আওয়ামী লীগকে যেমন দেখতে চাই

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের অভাব নেই। পথেঘাটেই দল পাওয়া যায় যেন। নামসর্বস্ব বা একজইন্যা-দুইজইন্যা দলই বেশি, এগুলোর ছড়াছড়িতেই এত এত দল। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন দেশের কয়েকটা রাজনৈতিক দলের নাম বলতে, আমি বোধহয় প্রথম পর্যায়ে তিনটির বেশি নাম বলতে পারব না। এটা অবশ্যই আমার অজ্ঞতা বা ব্যর্থতা।

এ তিনটি দলকে কমবেশি সারা দেশের মানুষ নামে যেমন চেনে, কাজেও কমবেশি বেশ জানে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং জাতীয় পার্টি সরকারও গঠন করেছে একাধিকবার করে।

হালে কিন্তু দল তিনটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নামে বহাল তবিয়তে থাকলেও কাজে একটা দলই নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব সর্বক্ষেত্রে একক আধিপত্যে দেশকে হাতের মুঠোয় রেখেছে। রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রের একক মালিকানাও যেন কার্যত এ দলেরই। নামে ও মুখে গণতন্ত্র শব্দটি এ দলের অর্থাৎ আওয়ামী লীগের মজ্জাগত হলেও কার্যত এখন একজনের মধ্য দিয়েই দলটি পরিস্ফুটিত।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের তৃণমূলে প্রতিষ্ঠিত সত্যিকারের একটা রাজনৈতিক দল। দলীয় বা অঙ্গসংগঠনের কাজকর্মে যথেষ্ট বদনাম থাকলেও রাজনীতিতে এখন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডকেই ক্ষমতার নিয়ামক হিসেবেই যেন বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

এ কর্মটি অবশ্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং জাতীয় পার্টিও ক্ষমতায় থাকতে কমবেশি একই কায়দায় বেশ ভালোভাবেই করেছে। তারপরও দলের সৃষ্টি, বয়স, ক্ষমতায় থাকাকালীন প্রচুর অপকর্ম করার পরও সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়নে এবং জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে আওয়ামী লীগের তুলনায় অপর দু’দল বলতে গেলে নস্যি।

আওয়ামী লীগ পাকিস্তান আমলেও রাজনৈতিক দলরূপে সুপরিচিত ও স্বীকৃত ছিল। সে আমলে মুসলিম লীগের বিপরীতে আওয়ামী লীগই ছিল একমাত্র দল যাকে পাকিস্তানি শাসক-শোষকরা মান্য করে চলত। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী আমলে আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যা ধর্তব্যের মধ্যে ছিল।

’৭০-এর নির্বাচনে এ দলই এখানকার ১৬৯-এর মধ্যে ১৬৭ আসন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দিয়েই শুধু থেমে থাকেনি, শেষতক একটি স্বাধীন দেশই সৃষ্টি করেছে। তখন আমরা জোর গলায় স্লোগান দিয়েছি- এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে এ স্লোগানকে এখনও তখনকার চেয়ে কম আন্তরিক, আবেগময় এবং কম জীবন্ত মনে হয় না। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী দীর্ঘ সময়ের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর একক অর্জনই তাকে এমন চির-স্থায়িত্বে নিয়ে গিয়েছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে তিন বছরের রাজনীতিতে, বাস্তবতার নিরিখে, বঙ্গবন্ধু সরকারপ্রধান হিসেবে আলোচিত-সমালোচিত থাকলেও দলীয়প্রধান হিসেবে এক অনবদ্য মহীরুহই ছিলেন।

হ্যাঁ, তখন বড় বড় নেতা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর কোনো বিকল্প প্রকৃতই অচিন্তনীয় ছিল। ‘এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’ তখন শুধু আক্ষরিক অর্থেই নয়, বাস্তবেও বিদ্যমান ছিল।

কিন্তু তার জীবদ্দশায়ই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ বিভাজন দৃশ্যমান হতে থাকল। তখনকার জনপ্রিয় সংগঠন ছাত্রলীগ বিভাজিত হতে থাকল। তদানীন্তন চার-খলিফার বিভক্তি দৃশ্যমান হল, হঠকারী সংগঠন জাসদের জন্ম হল।

‘কাপালিক’ নেতা দাদা-খ্যাত সিরাজুল আলম খান জাসদের জন্মদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। সিরাজ সিকদার খুন হলেন। রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার তথা জাসদ-কর্মী ধরপাকড় বহুল আলোচিত হল। বঙ্গবন্ধু বিভাজিত ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের দু’সম্মেলনের দুটোতে না গিয়ে শেষতক একটাতে হাজির হলেন।

আওয়ামী লীগের মাস্তানদের নিয়েও বেশ কথা উঠতে লাগল, শাসক দলের লুটপাট নিয়েও দেশ সরব হল। খোদ বঙ্গবন্ধুও তখন ‘চোরের খনি পেয়েছি’ এবং ‘আমার কম্বলটি কোথায়’- এ ধরনের বক্তব্য দিলেন। সর্বোপরি জাসদের হঠকারী রাজনীতি দেশকে বেশ অস্থির করে তুলল।

অনেক পত্রিকা বন্ধের নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত এবং বাকশাল গঠন বাংলাদেশের রাজনীতিতে তখন এক প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিল। আজীবন গণতন্ত্রের জন্য জীবন উৎসর্গ করা বঙ্গবন্ধুর একদলীয় শাসনের প্রতি অকুণ্ঠ জনসমর্থন পাওয়া গেল না, যদিও ওটাকে সোনার বাংলা গড়ার একটা ‘বিপ্লব’ হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল।

তবুও দেশ একটা সুস্থির ধারাবাহিকতার দিকে হয়তো এগিয়ে যেতে থাকত, যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন।

কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডে দেশের রাজনীতি খেই হারিয়ে ফেলল। দেশে প্রথম সামরিক শাসন এলো, যেটুকু গণতন্ত্র ছিল সেটারও অপমৃত্যু হল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগ একেবারে চুপসে গেল, কেউ কেউ তো গাদ্দারি করল, প্রধান বিচারপতিও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হলেন, আওয়ামী লীগেই দৃষ্টিকটু বিভাজন দেখা গেল।

ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের তখন ত্রাহি ত্রাহি দশা। দলটিকে নিঃশেষ করাই ছিল জিয়ার প্রধান টার্গেট। সামরিক ক্ষমতার বলেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) জন্ম। জিয়াকে হত্যার পর এলো আরেক সামরিক সরকার। আওয়ামী লীগের পুরনো অনেক রাজনীতিকই আবার নতুন শাসকের দলে ভিড়ে গেলেন!

তারপরও আওয়ামী লীগ একমাত্র তৃণমূলে সৃষ্টি বলে টিকে রইল। আমরা যারা ’৬৯, ’৭০-এ এবং ’৭১-এর মার্চ পর্যন্ত একদিন ৩২ নম্বরে না গেলে ভালো ঘুমাতে পারতাম না, তারা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ভিজেও ১৭ মে, ’৮১ শেখ হাসিনার আগমনে হাজির হলাম। একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলো।

আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন শেখ হাসিনা এবং দলটিকে আবার সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন। কিন্তু ‘একবার ভোট দিয়ে দেখেন না’ বলে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ আবার সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্ত হল এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে হারল।

এখন যদি মোদ্দাকথা বলতে চাই, তাহলে তো বলতেই হয় যে, এতকিছুর পরও আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগই। এদেশের রাজনীতিতে দলটিকে মুছে ফেলা যায় না, সম্ভবও নয়। যা কিছু কমবেশি করুক না কেন, তারপরও আওয়ামী লীগ দেশের রাজনীতিতে, উন্নয়নে, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে (নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনসহ) অবশ্যই এখনও অদ্বিতীয়।

তৃণমূলে জন্ম নেয়া সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের তুলনা আওয়ামী লীগই। আমরা যারা দল না করলেও আওয়ামী লীগের শুভ কামনা করি, দলটির জন্য সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেই, জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীর গুণাগুণ বিচার না করে শুধু শেখ হাসিনার মনোনীত নৌকার প্রার্থী হিসেবে তাকে সর্বাত্মক সমর্থন দেই; তাদের অনেকের জন্য আওয়ামী লীগের কিছু কিছু কর্ম কিন্তু এখন হতাশার জন্ম দিচ্ছে।

আমরা কখনও দলটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা কোনো নেতাকে তেমন সম্মান করতে আগ্রহী হই না। আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে যাওয়া কোনো সাবেক নেতাকে আবার দলে স্থান দেয়ার ‘ওকালতি’ও পছন্দ করি না।

সন্ত্রাসের গডফাদার খ্যাত কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকে দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য করাও আমাদের অপছন্দ। শেখ হাসিনার প্রতি আমাদের এ শ্রেণির সমর্থকদের প্রত্যাশা থাকে যে, তিনি এসব সিদ্ধান্তে কঠোর হবেন।

শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনা- এটা যতটুকু বাস্তব, তার চেয়ে বেশি, আমাদের অনেকের মতে, চাটুকারিতা। শেখ হাসিনাকে দেশের লোক শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, ক্ষমতায় দেখতে চায়; আমরাও আওয়ামী লীগ না-করেও তাকে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি এবং ক্ষমতায় দেখতে চাই।

কিন্তু দলের অজ্ঞ-অন্ধ-অসহিষ্ণু সমর্থকদের থেকে আমরা আলাদা এজন্য যে, আমাদের কিছু বক্তব্য অপ্রিয় হলেও আমরা চাটুকার নই। বঙ্গবন্ধুর পর তার কন্যা শেখ হাসিনাই আওয়ামী লীগের একমাত্র নেতা, যিনি ‘এক নেতা, এক দেশ- বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’ পর্যায়ের কিছুটা হলেও কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছেন।

এর মানে কিন্তু এই নয় যে, শেখ হাসিনা ছাড়া দেশ অচল হয়ে যাবে, আওয়ামী লীগ শেষ হয়ে যাবে। ব্যক্তি মরণশীল, ক্ষমতা পরিবর্তনশীল; দেশ কিন্তু চলমান, দলও চলমান সত্তা। অতএব, আমরা যেটা চাই সেটা হল শেখ হাসিনা তার জীবদ্দশাতেই আওয়ামী লীগের পরবর্তী নেতৃত্ব সৃষ্টি করে যাবেন, যাতে করে তার অবর্তমানে দলে নেতৃত্বশূন্যতা দেখা না দেয়।

এবারের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা তেমন কিছু করবেন মর্মে আমরা আশাবাদী ছিলাম। সরকার ও দলকে আলাদা করার প্রক্রিয়ায় তিনি দলের সভাপতি পদে অন্য কাউকে দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে হলেও দেখতে পারতেন দল কেমন চলে। সভাপতি পদে না থাকলেও তিনি তো তারও অনেক বড় কিছু, ভুলভ্রান্তি হলে তো তিনি আছেনই।

বঙ্গবন্ধু দলের হাল ধরার জন্য মন্ত্রীর পদ ছেড়েছিলেন। উন্নয়নের অগ্রযাত্রা বহাল রাখার জন্য শেখ হাসিনার সরকারে থাকা এখনও অত্যাবশ্যক বিধায় তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির পদটা ছেড়ে দলের নেতৃত্ব সঠিকভাবে গড়ে তোলায় সচেষ্ট হতে পারতেন। তখন দলটির গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের সব ধারাবাহিকতা তার জীবদ্দশায়ই দৃশ্যমান হতো।

মরণশীল হিসেবে তিনি তো আমরা যতই দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি না কেন, অনন্তকাল বাঁচবেন না। আমরা আওয়ামী লীগের শুভ কামনায় তার জীবদ্দশায়ই দলের পরবর্তী যোগ্য নেতৃত্ব দেখতে চাই, যাতে করে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া, শেখ হাসিনার হাতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ পরে কোনো শূন্যতায় না পড়ে।

এ বিবেচনায়, একমাত্র এ বিবেচনায়ই এবারের কাউন্সিল আমাদের কিছুটা হতাশ করেছে। তারপরও আমরা আওয়ামী লীগের শুভ কামনা করি এবং দলটির নেতৃত্বে সরকারের ধারাবাহিকতা একনিষ্ঠভাবে সমর্থন করি।

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

 

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর