রোহিঙ্গা সঙ্কট সউদী আরবে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ এমনিতেই দেশের বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিক চীনের করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের রফতানিমুখী শিল্প এবং উন্নয়ন কর্মকান্ড বড় ধরনের সংকটে পড়তে শুরু করেছে। এহেন বাস্তবতায় দীর্ঘদিন ধরে সউদি আরবে কর্মরত অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা কর্মীকে বাংলাদেশে ফেরত আনার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে সে দেশের সরকার। চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সউদি সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের চাপ বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপদের আশঙ্কা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট একটি আঞ্চলিক সমস্যা হলেও জাতিসংঘ, পশ্চিমা বিশ্ব, ওআইসি’র ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার মামলা দায়েরের মধ্য দিয়ে এটি নিঃসন্দেহে একটি  আন্তর্জাতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সব সময়ই সউদি আরবের কাছ থেকে সহমর্মিতা ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করে। রাখাইনে রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই রোহিঙ্গারা নির্যাতন ও বিতাড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এভাবেই কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময়ে সউদি আরবে গিয়েছিল। রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন হওয়ায় তাদের কোনো দেশের পাসপোর্ট গ্রহণের সুযোগ না থাকায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা পরিচয় গোপন করে অবৈধভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশ গিয়েছে। সউদি আরবে এ সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক শ্রম বাজার সউদি আরবে প্রবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের সংকট মোকাবেলা করছে। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে হাজার হাজার বাংলাদেশি কর্মী ফেরত আসছে। এখন রোহিঙ্গা শ্রমিক ফেরাতে সউদি আরবের চাপ দেশের জন্য বড় বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

গত কয়েক বছর ধরে সউদি-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় শ্রমিক নিয়োগে জটিলতা এবং বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনার প্রসঙ্গটি নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছে সউদি আরবের পক্ষ থেকে। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশে নতুন করে ৮ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আগমনের বাস্তবতায় সউদি আরবের পক্ষ থেকে সে দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনতে বেশ কয়েকবার অনানুষ্ঠানিক তাগিদ দেয়ার পর সম্প্রতি তারা আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে বিষয়টি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার বিষয়ে পরিণত করেছে। সম্প্রতি আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রদূত সম্মেলনেও সউদি আরবের রোহিঙ্গা প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে বলে জানা যায়। এহেন বাস্তবতায় আজ ঢাকায় শুরু হওয়া ২ দিনের সউদি-বাংলাদেশ যৌথ কমিশনের সভায় সউদি আরবের পক্ষ থেকে বিষয়টি উত্থাপিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সামগ্রিক বাস্তবতায় সউদি আরবের সাথে যৌথ কমিশনের এই বৈঠক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সউদি আরবে বাংলাদেশি জনশক্তি নিয়োগ, বিনিয়োগ, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির উপায় নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বৃহত্তম শ্রমবাজার সউদি আরবের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অ¤ø মধুর ও অনাকাক্সিক্ষত জটিলতায় আবর্তিত হচ্ছে। তবে আইএস জঙ্গি মোকাবেলাসহ মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ সব সময় সউদি আরবের পাশে আছে। এ ক্ষেত্রে দুই দেশের তরফ থেকেই ঘনিষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দাবি অগ্রাহ্য করা যায় না।

বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে সউদি আরবের চাপ কোনো নতুন বিষয় নয়। এতদিন অনানুষ্ঠানিকভাবে তাগিদ দিলেও এখন আনুষ্ঠানিক চাপ ও আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হওয়ায় এ বিষয়ে বাংলাদেশকে গ্রহণযোগ্য কূটনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর উদ্যোগ নিতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান, মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদসহ মুসলিম বিশ্বের নেতারা বেশ সোচ্চার ভূমিকা রাখলেও সউদি আরবের কাছে বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের নেতারা যতটা সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশা করে তা পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক উদ্যোগ ছিল কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটের উত্তুঙ্গ সময়ে সউদি আরবের মতো উন্নয়ন অংশীদার ও বন্ধুপ্রতিম দেশের পক্ষ থেকে ৪০-৫০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে আনার ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসার প্রসঙ্গটি মেনে নেয়া কঠিন। এটি স্পষ্টতই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানপোড়েন এবং বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতাকেই নির্দেশ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও হাজার হাজার রোহিঙ্গা মালয়েশীয় পাসপোর্ট নিয়েও সউদি আরবে গিয়েছেন। সউদি কর্তৃপক্ষ মালয়েশিয়াকেও অনুরূপভাবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে বলে জানা যায়। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা এথনিক ক্লিনজিং তথা গণহত্যার শিকার হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত মুসলমান জনগোষ্ঠি হিসেবে তাদের রক্ষায় বাংলাদেশের পাশাপাশি মালয়েশিয়া, সউদি আরবসহ মুসলিম বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও দায়িত্ব নিতে হবে। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও কাজের সুযোগ দিয়ে সউদি আরব সে দায়িত্বের কিছুটা হলেও পালন করে আসছে। এখন রোহিঙ্গা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানেও সউদি আরবকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক তৎপরতা ও ভূমিকা পালন করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা, জনশক্তি রফতানিসহ সউদি আরবের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কোন্নয়ন, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো প্রসারিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর