বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রামের প্রস্তাব লেখা হয়েছিল ইংরেজিতে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সরকারের ১৪৪ ধারা প্রবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ২১ এর কর্মসূচি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর ৯৪, নওয়াবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগের সদর দপ্তরে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কর্মপরিষদের বৈঠক বসে। এতে সভাপতিত্ব করেন আবুল হাশিম। পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না, এই প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে গিয়ে বৈঠকে কে কোন পক্ষে মত দিয়েছিলেন—এ বিষয়ে রাজনীতি নিয়ে আলোচনার টেবিলে আজও নানা ধরনের বিশ্লেষণ পাওয়া যায়।

অবাক হওয়ার মতো ঘটনা হচ্ছে, এ সময় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী নেতারা কেউ ঢাকায় ছিলেন না। কর্মপরিষদের বৈঠকে মওলানা ভাসানীর উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি ছিল। অথচ তখন তিনি মফস্সলে সফর করছিলেন। অলি আহাদ তাকে ২০ ও ২১ তারিখের মফস্সলে সফর কর্মসূচি বাতিল করে ঢাকায় থাকার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ভাসানী সাহেব শোনেননি। আতাউর রহমান খানও ঐ দুদিন ঢাকায় ছিলেন না। মামলা পরিচালনার জন্য ময়মনসিংহ ছিলেন।

গাজীউল হক জানিয়েছেন, অলি আহাদ, মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি গোলাম মওলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিন এঁরা ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। ফজলুল হক হলের সহ-সভাপতি শামসুল আলম এদের সমর্থক ছিলেন। মোহাম্মদ তোয়াহা যদিও ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বক্তব্য পেশ করেছিলেন, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত অন্যরকম ছিল বলে তিনি ভোটদানে বিরত থাকেন।

কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ তকীউল্লাহ বলেন, কমিউনিস্ট পার্টি ১৪৪ ধারা ভাঙার বিষয়ে সরাসরি কোনো সিদ্ধান্ত দিতে চায়নি। তাদের বক্তব্য ছিল সংগ্রাম পরিষদই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক।

ফলে ১১-৪ ভোটে সর্বদলীয় কর্মপরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় যে, ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে না। ভোটাভুটির পরও অলি আহাদ বলেছিলেন, ‘এ সিদ্ধান্ত আমরা মানি না। আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্র সভা হবে তাতে ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে যদি রায় হয় তবে আমরা ভাঙার পক্ষে।’ অলি আহাদের বক্তব্যে আবুল হাশিম রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সভায় শামসুল হক সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। ছাত্ররা যদি তবুও ১৪৪ ধারা ভাঙে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সর্বদলীয় কর্মপরিষদের বিলুপ্তি ঘটবে।’

১৪৪ ধারা যারা ভাঙতে চাননি তাদের যুক্তি ছিল সর্বদলীয় কর্মপরিষদ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে চায়, বেআইনি কাজে তারা যাবেন না। ১৪৪ ধারা ভাঙা হলে সরকার নিপীড়নের সুযোগ পাবে, তাতে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কর্মপরিষদে যেসব রাজনৈতিক নেতা ছিলেন তাদের সামনে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রামের চেয়ে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিল। আবার তারা সরকারের নিপীড়ন এড়িয়ে চলতে চেয়েছিলেন।

বৈঠক চলার সময়েই অলি আহাদকে সভাকক্ষের বাইরে ডেকে ফজলুল হক হলের ছাত্র আবদুল মমিন ও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র এম এ আজমল ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানান।

বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তাদের সহযোগী সংগঠনের প্রতিনিধি বর্গ, খেলাফতে রব্বানী পার্টি, তমদ্দুন মজলিশ, সরকার সমর্থক বিভিন্ন হলের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা প্রায় সবাই ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন।

বিশিষ্ট গবেষক বশীর আলেহলাল তার ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থের ৩০৫ পৃষ্ঠায় এ প্রসঙ্গে আলোচনায় উল্লেখ করেন যে, ‘সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সদস্য ছিলেন প্রায় ৪০ বা ৪০ এর বেশি, বা, অলি আহাদের তথ্য অনুযায়ী ২৮ জন। তাদের মধ্যে ১৫-১৬ জন সেদিনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন? মোহাম্মদ তোয়াহা ছাড়া তো আর কারো ভোটে অংশগ্রহণ না করার কথা কেউ বলেননি। কিন্তু ১১ জন বিপক্ষে ও চার জন মাত্র ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে ভোট দেওয়ার কথা একাধিক স্মৃতিচারণকারী বলেছেন।’

অলি আহাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আরেকটি মজার বিষয় এই যে, সেদিন শামসুল হকের লেখা যে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছিল তা রচিত হয়েছিল ইংরেজিতে। অথচ এঁরা সবাই সংগ্রাম করছিলেন মাতৃভাষা বাংলার জন্য।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর