ঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ২১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। টাকার অঙ্কে ব্যাখা করলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে গেছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে এক ধরণের হাওয়া হয়ে গেছে এই অর্থ। মূলত বাধ্যতামূলক ই-টিআইএন সার্টিফিকেট এবং ৫ লাখ টাকার উপরে বিনিয়োগে উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করায় আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক আমানতে সুদ কম হওয়ায় সঞ্চয়পত্র বিমুখ অর্থ আসেনি ব্যাংকে। এই অর্থ দেশের বাইরে পাচার হতে পারে। একই সঙ্গে বাজার থেকে নগদ ডলার কিনেও জমা করছেন অনেকে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত এ বিষয়ে বলেন, সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমানোর জন্য কড়াকড়ি আরোপ করার কারণেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে।
জানা গেছে, সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটার টান শুরু হয় ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দিনই। গত বছরের আগস্ট থেকেই ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। ওই মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি এক লাফে কমে ১ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকায় নেমে আসে। এরপর তা আরও কমে সেপ্টেম্বরে ৯৮৫ কোটি, অক্টোবরে ৮২২ কোটি ও সর্বশেষ নভেম্বরে ৩২০ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর থেকে ডিসেম্বরের হিসেব এখনও পাওয়া যায়নি। সূত্র মতে, সঞ্চয়পত্রে ৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের সুদে উৎসে কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সঞ্চয়পত্রের সব লেনদেন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে করতে হচ্ছে ক্রেতাদের। ক্রেতার তথ্য একটি ডাটাবেসে সংরক্ষণের লক্ষ্যে অভিন্ন সফটওয়্যার চালু। এছাড়া সঞ্চয়পত্রে বড় বিনিয়োগে কঠোর হয়েছে সরকার। চাইলেই ভবিষ্যত তহবিল বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থে সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ নেই। এখন প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে কর কমিশনারের প্রত্যয়ন লাগে। পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক ফার্মের নামে সঞ্চয়পত্র কিনতে লাগছে উপকর কমিশনারের প্রত্যয়ন। আর এসব কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমেছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, আগের মতো ক্রেতাদের দীর্ঘ সারি নেই সঞ্চয়পত্র বিক্রির বুথে। অল্প ক’জন গ্রাহক সঞ্চয়পত্র কিনতে এসেছেন। খুব অল্প সময়েই গ্রাহকরা সঞ্চয়পত্র কিনে ফিরে যাচ্ছেন। কিছু ক্রেতা এসেছেন মুনাফা তুলতে। অথচ ছয় মাস আগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ে সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য দিনভর লাইন দেখা যেত গ্রাহকদের। একই পরিস্থিতি দেখা গেছে রাজধানীর মাতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়েও। সোনালী ব্যাংক ছাড়াও এ কার্যালয়ে সঞ্চয়পত্র ব্যুরোর একটি শাখা রয়েছে। গতকাল দুপুরে গিয়ে ওই কার্যালয় থেকে দু’একজন গ্রাহককে সঞ্চয়পত্র কিনতে দেখা যায়।

সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মোহাম্মদ মোদাচ্ছের হাসান জানান, সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে আগের মতো চাপ নেই। তবে পেনশনারসহ প্রকৃত গ্রাহকরা বর্তমানে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার অন্যতম কারণ হিসেবে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, পুঁজিবাজারসহ আর্থিক খাত নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশে উৎসে কর বাড়ানোয় মানুষের মধ্যে আগ্রহ কমেছে বলে উল্লেখ করেন রাশিদুল ইসলাম।
এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। যদিও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ে ২১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। সে হিসেবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে। সর্বশেষ নভেম্বরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি মাত্র ৩২০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। যদিও ২০১৮ সালের নভেম্বরে নিট ৩ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। ২০১৯ সালের নভেম্বর শেষে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৫০১ কোটি টাকা।

অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিক্রি কমেছে বলে মনে করেন জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আবু তালেব। তিনি বলেন, আগে কে কত টাকার সঞ্চয়পত্র কিনছে, কেন্দ্রীয়ভাবে তা জানার সুযোগ ছিল না। এখন অটোমেশনের কারণে সঞ্চয়পত্রের সব ক্রেতার তথ্য কেন্দ্রীয় ভান্ডারে সংরক্ষিত হচ্ছে। কেউ চাইলেই সীমার অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছে না। এছাড়া সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে ই-টিআইএন সার্টিফিকেট জমা দিতে হচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বরসহ অর্থের উৎস জানাতে হচ্ছে। এসব কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে স্বচ্ছতা এসেছে। ফলে এ খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের পথও বন্ধ হয়েছে। তবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি এতটা কমে যাওয়াটাও কাঙ্খিত নয়। সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ানোর বিষয়টি সরকার সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে।
এদিকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমায় সেই অর্থ এখন কোথায় যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের একটি অংশের অর্থ ব্যাংকে আমানত হিসেবে আসছে। তবে সেটা পরিমানে খুবই কম। অনেকে বাজার থেকে নগদ ডলার কিনে নিয়েও জমা করছেন। এছাড়া বাকীরা দেশের বাইরে পাচার করছেন।

জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি, সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি ও অন্যান্য খাত থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে আগ্রহ কমায় সরকার ব্যাংক ঋণে ঝুঁকেছে। ইতোমধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে।

গত অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ছিল ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। বিক্রি বাড়তে থাকায় সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঠিক করা হয়। যদিও অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এর আগে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে সর্বশেষ ২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহার গড়ে ২ শতাংশ করে কমানো হয়েছিল। বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০১৫ সালের ২৩ মে মাসের পর থেকে এই হার কার্যকর আছে। এর আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি।

এদিকে সঞ্চয়পত্রে উৎসে করসহ নানা জটিলতা এড়াতে বাজার থেকে নগদ ডলার কিনে নিয়েও জমা করছেন অনেকে। সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের পর থেকে কার্ব মার্কেটে (খোলা বাজার) ডলারের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ফলে লাভের আশায় অনেকেই নগদ ডলার কিনে রাখছেন। এছাড়া দেশের বাইরে টাকা পাচার হওয়ার কথাও বলছেন অনেকেই। প্রতি বছরই দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। এর পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে টাকা পাচারের হার আরও বেড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশ থেকে বিভিন্ন পথে টাকা পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, পণ্য আমদানির এলসি খুলে বিদেশে অর্থ পাঠিয়ে দেয়ার পরও পণ্য দেশে না এনে, আমদানি মূল্যের চেয়ে বেশি অর্থ বিদেশে পাঠিয়ে, এলসিতে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে কম পণ্য দেশে এনে, বেশি দামের পণ্যের এলসি খুলে কম দামের পণ্য দেশে এনে টাকা পাচার করা হচ্ছে। রফতানির মধ্যে পণ্যের রফতানি মূল্য দেশে না এনে, মোট রফতানির মূল্যের চেয়ে কম মূল্য দেশে এনে, বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে পণ্য রফতানি করে, বেশি পণ্য রফতানি করে এলসিতে কম দেখানোর মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। এর বাইরে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের আওতায়ও টাকা পাচার হচ্ছে। এছাড়া হুন্ডি, স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকার পাচার হচ্ছে। এর বাইরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে না এনে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। এসব প্রক্রিয়ায় এখন দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। আগে দেশ থেকে টাকা পাচার হতো হুন্ডি ও চোরাচালানের মাধ্যমে। এতে ঝুঁকির মাত্রা বেশি ছিল। ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাচারের কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাচার হচ্ছে বেশি। পাচার করা টাকার একটি বড় অংশই যাচ্ছে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তেও এ ঘটনা ধরা পড়েছে। বিশেষকরে শিল্পের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল আমদানির নামে টাকা পাচার হচ্ছে বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, টাকা পাচারের পথগুলো বন্ধ করতে হলে আগে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এছাড়া টাকা পাচার বন্ধ হবে না। তিনি বলেন, নানা পথে টাকা পাচার হচ্ছে। সুশাসনের অভাবে এখন টাকা পাচারের পথ অনেক বেশি খুলে গেছে। আমদানি, রফতানি, হুন্ডি এসব খাতে নজরদারি বাড়াতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রফতানি মূল্য বা আমদানি পণ্য দেশে না এলে পরবর্তী এলসি খোলায় কঠোরতা আরোপ করতে হবে। একই পণ্যের দাম, কি পণ্য আসছে-যাচ্ছে এগুলো তদারকি বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, টাকাকে অলস রাখা যাবে না। বিনিয়োগমুখী করতে হবে। তাহলে পাচার কমে যাবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর