হতাশ কক্সবাজারের চাষিরা প্রতি কেজি লবণ ৪ টাকা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশের প্রধান লবণ উৎপাদন কেন্দ্র কক্সবাজারের মাঠে আকস্মিক লবণের দাম এ যাবৎকালের সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। গতকাল সোমবার কক্সবাজারের কতুবদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের মাঠ পর্যায়ে প্রতি মণ উৎপাদিত লবণের দাম ছিল মাত্র ১৫০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজি লবণের দাম মাত্র ৩ টাকা ৭৫ পয়সা। অথচ প্রতি কেজি লবণ উৎপাদনে চাষীদের খরচ হয় ৬ টাকা ২৫ পয়সা। মাত্র এক সপ্তাহে দাম উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে। গেল সপ্তাহেও ছিল মণপ্রতি ১৮০ টাকা।

লবণের দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসায় কক্সবাজার উপকূলের ৬০ হাজার লবণ চাষীর ঘরে রীতিমতো আহাজারী শুরু হয়েছে। একর প্রতি এক মৌসুমের জন্য ৭৫ হাজার টাকায় বর্গা জমি নিয়ে এবার সেই টাকাও তুলতে পারবে না- চাষীরা এমন আশংকায় রয়েছেন।

বিক্রয় মূল্যে উৎপাদন ব্যয় উঠে না আসায় লবণের মাঠ ছাড়ছেন কক্সবাজারের লবণ চাষিরা। ক্যামিকেল আইটেমের নামে ‘এইট সিন্ডিকেট’ গোপনে সোডিয়াম ক্লোরাইড (খাবার লবণ) আমদানি করায় চাষের লবণের ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না বলে দাবি করেছেন লবণ চাষে সংশ্লিষ্টরা। এতে দিন দিন লবণ উৎপাদন উৎসাহ হারাচ্ছেন চাষিরা। এসব কারণে স্বয়ংসম্পন্ন দেশীয় লবণ শিল্পে অশনি সংকেত দেখা দিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তারা।

জানা গেছে, বাজারে আয়োডাইজ লবণ কেজি প্রতি ৩০-৪০ টাকায় বিক্রয় হয়। অথচ মাঠ পর্যায়ে এক কেজি লবণের দাম মাত্র ৪ টাকার মতো। সিন্ডিকেটের পকেটে লাভ ঢুকলেও বঞ্চিত হচ্ছে চাষিরা। উৎপাদন খরচের অর্ধেকও দাম পাচ্ছে না তারা। মাঠ থেকে এক কেজি লবণ উৎপাদন খরচ পড়ছে সাড়ে ৬ টাকা। ২০১৭ সালে ‘বাফার স্টক’ গড়ে তোলার জন্য সরকার জাতীয় লবণনীতি-২০১৬ এর আলোকে পদক্ষেপ নেবার ঘোষণা দিলেও তা এখনও কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। তাই এ পরিস্থিতি বলে মন্তব্য করেন লবণ সংশ্লিষ্টরা।

কক্সবাজার সদরের গোমাতলীর লবণ চাষি রিদুয়ানুল হক বলেন, অন্য বছর এ সময় লবণ চাষে ব্যস্ত সময় পার করতেন চাষিরা। কিন্তু এখন লবণ মাঠে চাষিরা উদাসিন সময় পার করেন। আশা নিয়ে মাঠে নামা অনেক চাষি মাঠ ছেড়ে উঠে আসছেন। সবার একই কথা, ব্যয়ের সঙ্গে বিক্রয় মূল্যের সামঞ্জস্য নেই। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হলে চাষে থেকে দেনা বাড়িয়ে লাভ কি? অথচ পরিবারের ভরণ-পোষণ ও সন্তানদের পড়ালেখার খরচ যোগাতে গ্রীষ্মে লবণ ও বর্ষায় চিংড়ি চাষই একমাত্র ভরসা এখানকার অধিবাসীদের।

মহেশখালীর নলবিলার বাসিন্দা আবদুল হক বলেন, বিগত তিনযুগ ধরে লবণ চাষ ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি শিল্প কারখানায় চাহিদা অনুযায়ী তিনি লবণ জোগান দিয়ে এসেছেন। কিন্তু গত ৩-৪ বছর ধরে ওইসব কারখানা মালিক তার কাছ থেকে লবণ নেন না। এখন তারা আমদানিকারকদের কাছ থেকেই লবণ কিনছে।

ইসলামপুরের লবণ ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, ২৫ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় প্রতি সপ্তাহে দু-ট্রাক করে লবণ বিক্রি করা হতো। গত কয়েক বছর থেকে ওই পোশাক কারখানা কর্তৃপক্ষ এখন বিদেশ থেকে আমদানিকৃত লবণ ব্যবহার করছে কারখানায়।

মাতারবাড়ীর এক লবণ কারখানার মালিক বখতেয়ার আলম জানান, লবণের মওসুম শুরু হলেই চট্টগ্রাম, নরায়ণগঞ্জ, ঝালকাঠি ও খুলনার বড় বড় মিল মালিকদের মধ্যে কক্সবাজারের লবণ কিনতে ধুম পড়ে যেত। প্রতিদিন শতশত কার্গোবোট ভর্তি লবণ সমুদ্র পথে চলে যেত ওইসব মোকামে। কিন্তু এখন সেদিন আর নেই। এখন ওইসব মিলাররা বিদেশ থেকে আমদানিকৃত লবণ বাজারজাত করছেন।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজার লবণ প্রকল্প কার্যালয় সূত্র মতে, ২০১৯-২০ মৌসুমে লবণের চাহিদা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৪৯ হাজার মে.টন। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৫০ হাজার মে.টন। কক্সবাজার জেলায় উৎপাদনযোগ্য লবণ জমির পরিমাণ ৬০ হাজার ৫৯৬ একর। জেলায় লবণ মিলের সংখ্যা প্রায় ৮০টি। প্রতি মণ লবণের দাম বাজারমূল্য ১৯২ টাকা। যা কেজিতে পড়েছে প্রায় ৪ টাকা। উৎপাদনে খরচ হয় প্রায় সাড়ে ৬ টাকা।

কক্সবাজার লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি রইচ উদ্দিন বলেন, মোল্লা, এসিআই, ফ্রেশ, তীর, খ্রিস্টাল, পুবালী, কনফিডেন্স ও মধুমতি’ এ ৮ সিন্ডিকেট ফ্রি ট্যাক্সে ‘ফিনিশ লবণ’ আমদানি করে তারা কম দামে বাজারে ছাড়ছে। সিন্ডিকেট বন্ডেড ওয়্যার হাউজ’র আওতায় ব্যাক টু ব্যাক এলসি এবং ট্যাক্স ফাঁকির মাধ্যমে ক্যামিকেল আইটেমের আড়ালে সোডিয়াম সালফেটের নামে সোডিয়াম ক্লোরাইড (খাবার লবণ) আমদানি করছে। এ বড় শিল্পগ্রুপগুলোর সঙ্গে পেরে উঠছে না দেশী লবণশিল্প। ফলে মার খাচ্ছে স্থানীয় লবণ। অন্যদিকে বিভিন্ন পন্থায় অবৈধভাবে লবণ আমদানি করায় সরকারও হারাচ্ছে রাজস্ব।

রইচ উদ্দিনের মতে, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সোডিয়াম সালফেট আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে। যদি নেহায়েতই অন্য শিল্পের জন্য প্রয়োজন হয়, তাহলে তার উপর ২০০ শতাংশ করারোপ করা দরকার। সোডিয়াম সালফেটের নামে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি যেন না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কক্সবাজারেই স্থাপন করতে হবে ‘লবণ বোর্ড’ এর অফিস। আর মাঠ থেকে ন্যায্যমূল্যে অন্তত ২ লাখ মেট্রিকটন লবণ ক্রয় করে সরকারিভাবে আপদকালীন মজুদ গড়ে তুলতে হবে।

বিসিক কক্সবাজারের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, লবণশিল্প বাঁচাতে অনেক পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। চৌফলদন্ডিতে পাইলট প্রকল্প চলছে। চাষিদের মাঠে রাখতে মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম অব্যাহত আছে। প্রান্তিক চাষিদের প্রণোদনামূলক ক্ষুদ্রঋণ দিতে এনজিওগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। শিগগিরই একটা ভালো ফলাফল আসবে বলে মনে করছেন বিসিকের এ কর্মকর্তা।

অপরদিকে, দেশীয় স্বয়ংসম্পন্ন লবণ শিল্প বাঁচাতে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা দিয়েছে লবণ মিল মালিক সমিতি। নেতৃবৃন্দের মতে, মন্ত্রণালয় বা অন্য সরকারি সংস্থার আওতায় নিবন্ধিত করে মধ্যস্বত্তভোগীদের কমিশন নির্দিষ্ট করে দেয়া দরকার। মৌসুমের শুরুতে লবণ চাষিদের সরকারিভাবে পলিথিন সরবরাহ করা হোক। লবণ মৌসুমের শুরুতে বিশেষ উৎসাহ-সহায়তা হিসেবে চাল বরাদ্দ করতে হবে। যাতে অভাবের তাড়নায় মধ্যস্বত্তভোগীদের কবল মুক্ত হয় তারা।

তাদের মতে, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের প্রয়োজনে প্রচুর জমি অধিগ্রহণ করায় লবণ চাষের মূল জমির পরিমাণ কমে এসেছে। বেকার হয়ে গেছে চাষিরা। বিভিন্ন উপকূল সংলগ্ন নতুন করে জেগে ওঠা চরের জমি সত্যিকার লবণ মিলার ও লবণ চাষিদেরকে সহজ শর্তে বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করলে উক্ত জমিগুলো লবণ চাষের উপযোগী করে লবণ চাষের আওতা বৃদ্ধি করা যায়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর