সীমান্তে বেড়েছে কান্না

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  ৭ জানুয়ারি ২০১১। ১৩ বছরের কিশোরী ফেলানী। সীমান্ত অতিক্রম করার সময়, তার জামা কাঁটাতারের বেড়ায় জড়িয়ে যায়। আতঙ্কিত হয়ে সে চিৎকার শুরু করে। ভারতের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী (বিএসএফ) সেই চিৎকারের জবাব দেয় তাকে গুলি করে। সেখানেই মারা যায় ফেলানী । শুধু তাই নয়, প্রাণহীন দেহটি প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে উল্টোভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এ হত্যাকান্ডের পর দেশে ও বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার পর সীমান্ত এলাকায় হত্যাকান্ড কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ও ভারত সম্মত হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও ভারতের বিএসএফ সিদ্ধান্ত নেয় সীমান্তে ‘লিথ্যাল উইপন’ বা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। তা সত্তে¡ও সীমান্তজুড়ে চলছে হত্যা। রয়েছে চাপা কান্না।

পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেকে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অনেক মা-বাবা তার সন্তানকে হারিয়ে চোখের পানিতে দিনাতিপাত করছে। সন্তান তার বাবাকে হারিয়ে হয়েছে এতিম। ২০১৯ সালেই সরকারি হিসেবে হত্যাকান্ড বেড়েছে ১২ গুণ। চলতি মাসে গত ১৫ দিনে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনের ১০ জনের নিহতের খবর পাওয়া গেছে।

সর্বশেষ গত বুধবার ভোর থেকে গতকাল ভোর পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নিহত হয়েছেন ৬ জন। নওগাঁর পোরশার হাঁপানিয়া সীমান্তে গতকাল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের গুলিতে তিন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। গতকাল ভোরে নওগাঁর হাঁপানিয়া দুয়ারপাল সীমান্তে নীলমারী বিল এলাকায় ভারতের ক্যাদারীপাড়া ক্যাম্পের বিএসএফ জোয়ানরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। নিহতরা হলেন- পোরশা উপজেলার বিষ্ণপুর বিজলীপাড়ার শুকরার ছেলে রনজিত কুমার, দিঘীপাড়া গ্রামের খোদাবক্সের ছেলে মফিজুল ইসলাম এবং কাঁটাপুকুরের মৃত জিল্লুর রহমানের ছেলে কামাল হোসেন।

অন্যদিকে যশোরের শার্শা উপজেলা সীমান্তে ভারতের বন্যাবাড়ী ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর এক বাংলাদেশি যুবকের মৃত্যু হয়েছে। গত বুধবার দিবাগত রাতে যশোরের শার্শা সীমান্তে ভারতের বন্যাবাড়ীয়া ক্যাম্পের বিএসএফের সদস্যরা হানেফ আলী ওরফে খোকাকে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালায়। পরে সেখানে তার মৃত্যু হয়। মৃত হানেফ শার্শার অগ্রভ‚লোট গ্রামের শাজাহান আলীর ছেলে। এছাড়া গত বুধবার ভোরে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা সীমান্তে দুই বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। নিহতরা হলেন- উপজেলার আমঝোল গ্রামের শাহাজান আলীর ছেলে সুরুজ মিয়া (৩৮) এবং একই গ্রামের উসমান আলীর ছেলে সুরুজ আলী (১৭)। এর আগে চলতি মাসের ৮ তারিখ রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওয়াহেদপুর সীমান্তে ২ জন, ১১ তারিখ ভোররাতে ঠাকুরগাঁয়ে ১ ও ২১ তারিখে পঞ্চগড়ের মোমিনপাড়া বিএসএফের গুলিতে একজন নিহত হয়েছেন।

সম্প্রতি ভারতের রাজধানী দিল্লীতে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন শেষে খোদ বিজিবি মহাপরিচালকও সীমান্তে হত্যাকান্ড বেড়েছে বলে স্বীকার করে বলেন, ২০১৯ সালে সীমান্তে ৩৫ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। আর সরকারি হিসেবে ২০১৮ সালে সীমান্তে তিনজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।
কিন্তু বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আরো বেশি। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) হিসেবে ২০১৯ সালে সীমান্তে ৪৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে গুলিতে ৩৭ জন এবং নির্যাতনে ছয় জন। আহত হয়েছেন ৪৮ জন। অপহৃত হয়েছেন ৩৪ জন। ২০১৮ সালে নিহত হয়েছেন ১৪ জন। সরকারি হিসাব ধরলে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সীমান্ত হত্যা বেড়েছে ১২ গুণ। আর বেসরকারি হিসাবে তিনগুণের বেশি।

এ বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, সীমান্তে হত্যা নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা দিল্লিকে জানানো হয়েছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে কিংবা আদৌ পাওয়া গেছে কি না, সেটি তিনি জানাননি।
নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা জানান, নওগাঁর পোরশার হাঁপানিয়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)’র ছোঁড়া গুলিতে তিন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে উপজেলার দুয়ারপাল সীমান্ত এলাকার ২৩১/১০(এস) মেইন পিলারের নীলমারী বীল এলাকায় ভারতের ক্যাদারীপাড়া ক্যাম্পের বিএসএফ জোয়ানরা ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে জানাগেছে। তবে বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) একজন নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। নিহতরা হলেন, পোরশা উপজেলার বিষ্ণপুর বিজলীপাড়ার শুকরার ছেলে রজনিত কুমার(২৫), দিঘীপাড়া গ্রামের খোদাবক্সের ছেলে মফিজুল ইসলাম (৩৫) এবং কাঁটাপুকুরের মৃতু জিল্লুর রহমানের ছেলে কামাল হোসেন (৩২)।

স্থানীয় এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ভোর রাতে পোরশার উপজেলার দুয়ারপাল সীমান্ত এলাকার ২৩১/১০(এস) মেইন পিলারের নীলমারী বীল এলাকায় ভারতের ক্যাদারীপাড়া ক্যাম্পের বিএসএফ জোয়ানরা গরু ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। এসময় অন্যরা পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও গুলিতে তিন বাংলাদেশী যুবক গুলিবিদ্ধ হয়। এতে গরু ব্যবসায়ী মফিজুল ইসলাম গুলিবিদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের ২০০ গজ অভ্যন্তরে তার লাশ পড়ে ছিল। আর গরু ব্যবসায়ী রজনিত কুমার ও কামাল হোসেন (৩২) এর লাশ ভারতের ৮০০ গজ অভ্যন্তরে পড়ে ছিল।

এ বিষয়ে ১৬-বিজিবি হাঁপানিয়া ক্যাম্প কমান্ডার নায়েব সুবেদার মোখলেছুর রহমান তিনজন গুলিবিদ্ধেও বিষয়টি শুনেছে। তবে গুলিবিদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশের মধ্যে একজন মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এবং অপর দু’জন ভারতের অভ্যন্তরে মারা যাওযায় লাশ উদ্ধারে বিলম্ব হবে বলে জানান। তবে তিনি পতাকা বৈঠকের জন্য বিএসএফকে চিঠি দিবেন বলেও জানান। এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত কোন পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি।
বেনাপোল : বিএসএফের নির্যাতনে বাংলাদেশি এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। গত বুধবার দিবাগত রাতে যশোরের শার্শা উপজেলার অগ্রভ‚লোট গ্রামের হানেফ আলী ওরফে খোকা নামের এক রাখালকে ধরে নিয়ে যায় ভারতের বন্যাবাড়ীয়া ক্যাম্পের বিএসএফের সদস্যরা। সেখানে তার ওপর বিএসএফ সদস্যরা নির্যাতন চালানোর এক পর্যায়ে তার মৃত্যু হয় বলে জানা গেছে।

স্থানীয়দের ভাষ্য, বিএসএফ সদস্যরা তার ওপর অমানবিক নির্যাতন করলে হানেফ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে ভারতের বনগাঁ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহতের বাবা শাহাজান আলী জানান, হানেফ গত বুধবার রাত থেকে নিখোঁজ ছিল। পরে খবর নিয়ে জানতে পারেন বিএসএফ সদস্যরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়ে বেদম মারধর ও নির্মম নির্যাতনের পর তার মৃত্যু হয়। বর্তমানে তার লাশ ভারতের গাইঘাটা পুলিশের হেফাজতে আছে বলে জানা গেছে। বিষয়টি বিজিবিকে জানানো হয়েছে। ২১ ব্যাটালিয়ন বিজিবির সুবেদার মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, বিষয়টি তারা শুনে বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। তবে এখনও পর্যন্ত কথা বলে কিছু নিশ্চিত হতে পারেননি।
লালমনিরহাট : লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা সীমান্তে দুই বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। গত বুধবার ভোরে উপজেলার গুতামারি ইউনিয়নের বনচৌকি সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- উপজেলার আমঝোল গ্রামের শাহাজান আলীর ছেলে সুরুজ মিয়া (৩৮) এবং একই গ্রামের উসমান আলীর ছেলে সুরুজ আলী (১৭)। গুতামারি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম সাবু মিয়া বিএসএফের গুলিতে দুইজন নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর