সরিষাফুলের মধুতে চলে ওদের জীবন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ‌ রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ফুলে ফুলে থাকা মিষ্টি নির্যাসকে সংগ্রহের কাজে ছুটে চলেছে ওরা। সদ্য ফোটা ফুলের মিষ্টি রস আহরণ করে আবারও ঘরে ফিরছে তারা। বিন্দু-বিন্দু সেই নির্যাস জমিয়ে তৈরি করছে মধু। ফুলে ফুলে মিষ্টি নির্যাস সংগ্রহের ফলে নিশ্চিত হচ্ছে ফুলের পরাগায়ন।

Image result for সরিষা ফুলের মধুতে ছবি

এভাবে মধু সংগ্রহ করেন কুষ্টিয়ার সফল উদ্যোক্তা মামুন-অর-রশিদ মামুনের মৌ খামারের মৌমাছিরা। মামুনের কাছে পোষা মৌমাছিগুলোই তাকে দু’বেলা অন্য যোগাড় করে দিচ্ছে। শুধু মামুনকে নয়, মামুনের মধু খামারের ১১ জন কর্মচারীর সংসারও চলছে এই মৌমাছিগুলোর জমানো মধুতে।

এক সময়ের মঞ্চ নাটকের অভিনেতা মামুন আজ সফল উদ্যোক্তাও। বিএ পাস করে চাকরির আশা করেছিলেন মামুন। চাকরি পেয়েছিলেন একটি এনজিওতে। তবে চাকরিতে মন বসাতে পারেননি। স্বপ্ন ছিলো দেশের মানুষ তাকে অন্যভাবে চিনুক। চাকরি করে নয়, প্রতিষ্ঠিত হবো নিজের প্রচেষ্টায়।

তাই কৃষি কার্যালয়ের পরামর্শে মৌচাষ করার পরিকল্পনা করেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৯৯৭ সালে প্রথম অবস্থায় মাত্র চারটি মৌ-বাক্স নিয়ে প্রাথমিকভাবে শুরু করে মৌ-খামার। গ্রামাঞ্চলের ছোট এই উদ্যোক্তাকে দেখে অনেকেই উপহাস করেছিলো। তবে, লক্ষ্যতে অটুট মামুন এখন মৌ-চাষ করে স্বাবলম্বী। স্ত্রীও আজ স্বামীর কাজে গর্বরোধ করেন। যে মামুন এনজিওতে চাকরি করতেন সেই মামুনের খামারে এখন ১১ জন কর্মচারি সারাবছর চাকরি করছেন। মামুনের মধু দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও সুনাম বয়ে এনেছে। সফল উদ্যোক্তা হিসেবে মামুন এলাকার মানুষের চোখে রোল মডেল। তবে এখনো নানা প্রতিবন্ধকতায় দিন পার করতে হচ্ছে সফল ওই উদ্যোক্তার।

মামুন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের গেটপাড়া গ্রামের মৃত মসলেম উদ্দিন মণ্ডলের ছেলে।

মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) বিকেলে উপজেলার ধুবাইল মাঠে মামুনের ভ্রাম্যমাণ ‘মিষ্টি মৌ খামার’ খামারে কথা হয় মামুনের সঙ্গে।

মামুন বাংলানিউজকে বলেন, আমার মৌ খামারের প্রাণ আমার মৌমাছিগুলো। ওরাই আমার সব। বছরজুড়ে ওদের সঙ্গেই বসবাস আমার। সারাদিন কাজ করে ওরা। ফুলে ফুলে ছুটে মধু সংগ্রহ করে ওরা। ওদের কাজেরই ফল নেই আমিসহ খামারের অন্য কর্মচারিরা।

Related image

তিনি বলেন, শুরুটা অনেক কঠিন ছিলো। এক সময় মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতাম আমি। এখনো মাঝেমধ্যে মঞ্চে উঠি। সংসারের তাগিদে এনজিওতে কাজ শুরু করি। কিন্তু সেখানে মন দিতে পারিনি। নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখেছি। এজন্য অনেকে অনেক কথা বলেছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করি মৌমাছির মাধ্যমে মধু আহরণ। শুরুতে মাত্র চারটি মৌ-বাক্স এবং কিছু মৌমাছি নিয়ে একা একাই শুরু করি মধু আহরণ। গ্রামের অনেকেই নিষেধ করে আমাকে। পাগলামি বলেও অ্যাখ্যা দিয়েছে অনেকেই। কিন্তু হাল ছাড়িনি আমি। শুরুটা তেমন ভালো ছিলো না। তবে, আমাকে অনুপ্রেরণা জাগিয়েছিলেন আমার স্ত্রী রাশিদা আক্তার মিনু। বড় মেয়ে মিষ্টির নামের সঙ্গে মিল রেখে মৌ-খামারের নাম রেখেছি ‘মিষ্টি মৌ খামার।

Image result for সরিষা ফুলের মধুতে ছবি

তিনি বলেন, চারটি মৌ-বাক্সে থেকে এখন আমার খামারে রয়েছে ১৫০টা মৌ-বাক্স। এবছর প্রায় ১৪ মেট্রিক টন মধু আসবে বলে আশা করছি। এক সময় নিজের সংসার চালাতে কষ্ট হলেও এখন আমার খামারে সারাবছর ১১ জন কর্মচারি কাজ করেন। মৌমাছির পাশাপাশি দিনরাত কাজ করেন খামারের কর্মচারিরাও।

তিনি বলেন, বর্তমানে আমার খামারের উৎপাদিত মধু বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছি। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, চীন, স্পেন অন্যতম। এছাড়া সারাদেশেই বিক্রি করি।

Related image

২০১৬ সালে খামার থেকে আমি নয় টন, ’১৭ সালে ১০ টন, ’১৮ সালে ১২ টন মধু উৎপাদন করেছিলাম। এবছর আমার খামারে প্রায় ১৪ টন মধু পাবো বলে আশা করছি। যার বাজারমূল্য প্রায় ২৫-৩০ লাখ টাকা। সারা বছরের খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৭-৮ লাখ টাকা লাভ হবে। এছাড়া ’১৯ সালের শুরুতেই ৮শ কেজি মধু অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়েছি। ২০২০ সালে প্রথম দফায় অস্ট্রেলিয়ায় ৩শ কেজি, স্পেনে ৫০ কেজির অর্ডার পেয়েছি।

তিনি বলেন, অনেকই বলতেন মধু প্যাকেজিং সম্পর্কে। এবছর আমি আমার ক্রেতার সুবিধার জন্য ডালসহ মধু বিক্রি করার উদ্যোগ নিয়েছি। চীন থেকে ডালও এনেছি। যা ভোক্তরা সহজেই পরিবহন ও চামচ দিয়ে খেতে পারবেন।

Image result for সরিষা ফুলের মধুতে ছবি

মামুন বলেন, আমার একার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব ছিলো না। আমি মধু সংগ্রহ করতাম আমার স্ত্রী সেটা বোতলজাত করতেন। এখন আমার কাজে খামারের কর্মচারিসহ আমার স্ত্রী, মেয়ে ও ছোট ছেলে কাজ করে।

আক্ষেপ করে মামুন বলেন, আমরা মাঠপর্যায়ে অনেক কষ্ট করে মধু উৎপাদন করি। আমরা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদন পাই না। ফাঁকা মাঠে রাত কাটাই, নেই জীবনের নিরাপত্তাও।

Related image

আমাদের উৎপাদিত মধু অন্য কোম্পানিগুলো তাদের নাম দিয়ে বিক্রি করে। মধু বাজারজাতকরণের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য খুলনা বিএসটিআই কার্যালয়ে ঘুরে ঘুরে কোনো লাভ হয়নি। টাকা ঘুষ দিতে পারিনি বলে লাইসেন্স পাইনি। এ ব্যপারে সরকারের কাছে আমাদের একটাই চাওয়া আমরা মধু উৎপাদনকারীরা যেনো বাজারে বিক্রি করতে পারি সেদিকে সুদৃষ্টি দেওয়া।

মামুনের স্ত্রী রাশিদা আক্তার মিনু বলেন, কোনো কাজই ছোট নয়। আমি আমার স্বামীর কাজে সহায়তা করি। খামারের উৎপাদিত মধু বোতলে ভরি।

আমরা প্রায় সারাবছরই মধু সংগ্রহ করি জানিয়ে ওই খামারে কর্মরত জাহান আলী বলেন, এখান থেকেই আমাদের সংসার চলে। জেলার মিরপুর, সদরের বিত্তিপাড়া, নাটোরের গুরুদাসপুর, চলনবিল, শরীয়তপুর, মাদারীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় মধু খামারের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করি। নভেম্বর থেকে কুষ্টিয়ার মিরপুর, বিত্তিপাড়া, নাটোরের চলনবিলে সরিষাফুলের মধু, তারপর কালজিরা ফুলের মধু পড়ে শরীয়তপুরে কালজিরার মধু আর নাটোরের গুরুদাসপুরে লিচু ফুলের মধু সংগ্রহ করি। পরে মধু আহরণ করি সুন্দরবন এলাকায়।

সংগ্রহ করা মধু। ছবি: বাংলানিউজএদিকে সরিষাক্ষেতের জমিতে মৌ-চাষ করলে সরিষার ফলন প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ বেড়ে যায় বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

মধু মামুনের খামারে যাওয়া দর্শনার্থীদের আপ্যায়নের ক্ষেত্রে রয়েছে ব্যতিক্রম। চা-নাস্তার পরিবর্তে দেওয়া হয় চাক থেকে ছাড়ানো মধু। দর্শনার্থীরাও ভিড় করে মামুনের খামারে।

মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, মামুন মধু খামারের মাধ্যমে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন তেমন সরিষার পরাগয়নে সুবিধা করছেন। আমরা কৃষি কার্যালয়ের মাধ্যমে তাকে মৌ-চাষে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ইতোমধ্যে মামুন বেশ সাফল্য অর্জন করেছেন। আমরা ‘কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পের আওতায় মধু সংগ্রহের বাক্স, বাতাসের সাহায্যে মধু আহরণের উন্নতমানের মেশিনসহ এসএমই গ্রুপের মাধ্যমে মৌ-চাষের সব সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করছি।

Image result for সরিষা ফুলের মধুতে ছবি

তিনি আরও জানান, সরিষাক্ষেতে মৌ-চাষ করলে ফুলের পরাগায়ন ঠিকমতো হয়। এজন্য সরিষার উৎপাদন বাড়ে। এবছর মিরপুর উপজেলায় ১১ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ৩৩০ হেক্টর বেশি। আগামীতে এ উৎপাদন আরও বাড়বে।

মিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিংকন বিশ্বাস বাংলানিউজকে জানান, উপজেলার মৌ-খামারি মামুনের মধু দেশে তথা বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার ভ্রাম্যমাণ মধু খামারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবো। তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা।

Related image

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিফতরের উপ-পরিচালক শ্যামল কুমার বিশ্বাস বাংলানিউজকে জানান, জেলায় তামাকের বিকল্প হিসেবে চাষিরা সরিষাসহ বিভিন্ন রবিশস্য করছেন। সরিষাক্ষেতে মৌ-চাষ একটি লাভজনক। মিরপুরের মামুন তার মধু খামারের মাধ্যমে যেমন কৃষি উৎপাদন বাড়াচ্ছেন তেমনি মধু উৎপাদন করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর