হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির (বাকশিস) সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হক মনে করেন, শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণই এ খাতে বিদ্যমান সব সমস্যার সমাধান বয়ে আনবে। সরকারি ও বেসরকারি নানা বৈষম্য এবং ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষা খাতে কেবলই জটিলতা সৃষ্টি করছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সবকিছুকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে হবে। সমকালের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি।
অধ্যক্ষ আসাদুল হক প্রায় চার দশকের বেশি শিক্ষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তিনি বাকশিসের সভাপতির পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টের আহ্বায়ক। রাজধানীর তেজগাঁও মহিলা কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে সম্প্রতি অবসরে গেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের’ সদস্য সচিব হিসেবেও দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
আসাদুল হক জানান, তার সংগঠন বাকশিস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর। কলেজ শিক্ষকদের এই সংগঠনটি কালের বিবর্তনে ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে তার অবস্থানকে শুধু শক্তিশালীই করেনি, গতানুগতিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সুপ্রতিষ্ঠিত। দেশে বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে এই সংগঠনটির বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে। আজ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জাতীয় বেতন স্কেলসহ যা কিছু অর্জন হয়েছে, তার মূল নেতৃত্বে ছিলেন এই সংগঠনের নেতারা। বর্তমানে বাকশিসের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ ফয়েজ হোসেন।
দেশের শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের সমস্যা তুলে ধরে অধ্যক্ষ আসাদুল হক বলেন, শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করতে হবে। নইলে শিক্ষা খাতের কোনো সমস্যারই পুরোপুরি সমাধান হবে না। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের মতো করে একইভাবে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা দিতে হবে। শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনুপাত প্রথা বিলুপ্ত করে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দিতে হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সহকারী প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সহকারী প্রধান শিক্ষকের অনুরূপ দিতে হবে। শিক্ষক-কর্মচারীদের আগের মতোই টাইম স্কেল দিতে হবে।
তিনি বলেন, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার পরিবর্তে অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ পেনশন চালু করতে হবে। নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে পাঠদানকারী শিক্ষকসহ বিধি মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্ত করতে হবে। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬% এবং জাতীয় বাজেটের ২০% বরাদ্দ রাখতে হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো যুগোপযোগীকরণ ও সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের চাকরি বিধিমালা অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। শিক্ষা-সংশ্নিষ্ট সব দপ্তরে বেসরকারি শিক্ষকদের ৩৫% প্রেষণে নিয়োগ দিতে হবে। এর বাইরে কারিগরি শিক্ষা উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি কারিগরি ও ভোকেশনাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আরও বৃদ্ধি ও শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।
শিক্ষক নেতা আসাদুল হক বলেন. শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া পূরণে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে বিশ্বাসী ১০টি শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনের যৌথ মোর্চা ‘শিক্ষক-কর্মচারী সংগ্রাম কমিটি’র ব্যানারে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে আলোচনা করে দাবি আদায়ের প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। পরে সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে আন্দোলনের কর্মসূচি নেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ঢাকায় মহাসমাবেশের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেন। এর ফলেই বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি ৫% প্রবৃদ্ধি ও বৈশাখী ভাতা বাস্তবায়ন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বাকি সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে সাক্ষাতের অপেক্ষায় আছেন তারা। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের সম্মানের আসনে দেখতে চান এবং সরকার শিক্ষাবান্ধব। তাই তারা আশা করেন, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিসহ বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধানে আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ নেবেন।
আসাদুল হক বলেন, বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে বিশ্বাসী ১০টি শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনের যৌথ মোর্চা শিক্ষক-কর্মচারী সংগ্রাম কমিটির নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ শিক্ষক-কর্মচারী সমিতি ফেডারেশনের উদ্যোগে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে চাই। আমরা শিক্ষকদের নিয়ে রাজনীতি করতে চাই না। শিক্ষাঙ্গনে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সমস্যার সমাধান করতে চাই।
এই শিক্ষক নেতা বলেন, তাদের উদ্দেশ্য হলো- ১৯৬৬ ও ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো আইএলও সুপারিশকৃত জনপ্রিয় শিক্ষক সনদ, কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, স্বাধীন বাংলাদেশের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে গৃহীত শিক্ষা ও শিক্ষক-সংক্রান্ত আদেশ-নির্দেশ, পরিপত্র, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০, ইউনেস্কোর শিক্ষানীতির প্রস্তাবনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানকে প্রধান করে সহকর্মী শিক্ষক ও অভিভাবকদের সম্পৃক্ততায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব তথা বহিরাগত ও দলীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, জাতিসংঘের ২০৩০ সাল অভিমুখী টেকসই উন্নয়নে ১৭ দফা লক্ষ্যকে ধারণ করে শিক্ষাবিষয়ক ৪ নম্বর লক্ষ্যে গুরুত্ব আরোপ এবং অগ্রাধিকারমূলক প্রস্তাব ও সুপারিশ যা আগামীতে বাকশিসের পথচলায় আলো দেখাবে। তিনি বলেন, আলোর এই অভিযাত্রায় ইউনেস্কো আইএলও সুপারিশমালার আলোকে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পিত উন্নয়ন তথা শিক্ষা জাতীয়করণের প্রত্যাশাকে শুধু সোচ্চার দাবিতে রূপান্তর নয়, বাস্তব করে তোলার লক্ষ্যে বাকশিস কাজ করে যাবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর