সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা এবং মত-দ্বিমত

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষার যুদ্ধ নিয়ে অনেক লেখা ও তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। সম্মুখ সমরের প্রধান যোদ্ধা ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী এবং তাদের পেছনে অভিভাবকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারক এবং শিক্ষকদের পক্ষ কোনটি তা স্পষ্ট নয়।

এ যুগের অসহায় অভিভাবক আর উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশীদের বড় অংশ এ অবস্থার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই দায়ী করেন। সাধারণ অভিভাবক আর শিক্ষার্থী যতই করুণ দশায় নিপতিত হোক না কেন, অনেকের মতে আমরা শিক্ষকরা কল্পতরু আর সুবিধার বৃক্ষ থেকে নিচে নামতে চাই না। অবশ্য অনেক শিক্ষক মনে করেন তারা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রতিটি পরীক্ষার্থীর নাড়ি টিপে টিপে যোগ্যজনকে খুঁজে বের করবেন।

ভর্তি পরীক্ষার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার তরী কাব্য গ্রন্থের পরিচিত লাইনটি বারবার মনে পড়ে। ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী।’ যেখানে আমাদের ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের ধারণ করতে হলে মাঝ সমুদ্রে নোঙর করা মাদারশিপের দরকার, সেখানে আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণক্ষমতা এক করলেও একটি ছোট ফিডার জাহাজ ভরবে না। এখন মেধা নয়- লটারির মতো হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টিকিট পাওয়া।

এমন বাস্তবতার পরও অন্য পক্ষের যুক্তি হচ্ছে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। শিক্ষকরা তাদের প্রয়োজনীয় মেধাবী শিক্ষার্থী বেছে নেবেন। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় সেই সুযোগ থাকবে না। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের কারও কারও যুক্তি আছে।

ভর্তি যুদ্ধের নানা ক্ষতি থাকলেও তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ গ্রহণ করে নিজ পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় সে সুযোগ থাকবে না। পঞ্চগড়ের বাবা তার মেয়েকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে মোটেও রাজি হবেন না। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দের অপশনও রয়েছে।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রস্তাবটি উত্থাপনের পর সম্প্রতি ইউজিসি উদ্যোগ নিয়েছে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয়রা একমত হয়েছেন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার। ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা সময় চেয়েছেন যার যার শিক্ষাপর্ষদে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত জানানোর।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকগুণ বেশি ভর্তির সুযোগ রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজগুলোতে। সেখানেও প্রতিযোগিতা খুব কম নয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো এত ছোটাছুটি করতে হয় না। কিন্তু বাস্তবতা বুঝতে না পেরে অনেক ভর্তি যুদ্ধে নামা শিক্ষার্থী ভুল করে দু’কূলই হারায়।

স্বাভাবিকভাবে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী আশা করে, স্বপ্ন দেখে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়বে। তাই অবহেলা করে কলেজের ফরম তোলে না। ফলে অনেকের ক্ষেত্রে সে সময়ও উতরে যায়। শেষ পর্যন্ত দু’কূল হারিয়ে হতাশায় নিপতিত হয়। তখন দরজা অবারিত থাকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। এখানে অভিভাবকদের সাধ্যের প্রশ্ন রয়েছে।

যাদের অগাধ সাধ্য তারা প্রথম শ্রেণির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে না হয় ভর্তি হতে পারে; কিন্তু কম সাধ্যের অভিভাবক বাধ্য হন মাঝারি ও নিু মাঝারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি করাতে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশের লেখাপড়ার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তারপরও কি সবাই ঠাঁই পায়! অনেকেই হতাশ হয়ে শিক্ষাজীবন থেকে ছিটকে পড়ে।

ভর্তি পরীক্ষায় ফরম তোলার যোগ্যতা যাদের আছে, আমি বিশ্বাস করি তাদের যে কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দিলে সে সাফল্যের সঙ্গে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করতে পারবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দোকানের ঝাপ খুলে প্রত্যেকের নাড়ি-নক্ষত্র জেনে ভর্তি করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।

এর ভেতর বাস্তব চিন্তা যতটা না আছে তার চেয়ে বেশি আছে অমানবিক বাণিজ্য চিন্তা। আর আমাদের রাজনীতির বলয়বন্দি মানসিকতায় শিক্ষাবিদের চেয়ে আমলা আর নেতা-মন্ত্রীদের বিবেচনায় এক এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারিত হচ্ছে শিক্ষা ক্ষেত্রে। এখন শিক্ষার নীতিনির্ধারণে সবাই রাজা। তাই ইচ্ছামতো পাল্টে যাচ্ছে পরীক্ষা পদ্ধতি।

প্রতিযোগিতা দিয়ে জিপিএ-৫ আর স্বর্ণখচিত পাঁচের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। পিইসি-জেএসসির মতো অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষায় শিশু শিক্ষার্থীদের ফেলে দিয়ে কোচিং আর গাইড বইয়ে অভ্যস্ত করে ফেলা হচ্ছে।

বেশ কয়েক বছর আগে যখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অলিখিত আদেশে শিক্ষকদের ঝাঁপি ভরে নম্বর দিতে হতো, সে সময় আমার এক সরকারি আমলা বন্ধু প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমরা এত কম পাস করাও কেন? দেখলাম সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তিন-চার শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।’

আমি ওকে উল্টো বললাম, এর চেয়ে বেশি পাস করলে আমি বিস্মিত হতাম। বন্ধু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি ব্যাখ্যা করলাম। এখন জিপিএ-৫ পাওয়ার প্রতিযোগিতায় পরীক্ষায় বস্তা বোঝাই নম্বর পাওয়ার পদ্ধতি তৈরি করে দেয়া হয়েছে। এটি এমনই এক পদ্ধতি যে, এর জন্য কোনো শিক্ষার্থীকে আর গোটা বই পড়তে হয় না।

গাইড, নোট এবং মডেল টেস্টের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর স্বর্ণোদ্যানে পৌঁছা সম্ভব। চারপাশের জ্ঞানের সঙ্গে নিজেকে সম্পর্কিত করা আর সম্ভব হচ্ছে না। এরাই সমস্যায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় এসে।

কারণ ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন করার সময় চেষ্টা করা হয় এইচএসসি পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর যা যা পড়ে আসার কথা, চারপাশের জীবন-জগৎ সম্পর্কে যেটুকু খোঁজখবর রাখার কথা তা রেখেছে কিনা তা বাজিয়ে নেয়ার।

অথচ অদ্ভুত বিজ্ঞজনদের কৃপায় আরোপিত পদ্ধতিতে চকচকে গ্রেডের নেশায় আমাদের মেধাবী সন্তানরা ওদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারছে না। ফলে চার-পাঁচ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীর এই বৈতরণী পাড়ি দেয়া কঠিন। এ কারণেই বলি স্কুল থেকে প্রচলিত শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগেই শিক্ষার্থীদের এক ধরনের বিকলাঙ্গ বানিয়ে দিচ্ছে।

এমন বাস্তবতার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাতেগোনা কয়েকটি আসনের বিপরীতে লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ছুটে বেড়ানোর অসহায় শাস্তি থেকে উদ্ধারের জন্য কেন্দ্রীয় পরিচালনায় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। তবে একে বাস্তবায়ন করাটা অত সহজ নয়।

এই বিশাল কর্মযজ্ঞকে কার্যকর করতে হলে অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে। অবশ্য কী কী পদ্ধতিতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কার্যকর করা হবে সে ব্যাপারে আমাদের অনেকের ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। সাধারণ্যে এসব ধারণা আরও স্পষ্ট করতে হবে।

আমি মনে করি না দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে চলমান প্রক্রিয়ায় যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় তারা নিজেদের পছন্দের বিভাগে ভর্তি হতে পারে। পাস করার সুবাদে কখনও ভাবেনি তেমন বিষয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী। এটিই বাস্তবতা।

আর যারা ভাবেন আমরা বেছে বেছে মেধাবী প্রার্থীদের ভর্তি করব তাদের সঙ্গে আমি একমত নই। শিক্ষার্থীকে তৈরি করার দায়িত্ব শিক্ষকের- বিশ্ববিদ্যালয়ের। আমি বিশ্বাস করি ভর্তির জন্য আবেদন করার যে ন্যূনতম যোগ্যতা ধরা হয় সেই যোগ্যতা শেষ ছাত্রটিকেও যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয় তবে ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারলে সে-ও উজ্জ্বল ফলাফল করতে পারবে।

সমন্বিত পরীক্ষা নেয়ার বিরোধিতা করার পেছনে অনেকে শিক্ষকদের বাণিজ্য বুদ্ধির কথা বলেন। এ অভিযোগ অনেকাংশে যে সত্য নয় তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে এর অন্তর্নিহিত সত্যটি কি কেউ অস্বীকার করতে পারেন?

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে সরকারি আমলাদের একটি বড় আর্থিক বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে অনেক অনেক আগে থেকে। বেতন কাঠামোর বিচারে শিক্ষকরা যে খারাপ আছেন তেমন বলা যাবে না। এই ভালোটি কিন্তু দু’বেলা ভালো খেয়েপরে চলা।

দু’-চার শতাংশ শিক্ষক যারা বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন পড়ানোর সুযোগ পান বা বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করেন তাদের বাদে অধিকাংশ শিক্ষকের অবস্থা যে খুব ভালো তা বলা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো বা কোচিং করানো নিষিদ্ধই বলা যায়।

নানা ধরনের কর্তনের পর পাওয়া বেতনের সীমিত অর্থেই সংসারের নানা চাহিদা মেটাতে হয়। একজন সিনিয়র অধ্যাপক যিনি রাষ্ট্রের এক নম্বর গ্রেডে বেতন পান তার আর্থিক সুবিধাও একজন ডেপুটি সেক্রেটারির চেয়ে কম।

একজন শিক্ষক যখন দেখেন সারা জীবন শিক্ষকতা করে একটি গাড়ি কেনার সাধ্য হল না, বিশ্ববিদ্যালয়েরও সাধ্য নেই এ সুবিধা দেয়ার, কমন বাসেই যাওয়া-আসা করতে হয়, আর পাশাপাশি তার ডিএস ছাত্রকে দেখেন স্বল্প সুদে গাড়ি কেনার টাকা পাচ্ছেন, ড্রাইভারের বেতন আর গাড়ি পরিচর্যার জন্য মাসে পাচ্ছেন ৫০ হাজার টাকা, তখন শিক্ষকের মনে হতাশা আসতেই পারে।

এ প্রবীণ শিক্ষক দেখেন বাড়ি ভাড়া ও অন্য সব কর্তন, ব্যাংক লোন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের লোন নেয়ায় কাটাকাটির পর বেতন হিসেবে যা হাতে পান তা তার ডিএস ছাত্রের গাড়ি মেইনটেন করার ভাতার চেয়েও অনেক কম, তখন একটু হতাশা আসতেই পারে।

এই যদি হয় সিনিয়র শিক্ষকের অবস্থা, তাহলে জুনিয়রদের অবস্থা কেমন তা ভেবে নেয়া যেতে পারে। এমন বাস্তবতায় একজন শিক্ষক যদি চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন ভর্তি পরীক্ষার দিকে আর বাজেট তৈরি করেন এবার ভর্তি পরীক্ষার কাজের বিনিময়ে সংসারের প্রয়োজনীয় ফ্রিজটি কিনবেন বা ডাইনিং টেবিল বানাবেন, তাহলে কতটুকু অন্যায় বলব একে!

তবুও বৃহত্তর কল্যাণের জন্য শিক্ষকদের অধিকাংশই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে মত দেবেন বলে আমার বিশ্বাস। আমরা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অমানুষিক কষ্ট লাঘব করতে চাই। খুব কম শিক্ষকই অভিভাবক আর শিক্ষার্থীদের কষ্টের বিনিময়ে আর্থিক লাভ প্রত্যাশা করেন। এ কারণেই আমরা স্বাগত জানাই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার এ উদ্যোগকে।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর