ছিলেন পঙ্গু হওয়ার শঙ্কায় হলেন ফাস্ট বোলার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ একটু একটু করে বড় হচ্ছিল ছেলে। ততোই যেন বাবা-মায়ের বুকে চেপে বসছিল পাথর। ভয়ে মা আচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদেন। এই সন্তান পৃথিবীতে আসুক সেটাও তিনি চাননি। কারণ নিজের প্রথম সন্তানও জন্মের পর মারা গেছে।  ফুটবলার বাবা জাহিদুল ইসলামের মনে শন্তি নেই এক ফোঁটাও। একটাই ভাবনা শেষ পর্যন্ত ছেলেটা কি পঙ্গুই হয়ে যাবে! যাকে নিয়ে কত স্বপ্ন তাদের। কিন্তু যতই বড় হচ্ছে পা দুটি বিদ্রোহ করতে শুরু করেছে। দাঁড়াতে  দৌড়াতে গেলেই ছোট ছোট পা এক হয়ে যায়।

হাঁটতেও  যেন তার ভীষণ ভয়। রোগটা কী? ধরাই যাচ্ছিল না। তবে এক চিকিৎসক দিলেন আজব বুদ্ধি । পঙ্গুত্ত থেকে বাঁচাতে হলে পায়ে পড়াতে হবে লোহার জুতো! হাজার হোক বাবা মায়ের মন বলে কথা। যেভাবেই হোক ভালো করতে হবে। তাই ৩ হাজার টাকা খরচ করে সেই জুতো বানিয়ে পড়িয়ে দেয়া হল মুকিদুল ইসলামের পায়ে। যাকে আদর করে সবাই মুগ্ধ বলেই ডাকে। কিন্তু কে জানতো নামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড় হতে হতে সত্যিকারের মুগ্ধতাই ছড়াবেন তিনি। লোহার জুতোকে গুড়িয়ে দিয়ে বল হাতে ছুটবেন ক্রিকেট মাঠে! হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে (বিপিএল) যে তরুণ ৫ ম্যাচে নিয়েছেন ৪ উইকেট। শুধুকি তাই, বলও করছেন ১৪৩ কিলোমিটার গতিতে! তার সামনে এখন জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন। নিজেকে প্রতি দিনই একটু একটু করে এগিয়ে নিচ্ছেন মাশরাফি বিন মুর্তজাদের জায়গা দখলে নিতে।
যে কারণে বাবা-মায়ের ভয়
শুরুতেই বলেছি, প্রথম সন্তান জন্মের কিছু দিন পরেই মারা যায়। তাই  দ্বিতীয় সন্তানই চাননি মুগ্ধের মা মমতাজ বেগম বিথী। তার ওপর পায়ে বিরল রোগ। মুগ্ধ বলেন, ‘যখন আমার ২ বছর বয়স, আমি ঠিক মতো দাঁড়াতেই পারতাম না। আর  হাঁটতে বা দৌড়াতে গেলে দুটি পা এক হয়ে যেত। জানি না কি রোগ হয়েছিল। পুষ্টিহীনতা নাকি ঠিক জানি না। তবে চিকিৎসক বলেছেন যে অন্য সাধারণ ছেলেদের মত হবে না। যদি পা ঠিকও হয় জোড়ে দৌড়াতে পারবো না। খেলাধুলারতো প্রশ্নই ওঠে না। আর পা ঠিক করতে হলে পড়ে থাকতে হবে লোহার জুতো। সেই জুতো তৈরি করতে  সেই সময় (২০০২) তিন থেকে  চার হাজার টাকা লেগেছিল। আমি সাড়ে ৩  বছর সেই জুতো পড়ে থাকি। এখনতো আমার প্রায় ২০ বছর। আর মজার বিষয় হলো সেই চিকিৎসক এখন আমাকে দেখে খুব অবাক। আমি পুরোটা আল্লাহর রহমত হিসেবেই দেখি। আর সেই জুতো আমি এখনো রেখে দিয়েছি।’
যেভাবে ক্রিকেটে
তবে মুকিদুল এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেন না তার সেই সব দিনের কথা। যখন তিনি সাধারণ শিশুদের মতো খেলতেও পারতেন না। লোহার জুতোকে যেন পায়ের শিকলই মনে হতো। চিকিৎসকের কড়া মানা, কোনভাবেই দৌড়াতে পারবে না। ৩ বছর বয়সেই চোখের সামনে অন্ধকার ভবিষ্যৎ। এরপরও কিভাবে ক্রিকেটে আসা! মুগ্ধ বলেন, ‘ছোট বেলা থেকেই ক্রিকেট খেলা ভালো লাগতো। কিন্তু আমার পায়ে একটু সমস্যা ছিল। তাই সাহস হতো না। তবে বাবাকে দেখেছি ফুটবল খেলতে। তিনি রংপুর বিভাগে খেলেছেন। তাই খেলার প্রতি ভীষণ টান ছিল। কিন্তু কি করবো! আমার যখন তিন বছর তখন দু পায়ে হাঁটতে পারতাম না। তাই বাবা কোনোভাবেই খেলতে দিতে রাজি ছিলেন না। কারণ পায়ের সমস্যা নিয়ে যদি খেলি তাহলে পঙ্গুই হয়ে যেতে পারি। কিন্তু আমার ইচ্ছার কাছে সবাই হার মানে। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন রংপুরের মিঠাপুকুর আমার গ্রামে ক্রিকেট খেলতে শুরু করি। বাবাতো কত মেরেছে আমাকে না খেলার জন্য। কিন্তু থামিনি।’
জীবন বদলে দেয়া বিকেএসপির ট্রায়াল
মুগ্ধ তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র। পাড়ায় টেপ টেনিস বলে দারুণ খেলেন। একদিন খবর পান রংপুর জেলা স্টেডিয়ামে হবে বিকেএসপিতে ভর্তির ট্রায়াল। অনেক অনুরোধ করে শেষ পর্যন্ত বাবাকে রাজি করিয়ে ১০ টাকার ফর্ম কিনে পরীক্ষা। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিকেএসপি থেকে বয়সভিত্তিক সব দলে খেলেছেন। সবশেষ বিপিএলে খেলেছেন রংপুরের হয়েই। ছিলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে এক মাত্র প্রস্ততি ম্যাচে। নিজের জীবনের বড় সেই পরিবর্তন নিয়ে মুগ্ধ বলেন, ‘বিকেএসপির ট্রায়াল, বাবাকে অনেক কষ্টে রাজি করালাম। প্রাথমিক ট্রায়াল, ক্যাম্পে টিকে যাওয়ার পর ভর্তি হলাম সাভার বিকেএসপিতে। সেখানে খেলেছি সব বয়সভিত্তিক দলে। অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও খেলেছি।’  তবে এত বাঁধা পেরিয়ে কিভাবে পেসার হলেন! যেখানে তার  দৌড়ানোরই কথা ছিল না! মুগ্ধ বলেন, ‘আমার পেসার হওয়ার পিছনে বড় অবদান রুশো স্যারের। তিনি বলতেনÑ ব্যাটিং মাঝেমাঝে, বোলিংয়ের দিকে বেশি জোর দাও। তখন গতি ছিল। লাইন-লেন্থ হয়তো খারাপ ছিল, কিন্তু গতিটা ছিল। উনি সেটা বুঝেছেন। তারপর ওনার কাছ থেকেই শেখা পেস বোলিংটা। অনূর্ধ্ব-১৪ থেকে অনূর্ধ্ব-১৯, চার বছরের মধ্যে পেসার হিসেবে তৈরি করেন  আমাকে। ইনজুরির কারণে যুব বিশ্বকাপ খেলতে নিউজিল্যান্ড যেতে পারিনি। খেলার বাইরে ছিলাম এক বছর। সবশেষ প্রিমিয়ার লীগ, জাতীয় লীগের পর বিপিএল খেলেছি।’
ভয় নিয়েও এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য
ভয়তো আছেই, পা যদি আবার এমন হয়ে যায় সেটি মনে মনে একটা চিন্তা লেগেই থাকে। তবে আমি সেগুলো মনে আনতে চাই না। এগুলো নিয়ে ভাবলে আমার খেলাই হতো না, হবেও না। ক্রিকেট খেলি, পড়ালেখাটাও করি। বিকেএসপি থেকে বের হয়ে এখন একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়া শুরু করেছি। আর লক্ষ্য একটাই, জাতীয় দলে আসা। সেখানে দেশের হয়ে কিছু করা। আর যেখান থেকে বের হয়ে আমি আজ মাঠে খেলছি সেটি আমার বড় অনুপ্রেরণা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর