চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে স্বামীসহ তিন দুষ্কৃতিকারী গৃহবধূকে গণধর্ষণ ও হত্যা করে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট রেলওয়ের পরিত্যক্ত কলোনি থেকে উদ্ধারকৃত লাশটি প্রকৃত পক্ষে একজন স্বামী পরিত্যক্ত গৃহবধূর। তাকে সেখানে নিয়ে সাবেক স্বামীসহ তিন দুর্ধর্ষ খুনি পরিকল্পিতভাবে গণধর্ষণ শেষে হত্যা করেছিল। রবিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় প্রদানকৃত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য জানিয়েছে ওই ঘটনায় জড়িত তিন খুনি।

এর আগে গত শনিবার হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি মাহমুদুল্লা প্রকাশ মামুনকে ভোলা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয় ঘটনায় জড়িত অন্য দুই আসামিকেও। আর এর মধ্য দিয়ে অনেকটা ক্লুবিহীন একটি হত্যার রহস্য উন্মোচিত হলো।

থানা সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শিলকনটওয়াইটিলা গ্রামের মো. আমির হামজার মেয়ে রিমা বেগমের (২৫) সঙ্গে কুমিল্লা ব্রাহ্মণপাড়া থানার সাহেবাবাদ গ্রামের সাদন মিয়ার ছেলে মো. রাসেলের (৩৫) বিয়ে হয়েছিল। দীর্ঘ ৭ বছর সংসার করার পর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। এ বিচ্ছেদ নিয়ে রিমার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল রাসেল।

এদিকে রাসেলের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর রিমা চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানাধীন আমিন কলোনির বেলতলায় বসবাস করে একটি গার্মেন্টসে কাজ নেয়। এখানে নুর হোসেন নামক আরেকজনকে বিয়ে করেন তিনি। এই সূত্রে নুর হোসেনের পরিচিত ভোলা সদর থানার ধনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের কানাইনগর গ্রামের ইউনুস মাতব্বরের ছেলে মাহমুদুল্লাহ প্রকাশ ভাগনা প্রকাশ মামুনের (৩৪) সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে রিমার। তাদের গভীর সখ্যতার কারণে রীমা গত ঈদে ভোলায় অবস্থিত মামুনের বাড়িতেও বেড়াতে যায়।

এদিকে রীমার সঙ্গে বিচ্ছেদ হলেও সাবেক স্বামী রাসেল রীমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। সে মামুনের সঙ্গে রীমার বন্ধুত্বের কথা জেনে তাকে টাকাসহ বিভিন্ন নেশাদ্রব্য রীমাকে এক রাতে তার কাছে নিয়ে আসার জন্য রাজি করায়। এ লক্ষ পূরণ করতে তারা পূর্ব থেকে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট রেলওয়ের কলোনির একটি পরিত্যক্ত কক্ষকে দেখা করার জন্য বেছে নেয়।

গত ৫ জানুয়ারি রাতে মামুন কৌশলে রীমাকে ওই কলোনিতে নিয়ে যায়। সেখানে পূর্ব থেকেই অপেক্ষা করছিল তার সাবেক স্বামী রাসেল ও তার বন্ধু নোয়াখালী সদর থানার বুদ্ধিনগর চৌরাস্তা আন্ডারচর গ্রামের মো. রফিকের ছেলে মো. জামাল (৩০)। এখানে রাসেলসহ তিনজনই তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। কিন্তু ধর্ষণ শেষে রীমাকে রাসেলের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে হুমকি দিয়ে জানায় তাকে এই গণধর্ষণ করার ঘটনা সে সবাইকে জানাবে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে। এ নিয়ে রাসেলের সঙ্গে বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে তারা তিনজন রীমাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাসেল তাকে মাটিতে শুইয়ে পা চেপে ধরে, মামুন তার মাথা এবং জামাল গলা চেপে ধরে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশটি ডোবায় ফেলে দেয়।

এদিকে পরদিন ৬ জানুয়ারি ডোবাতে একটি অজ্ঞাত লাশের খবর পেয়ে পুলিশ সেটি উদ্ধার করে  এ ঘটনায় মামলা দায়ের করেন। কিন্তু মেয়েটিকে শনাক্ত করতে না পারায় কোনো ক্লু পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে সীতাকুণ্ড থানার পুলিশ ও সিআইডি এ নিয়ে তদন্তে নেমে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় প্রথমে রীমার পরিচয় উদঘাটন করতে সক্ষম হলে সীতাকুণ্ড থানার ওসি (ইন্টেলিজেন্স) সুমন বণিক এ মামলার তদন্ত শুরু করেন।

তিনি থানার এডিশনাল এসপি শম্পা রানী সাহা ও ওসি মো. ফিরোজ হোসেন মোল্লার সার্বক্ষণিক পরামর্শ অনুযায়ী আসামিদের শনাক্ত করতে ব্যাপক পরিশ্রম করেন। রীমার পূর্ব জীবন ও মৃত্যুর আগের অবস্থান জানতে ছদ্মবেশে চট্টগ্রামের আমিন কলোনিতে বারবার অবস্থান করেন। সেখানে মামুনের সঙ্গে রীমার সর্বশেষ ভালো সম্পর্কের বিষয়ে অবগত হন। পরে তার বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করে এ ঘটনায় তার জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হলে তাকে গ্রেপ্তারে গত শুক্রবার ভোলায় অভিযান চালান। সেখান থেকে মামুনকে গ্রেপ্তার করে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার কাছে থাকা বিভিন্ন প্রমাণ উপস্থাপন করলে মামুন ঘটনার কথা স্বীকার করে এ ঘটনায় জড়িত রাসেল ও জামালের তথ্য দিয়ে বিস্তারিত খুলে বলে। শনিবার রাতে চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে তাদেরকেও গ্রেপ্তার করেন সুমন বণিক।

এরপর রবিবার তাদেরকে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চট্টগ্রাম ১ এর শহীদুল্লা কায়সারের আদালতে নিয়ে গেলে সন্ধ্যায় সেখানে মামুনসহ তিনজনই ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। তারা জানায় ধর্ষণের কথা ফাঁস করে দে‌ওয়ার ভয় দেখানোয় রীমাকে হত্যা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সীতাকুণ্ড থানার ওসি মো. ফিরোজ হোসেন মোল্লা বলেন, এটি একটি ক্লুলেস দুর্ধর্ষ গণধর্ষণ ও হত্যা মামলা। আমরা বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলাম বলে সফলতা এসেছে। এক্ষেত্রে ওসি (ইন্টেলিজেন্স) সুমন বণিক অনেক পরিশ্রম করে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

সীতাকুণ্ড থানা সার্কেলের এডিশনাল এসপি শম্পা রানী সাহা বলেন, প্রথমে মেয়েটির পরিচয়ও পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু এমন একটি মামলাও আমরা টিমওয়ার্কের মাধ্যমে সফলতা এনেছি। প্রথম থেকেই আমি এটির পেছনে লেগেছিলাম। তদন্তকারী অফিসার সুমন অনেক পরিশ্রম করেছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মেয়েটির পরিচয় শনাক্ত থেকে শুরু করে সকল আসামি গ্রেপ্তার ও আদালতে সবার জবানবন্দির মধ্য দিয়ে পুলিশ আবারো তাদের পেশাগত দক্ষতার প্রমাণ দিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর