নদী সুরক্ষায় পদ্মাসেতুর মতো দৃঢ়তাই আমরা আশা করি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নদী বাংলাদেশের প্রাণ। যথার্থই বলা হয়, নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। অত্যন্ত দুঃখ ও উদ্বেগের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, নদী সুরক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত করা হয়নি। নির্বিচার দখল ও ভয়াবহ দূষণের শিকার ছোটবড় সব নদী। স্বাধীনতার আগে দেশে নদীর সংখ্যা ছিল ৭০০। এখন সচল নদীর সংখ্যা ৪০৫টি। ১০০টি নদী মারা গেছে। ৯৭টিতে কোনো পানি নেই। এবং ১০০টি নদীর তথ্যাদি তেমন একটা পাওয়া যায় না। এই যে নদী মারা যাওয়া, হারিযে যাওয়া, তথ্য ঠিকমত না পাওয়া- এসবের একটি বড় কারণ হলো, নদী দখল হয়ে যাওয়া। প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের ৬৪টি জেলায় প্রবাহিত ১৩৯টি নদী ব্যাপকভিত্তিক দখলের শিকার। ঢাকার বাইরে অন্তত ৪৯১৬২ নদী দখলকারীর সন্ধান পাওয়া গেছে। দখলের পাশাপাশি দূষণ সর্বব্যাপী রূপ নিয়েছে। এমন কোনো নদী খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার পানির রং ও গন্ধ স্বাভাবিক আছে। কঠিন ও তরল বর্জ্যরে শেষ গন্তব্যস্থল পরিণত হয়েছে নদীগুলো। বড় শহরের বিশেষত ঢাকা ও চট্টগ্রামের আশপাশের নদীর অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। ঢাকার পার্শ্ববর্তী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষা বায়োলজিক্যালি মৃত। এসব নদীতে অক্সিজেনের পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে গেছে এবং জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত অক্সিজেন থাকেই না। চট্টগ্রামের অস্তিত্বের সঙ্গী কর্ণফুলীর অবস্থা এর চেয়ে ভালো নয়। দুই মহানগরীর সব নদীর পানি আলকাতরার মতো এবং উৎকট দুর্গন্ধযুক্ত। সরকার বিলম্বে হলেও দেশের নদী দখল ও দূষণ রোধে ব্যাপক কার্যোদ্যোগ গ্রহণ করেছে। একাধিক মাস্টার প্ল্যানের আওতায় নদীগুলো উদ্ধার ও দূষণমুক্ত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী মাস্টার প্ল্যান তৈরি হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা ও চট্টগ্রামের আশপাশের নদী দখল ও দূষণমুক্ত করার লক্ষ্যে প্রণীত মাস্টার প্ল্যান অনুমোদন করেছেন। এই মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের সময়সীমা ২০৩০ সাল পর্যন্ত। ঢাকার চার নদী এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলীকে এর আওতায় আনা হয়েছে। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী অবিলম্বে নদীগুলোর দখল ও দূষণ মুক্ত করার কাজ শুরু করতে নির্দেশনা দিয়েছেন।

স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম একটি ইংরেজি দৈনিককে জানিয়েছেন, আমরা তিন মাস আগে থেকেই কাজ শুরু করেছি। এরমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে। তারা মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে একশন প্ল্যান ও বাজেট নিয়ে কাজ করছে। মন্ত্রী আরো জানিয়েছেন, ২৫ সদস্য বিশিষ্ট আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে তত্ত্বাবধান করবে। যতদূর জানা গেছে, মাস্টার প্ল্যানটি তিন পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়িত হবে। প্রথম পর্যায় এক বছর মেয়াদী দ্বিতীয় পর্যায় পাঁচ বছর মেয়াদী এবং শেষ পর্যায় ১০ বছর মেয়াদী। অন্তত নয়টি মন্ত্রণালয় এবং তাদের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে কাজ করবে। মাস্টার প্ল্যান মোতাবেক, অবৈধ দখলকারদের হাত থেকে নদী ও খাল উদ্ধার করা হবে এবং তাদের নব্য পুনরুদ্ধার করতে ড্রেজিং করা হবে। উদ্ধার করা নদীতীরে ওয়াক ওয়ে তৈরি এবং বৃক্ষ রোপণ করা হবে। অন্যদিকে নদীদূষণ রোধে শিল্প ও গৃহস্থালীর তরল বর্জ্য ইটিপির মাধ্যমে পরিশোধন করা হবে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৭ সালে সরকার ও বিশ্বব্যাংক যৌথভাবে একটি সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষায় দেখা যায়, রাজধানীর ৭০০০ শিল্প-কারখানার তরল বর্জ্য ৩০০ চ্যানেল দিয়ে নদীগুলোতে পড়ছে। এই সঙ্গে গৃহস্থালীর তরল বর্জ্যও পতিত হচ্ছে। নদীগুলোতে পড়া তরল বর্জ্যরে ৬১ শতাংশের উৎস কারখানা ও বাকীটার উৎস গৃহ ও অন্যান্য স্থাপনা। পরিবেশ অধিদক্ষতারের একজন কর্মকতর্তার মতে, কারখানাগুলোতে ইটিপি স্থাপনের নির্দেশনা থাকলেও কোনো কারখানাতেই ইটিপি নেই। চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতেও একইভাবে কারখানা ও গৃহস্থালীর তরল বর্জ্য পড়ছে। তরল বর্জ্যরে সঙ্গে কঠিন বর্জ্যরেও নির্বাধ ভাগাড় নদীগুলো। বছরের পর বছর কঠিন বর্জ্য জমা হয়ে সব নদীর তলদেশই ভরাট হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগে বুড়িগঙ্গার বুক থেকে বর্জ্য উত্তোলনের উদ্যোগ নেয় হয়। এ জন্য ড্রেজিং ঠিকমত করা সম্ভব হয়নি পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য শক্ত হয়ে জমাট বদ্ধ হয়ে থাকার কারণে। পরে প্রকল্পটি পরিত্যক্ত হয়। ক’দিন আগে খবর বেরিয়েছে, কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং কাজও ব্যহত হচ্ছে নদীর বুকে জমে থাকা পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে কারণে। নদী দখল ও দূষণমুক্ত করাই নয়, নদীর নাব্য পুনরুদ্ধারও একটা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ।

নদী দখল ও দূষণমুক্ত করার পাশাপাশি তাদের নাব্য ফিরিয়ে আনাও আবশ্যক। ঢাকা-চট্টগ্রামের খালের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। এই দুই নগরীর ভেতর দিয়ে এক সময় বহু খাল প্রবাহিত হতো। এখন অধিকাংশ খালেরই অস্তিত্ব নেই। যাদের অস্তিত্ব আছে, তাদের অবস্থাও মরোমরো। তরল ও কঠিন বর্জ্যে খালের বুক পূর্ণ। সম্প্রতি চট্টগ্রামের চাকতাই, ঢাকার গুলশান ও কুতুবখালি খালের করুণ ছবি পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। খালের অবস্থা যে কতটা ভয়ংকর, ছবি দেখেই তা আন্দাজ করা যায়। কাজেই নদী পুনরুদ্ধার ও বর্জ্যমুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে খালগুলোও পুনরুদ্ধার ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা প্রয়োজন। অনুমোদিত মাস্টার প্ল্যান যতদ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী কেবল নদী দখল ও দূষণে উদ্বেগই প্রকাশ করেননি, অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও দূষণমুক্ত করার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন। মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কার্যব্যবস্থা নেয়াই তার প্রমাণ। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও আছে। দেশের মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই কেবল পারেন নদী রক্ষা করতে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে নদী সুরক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। প্রধানমন্ত্রী পদ্মাসেতা নির্মাণে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন সেভাবেই নদী সুরক্ষায় তিনি দৃঢ়তা দেখাবেন বলে সবাই প্রত্যাশা করে। আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ও অগ্রাধিকার প্রাপ্ত অনেক প্রকল্পের বাস্তবায়ন আশা ব্যঞ্জক নয়। নদীরক্ষার মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে এরকমটি কেউ কামনা করে না। আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে তার তীব্র নজরদারি বজায় রাখবেন এবং বাস্তবায়নের অগ্রগতি ব্যক্তিগতভাবে তদারক করবেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর