রাজধানীতে বায়ুদূষণে বাড়ছে রোগব্যাধি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাজধানীজুড়ে উড়ছে ধুলাবালি। বাতাস হয়ে উঠছে দূষিত। ধুলায় ধূসরিত এখন রাজধানী ঢাকা। ফলে স্কুলগামী শিশু-কিশোর, চাকরিজীবী ও সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ প্রতিদিন বায়ুদূষণের ধকল নিয়ে করছেন রাজধানীতে চলাফেরা। রাস্তায় বেরোলেই ধুলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। ধুলার কারণে একদিকে বেড়েছে ভোগান্তি, অন্যদিকে রোগবালাই। ৬ জানুয়ারি সোমবার রাত পৌনে আটটায় বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল প্রথম, এরপর ভারতের দিল্লি ও পাকিস্তানের করাচির স্থান ছিল। এর আগে ২৪ নভেম্বর রোববার রাত পৌনে নয়টায়ও রাজধানী ঢাকার অবস্থান ছিল প্রথম। এ পরিস্থিতিতে রাজধানীবাসী, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বর্তমানে রাজধানীবাসীর ধুলার সঙ্গে নিত্য বসবাস। বর্ষায় রাজধানীবাসী ভুগেছেন কাদা-পানি ও জলাবদ্ধতায়। আর এখন শুষ্ক মৌসুমে ভুগছেন ধুলার দুর্ভোগে। শীতের সকালে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে কোনোটি কুয়াশা আর কোনোটি ধুলা ধোঁয়াশা। ধুলায় ধূসর ঢাকায় ঝুঁকি বাড়ছে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ দূষণের। জানা গেছে, মেট্রোরেলসহ চলমান কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে রাজধানীর কয়েকটি এলাকা ধুলার রাজ্যে পরিণত হয়েছে, সঙ্গে যোগ হয়েছে ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন এলাকার ইটভাটার দূষণ। এরপর ২৬ নভেম্বর ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার বায়ুদূষণ কমাতে অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের জন্য পরিবেশ সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এর আগে ২০১৮ সালেও এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তখন বায়ুদূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানোর নির্দেশও দিয়েছিল হাইকোর্ট। তারপরও কোনো কিছুতেই যেন রোধ করা যাচ্ছে না নগরীর ধুলা দূষণ।

জানা গেছে, ১৯ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে রাজধানী ঢাকাকে পরিষ্কার রাখতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘রাজধানী ঢাকাকে বায়ুদূষণ মুক্ত রাখতে সব সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। ধুলামুক্ত পরিবেশ চাই।

এ ক্ষেত্রে মেট্রোরেল, ওয়াসা, ইটভাটাকে তাদের নিয়ম মেনে কাজ করতে হবে।’ যারা রাস্তায় ময়লা ফেলবে, নিয়মকানুন না মেনে উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করবে তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেল নির্মাণে যে ধুলা-বালুর সৃষ্টি হচ্ছে তা কেন হবে? তারা তো একটি বেষ্টনীর ভেতর থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।’ মন্ত্রী মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে আরো সতর্ক অবস্থায় তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আহ্বান জানান। এ সময় ঢাকা-উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন কাজের জন্য ঠিকাদারদের মেইনটেইন্যান্স খরচ দেয়া হয়। এরপরও ঢাকা-উত্তর সিটি কর্পোরেশনের তালিকাভুক্ত ঠিকাদাররা যে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করছেন, সেই অবকাঠামো ঘিরে কমপ্লায়েন্স মেইনটেইন করতে পারেন না। তাই তাদের দিয়েই জরিমানা শুরু করব।

সূত্রমতে, মেট্রোরেল নির্মাণে ধুলা-বালুর সৃষ্টি হওয়ায় ফার্মগেট এলাকায় সংশ্লিষ্টদের গত বছর ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রায় ৫ লাখ টাকা জরিমানা করে বলে জানা গেছে।

বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক তানভীর আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, শীতকালেই রাজধানীতে বেশিরভাগ ভবনসহ নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব নির্মাণ কাজের সময় ধুলা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। অথচ বড় ধরনের নির্মাণ কাজের আগে পরিবেশ সমীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও ধুলা নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানো, ইট-সুরকি নির্দিষ্ট স্থানে বেড়া দিয়ে রাখার মতো ন্যূনতম কাজগুলোও দেখা যায় না। তিনি বলেন, এসব বিষয় পরিবেশ অধিদফতর যথাযথ তদারকি করলে নগরীর ধুলাদূষণ অনেকটাই কমে যেতে পারে।

রাজধানীবাসীর ধুলার দুর্ভোগ দূর করতে প্রতিদিনই পানি ছিটানো হচ্ছে বলে দাবি করছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, তবুও ধুলা কমছে না। কারণ চাহিদা অনুযায়ী সব রাস্তায় পানি ছিটাতে পারছে না সংস্থা দুটি।

রাজধানীর মিরপুর কালশী এলাকার বাসিন্দা এনায়েত হোসেন খান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যখনই বের হই ধুলাবালি মিশ্রিত অবস্থায়ই বাসায় ফিরতে হয়। পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক বলেন, শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর থেকে মার্চ) রাজধানীতে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। এ সময় বাতাসে ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার আকারের বস্তুকণার উপস্থিতি বাড়ে। ধূলিকণার মধ্যে আবার সু² ধূলিকণা বেশি ক্ষতিকারক। এ বস্তুকণা নিশ্বাসের সঙ্গে রক্তে মিশে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

তিনি বলেন, সড়ক নির্মাণ ও মেরামত এবং সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয় করে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা এবং নিয়মিত রাস্তা পরিচ্ছন্ন ও ধুলা নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. শামীমা আক্তার বলেন, বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি অ্যাজমা, সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, শ্বাসকষ্টজনিত রোগ), এলপিডি (লিম্ফোপ্রোলিফারেটিভ ডিজিজ) ইত্যাদি রোগও দেখা দিচ্ছে। এলপিডির মতো রোগ আগে খুব একটা দেখা না গেলেও এখন এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানান তিনি। পরিবেশবাদী সংগঠন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন ধরনের দূষণের মধ্যে ধুলাদূষণের অবস্থান শীর্ষে।

এর কারণে জনস্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতির প্রভাব বাড়ছে। জীবাণুমিশ্রিত ধুলায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে নানা রোগব্যাধি। গবেষণায় পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় একটি কাযর্কর আইন প্রণয়নের দাবিও জানায় প্রতিষ্ঠানটি। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বায়ুদূষণের ক্ষতিকর দিক প্রসঙ্গে বলেন, বায়ুদূষণের উৎস বন্ধ করতে হবে এবং যারা এ দূষণ করছে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উন্নয়নমূলক কাজের পাশাপাশি শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা মহানগরীতে ধুলাদূষণের প্রকোপ অত্যন্ত বেড়ে যায়। এবার শুষ্ক মৌসুম ভালোভাবে আসার আগেই রাজধানীতে শুরু হয়েছে ধুলার বিপদ। রাজধানীর অনেক স্থানেই উন্নয়ন কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, তাতে দূষণের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্য অনুসারে, রাজধানীর বায়ুদূষণের ৫০ ভাগ হয় ইটভাটা থেকে, ৩০ ভাগ হয় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য থেকে। ১০ ভাগ দূষণ হয় গাড়ির জ্বালানি থেকে। শিল্প কারখানার বর্জ্য থেকে ১০ ভাগ। এই দূষণ কমাতে জরুরিভিত্তিতে খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধের পাশাপাশি রাস্তাগুলোতে প্রতিদিন পানি দেয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘মেয়রদের নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে রাজধানীতে দূষণের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। উন্নয়ন করতে গিয়ে আমরা মরণফাঁদ তৈরি করেছি। উন্নয়নের আগে কিছু অ্যাসেসমেন্ট করা প্রয়োজন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর