কোরআন যেভাবে বিবেক জাগিয়ে তোলে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কোরআন অবতীর্ণ করার মূল উদ্দেশ্য মানবতার কল্যাণ নিশ্চিত করা, মানবসভ্যতাকে কল্যাণের পথ  দেখানো। যেন মানুষ উত্তম জীবন যাপন করতে এবং ভুল পথ থেকে ফিরে আসতে পারে। মানবজাতির সামনে একটি ‘আদর্শ জীবন প্রণালী’ তুলে ধরা কোরআন নাজিলের অন্যতম উদ্দেশ্য। যে জীবন হবে স্বস্তির, প্রশান্তির ও মুক্তির। কিন্তু মানুষ কখনো কখনো প্রবৃত্তির তাড়নায় অনৈতিক জীবন বেছে নেয়। তাতে যদিও তার মন প্রশান্ত হয়, তবে তা মানবসভ্যতার জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না; বরং কখনো কখনো ধ্বংস ডেকে আনে। আজকের আধুনিক সভ্যতা তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। পৃথিবীতে যেকোনো সময়ের তুলনায় মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা এখন সবচেয়ে বেশি বিপন্ন, ক্ষমতাশীল ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মনোবৃত্তি ও লালসার খেসারত দিচ্ছে বিশ্বের দরিদ্র ও অসহায় মানুষগুলো। মানবিক এই সংকট থেকে সভ্যতাকে রক্ষা করতে ইসলামের সুমহান শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে।

বিবেক জাগিয়ে তোলা কোরআনের লক্ষ্য

বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরিত নবী-রাসুলদের ঘটনা—যা পবিত্র কোরআনে নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, তা মানুষের বিবেক জাগিয়ে তোলার কার্যকর দৃষ্টান্ত। বিশেষত ইউসুফ (আ.) ও তাঁর ভাইদের ঘটনার বিবরণ হৃদয়ে দাগ কাটে। যাতে শিক্ষণীয় বহু দিক রয়েছে। যেমন—প্রবৃত্তির অনুসরণে ভাইদের ধ্বংসাত্মক কাজ, জীবনে কঠিন ও নাজুক সময় ধৈর্য ও সতর্কতা অবলম্বন, চারিত্রিক পবিত্রতা ও নৈতিক পরিশুদ্ধতা অক্ষুণ্ন রাখা, ভাইদের প্রতি তাঁর উচ্চ সহনশীল আচরণ ইত্যাদি।

ইউসুফ (আ.) জেলখানার দুর্বিষহ সময়েও তিনি তাঁর ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেননি। তাঁর উচ্চ ব্যক্তিত্ববোধ ও প্রজ্ঞা তাঁকে বাদশার সুধারণা ও আস্থা অর্জনে সাহায্য করে। তিনি বাদশার উচ্চ পরিষদে স্থান করে নেন। এভাবে তাঁর সামনে দ্বিন প্রচারের অবারিত সুযোগ এসে যায়। এই সাফল্যের জন্য তিনি মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে বলেন, ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি মুত্তাকি ও ধৈর্যশীল, আল্লাহ সেরূপ সৎকর্মপরায়ণদের শ্রমফল নষ্ট করেন না।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৯০)

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনা সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন যেন মহানবী (সা.) তা থেকে প্রশান্তি ও আত্মিক শক্তি লাভ করেন এবং মুমিনরা চারিত্রিক উৎকর্ষ লাভের মাধ্যমে দ্বিনি কাজে সাফল্য অর্জনের পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত হয়।

একজন নবীর আত্মত্যাগ ও আল্লাহর সাহায্য

সামাজিক পর্যায়ে মানুষের বিবেক ও মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার দৃষ্টান্ত মুসা (আ.)-এর ঘটনায় পাওয়া যায়। যুগের অত্যাচারী শাসক রাষ্ট্রের সব ব্যবস্থাপনা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়। জনগণের ওপর অত্যাচার-অবিচার চলতে থাকে। মানুষ তার ক্ষমতার কাছে ছিল অসহায় এবং দিন দিন উদ্বেগ বাড়ছিলই। কিন্তু মহান আল্লাহ অলৌকিকভাবে একটি শিশুকে অত্যাচারী শাসকের ঘরে পৌঁছে দিলেন। বিষয়টি সে সহজভাবে নিল এবং শিশুকে সযত্নে প্রতিপালনের ব্যবস্থা করল। বড় হওয়ার পর শিশুটির দুঃসাহস দেখে সে ভয় পেল এবং তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিল। যুবকটি রাতের অন্ধকারে দেশ ছেড়ে চলে গেল। মূলত একটি অজানা-অচেনা পরিবেশে নিজের ভবিষ্যতের খোঁজে বের হলো। আল্লাহর শক্তি, দয়া ও অনুগ্রহের ওপর ভরসা করে সে পা বাড়াল। আল্লাহ প্রতি পদক্ষেপে তাকে সাহায্য করলেন। যখন সে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় পরিপক্ব হলো, আল্লাহ তাকে নবী ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে অত্যাচারী শাসকের কাছে ফিরিয়ে আনলেন। আল্লাহ তাআলা নবী মুসা (আ.)-কে এমন প্রজ্ঞা দান করলেন যে অত্যাচারী শাসক ফেরাউন বিতর্কে নির্বাক হয়ে গেল।

আল্লাহ তাআলা জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সৎ সাহসে মুসা (আ.)-কে এমন বলিষ্ঠ করেন যে সময়ের সবচেয়ে অত্যাচারী শাসককে তিনি নিজের সমকক্ষ মনে করতেন। কোনো সংকোচ ছাড়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন এবং শাসনব্যবস্থায় সংস্কারের ডাক দেন। কয়েক বছর পর্যন্ত তিনি ধৈর্যের সঙ্গে তাঁর চেষ্টা-সংগ্রাম অব্যাহত রাখলেন। কিন্তু তাতে ফল হলো না। অত্যাচারী তার অত্যাচারের ধারা অব্যাহত রাখল। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তির বিধান হলো। আল্লাহ অত্যাচারীকে সদলবলে ধ্বংস করে দিলেন। সত্যের পথে সংগ্রাম করা সামান্যসংখ্যক লোক বিজয়ী হলো। পবিত্র কোরআনে মুসা (আ.)-এর এই ঘটনা নানাভাবে একাধিক স্থানে বর্ণিত হয়েছে। আজ ইসলাম প্রচারক ও দ্বিনি পথের কর্মীরা বিশ্বের নানা প্রান্তে যে প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছে; মুসা (আ.)-এর ঘটনা তাদের জন্য সান্ত্বনা হতে পারে। পাশাপাশি ক্ষমতাদর্পীদের জন্যও এই ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ আছে। কোরআনে বিবরণ এমন যে একদিকে তা থেকে মানুষ প্রশান্তি খুঁজে পায়, অন্যদিকে একই ঘটনায় থাকে তাদের মুক্তির দিশা।

মানবিক সংকটের নানা চিত্র

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মানুষের মানবিক সংকটের নানা চিত্র তুলে ধরেছেন। উদ্দেশ্য মানুষ যেন সংকটকালে দিশা খুঁজে পায়, তাদের জীবন সুন্দর করতে তা সহায়ক হয়। কেননা মানুষ অন্যের জীবনের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে এবং অন্যকে দেখে ভালো-মন্দ নির্ণয় করে। কোরআনে বর্ণিত অবস্থাগুলোর মধ্যে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সব কিছুর বিবরণ পাওয়া যায়। যাতে চক্ষুষ্মানদের জন্য জীবনের পথ ও সত্যের দিশা রয়েছে। যেমন সুরা ‘তাকাসুর’-এ বর্ণনায় মানুষের সম্পদের লিপ্সা বেড়ে যাওয়ার বর্ণনা এসেছে। কখনো কখনো মানুষ সম্পদের প্রতি এতটা আসক্ত হয়ে পড়ে যে তা জীবনের সব কল্যাণচিন্তা তার মাথা থেকে উবে যায়। সে সম্পদ অর্জনে নিমজ্জিত হয়। কিন্তু শেষ পরিণতিতে সব সম্পদ ছেড়ে পরকালীন জীবনের পথে পা বাড়ায়। যেখানে অসীম সম্পদও মূল্যহীন। সুরা মুতাফফিফিনে মানুষের বাড়াবাড়ি ও অবিচারের আলোচনা এসেছে। সম্পদের প্রতি লোলুপ ব্যবসায়ী পরিমাপে অনেক হেরফের করে। এমন লোকের পরিণতিও ভয়াবহ। এভাবে মানবজীবনের নানা দিক কোরআনে ফুটিয়ে তুলে তা সংশোধনে নবী-রাসুলদের প্রচেষ্টা বর্ণনা করা হয়েছে, যা মানুষের বোধ ও বিবেক জাগিয়ে তুলতে এবং উচ্চতর মানবিক মূল্যবোধ অর্জনে উৎসাহিত করে।

পাক্ষিক তামিরে হায়াত থেকে আবরার আবদুল্লাহ-এর ভাষান্তর

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর