোকজন রিসিভ করতেন তিনি। তার পরিচিত বলয়ে থাই, সিঙ্গাপুর ও রাশিয়ান তরুণী রয়েছে বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।

প্রসঙ্গত, গত শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দেশত্যাগের সময় ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পাপিয়াসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। গ্রেপ্তারকৃত অন্যরা হলেন- পাপিয়ার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন (৩৮), সাব্বির খন্দকার (২৯) ও শেখ তায়্যিবা (২২)। তাদের কাছ থেকে ৭টি পাসপোর্ট, নগদ ২ লাখ ১২ হাজার ২৭০ টাকা, ২৫ হাজার ৬০০ টাকার জাল মুদ্রা, ১১ হাজার ৯১ ইউএস ডলারসহ বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়। এরপর ওই রাতে নরসিংদীর বাসায় এবং রবিবার ভোরে হোটেল ওয়েস্টিনে তাদের নামে বুকিং করা বিলাসবহুল প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে অভিযান চালানো হয়।

এছাড়া ফার্মগেট এলাকার ২৮ নম্বর ইন্দিরা রোডে অবস্থিত রওশন’স ডমিনো রিলিভো নামক বিলাসবহুল ভবনে তাদের ২টি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে একটি বিদেশি পিস্তল, ২টি পিস্তলের ম্যাগজিন, ২০ রাউন্ড পিস্তলের গুলি, ৫ বোতল বিদেশি মদ ও নগদ ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, ৫টি পাসপোর্ট, ৩টি চেক, বিদেশি মুদ্রা, বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি ভিসা ও এটিএম কার্ড জব্দ করে র‌্যাব। এ প্রেক্ষাপটে রবিবারই নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়াকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়।

জাল টাকা সরবরাহ, মাদক ব্যবসা, অনৈতিক কাজ, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক রাখার অভিযোগে পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন ৩ মামলায় মোট ১৫ দিনের এবং সাব্বির খন্দকার ও শেখ তায়্যিবাকে বিমানবন্দর থানার মামলায় ৫ দিনের রিমান্ডে আছেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর