অর্থনীতিতে চাপ নিয়েই নতুন বছরের শুরু

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য আরও এক ধাপ কমেছে গেল অক্টোবরে। এতে চাপের মুখে পড়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা।

পাশাপাশি আমদানি ও রফতানি খাতে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে। আর মূল্যস্ফীতির হারেও ঊর্ধ্বমুখী অবস্থা বিরাজ করছে। কমেছে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নভেম্বরে (সর্বশেষ) অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী বেসরকারি খাতে স্থানীয় ঋণপ্রবাহ বেড়েছে। বেড়েছে এনবিআর রাজস্ব আয় ও কৃষি ঋণ বিতরণের হার। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।

টাকার মূল্যমান প্রসঙ্গে সম্প্রতি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। কারণ বাংলাদেশ আমদানি নির্ভরশীল দেশ। টাকার মান কমালে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আমরা অবকাঠামোতে বিদেশি বিনিয়োগ আশা করছি। কারেন্সি ডিভ্যালিউশন করা হলে এ খাতে বিনিয়োগ আসবে না। আর যেসব দেশ কারেন্সি ডিভ্যালিউশন করেছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছুটা চাপ নিয়েই শুরু হচ্ছে নতুন বছর। ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা গতি কমে যাওয়ায় আমদানি-রফতানির পরিমাণ কমছে। এজন্য অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের পরিমাণও কমছে।

তিনি বলেন, রাজস্ব আহরণে আরও মনোযোগী হতে হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কার্যকরী পলিসি গ্রহণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত অক্টোবরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে ডলারের বিপরীতে ভারতীয় মুদ্রা রুপির মান কমেছে ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

অর্থাৎ এক ডলারের বিপরীতে অক্টোবরে পাওয়া গেছে ৮৪.৭৫ টাকা। আগের বছরে জুলাইয়ে পাওয়া যেত ৮৩ দশমিক ৭৪ টাকা। তবে আমদানি পর্যায়ে কর্পোরেট ডিলিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে ৮৬ টাকা পর্যন্ত। রফতানি আয় কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহে টান পড়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, টাকার মান কমে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এতে সামগ্রিক পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ বেড়েছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ৪৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। শতাংশ হিসাবে ১৪ দশমিক ৪২। তবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা।

এটি মোট ঋণের লক্ষ্যমাত্রার ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং সরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৪ দশমিক ৪০ শতাংশ।

বিদেশি বিনিয়োগ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৯৩ লাখ মার্কিন ডলারের। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ লাখ মার্কিন ডলার কম। শতাংশ হিসাবে কমেছে ৬ দশমিক ০৬।

জানা গেছে, অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিমাসে প্রতিবেদন তৈরি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে নভেম্বরভিত্তিক। বিষয়টি অবহিত করতে পাঠানো হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ নিয়ে অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। যে কারণে ওই প্রতিবেদনটি গুরুত্বসহকারে নেয়া হয়।

আমদানি ও রফতানি প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়, সম্প্রতি জুলাই-অক্টোবরে রফতানি আয় কমেছে। এই চার মাসে রফতানি আয় হ্রাস পেয়েছে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৬১ কোটি মার্কিন ডলার। রফতানির প্রধান দুটি বাজার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। তবে ইইউ অঞ্চলে প্রথম তিন মাসে রফতানি আয় কমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রফতানির অর্ডার ও পণ্যের মূল্যও কমেছে। এছাড়া অবকাঠমোগত সমস্যা, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহারসহ বিভিন্ন কারণে রফতানি বাণিজ্য কমে গেছে। পাশাপাশি আমদানি কমে যাওয়ায় কাস্টমস রাজস্ব আয় কমেছে ২ দশমিক ২৯ শতাংশ। এ সময় আয়ের লক্ষ্য ছিল ৯৫৪ কোটি মার্কিন ডলার। বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয় ৯৩২ কোটি ডলার। এদিকে জুলাই-আগস্টে এলসি খোলার পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ। ২০১৮ সালের জুলাই-অক্টোবরের তুলনায় ২০১৯ সালের একই সময়ে রেমিটেন্স বেশি এসেছে ১০৫ কোটি মার্কিন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০ দশমিক ৪৮ শতাংশ। গত জুলাই-অক্টোবরে রেমিটেন্স এসেছে ৬১৫ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু আগের বছরে একই সময়ে এসেছে ৫১১ কোটি ডলার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, বৈধ পথে প্রবাসীদের আয় রেমিটেন্স বাড়াতে গত জুলাই থেকে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা চালু করা হয়েছে। অর্থাৎ ১০০ টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠালে তিনি ১০২ টাকা পাবেন। এরপর থেকে রেমিটেন্স বাড়তে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্টে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী দেখানো হয়েছে। ফলে নতুন বছরে এ নিয়ে এক ধরনের চাপের মুখে পড়তে হবে এমন আশঙ্কা রয়েছে। সেখানে বলা হয়, পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্য মূল্য ঊর্র্ধ্বমুখী, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যহ্রাস, চীন ও ভারতসহ বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের মূল্যস্ফীতি অনেকটা চাপের মুখে পড়েছে। টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ায় খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী বিরাজ করছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর