জেনারেলদের দায় নিজের কাঁধে তুলে নিলেন সুচি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সুনির্দিষ্ট এমন কিছু মুহূর্ত থাকে যখন খবরের প্রবাহ কোনো একটি ঝালরের ওপর ঝিলিক মেরে যায়। হেগে অং সান সুচির উপস্থিতি তারই একটি ছিল। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) তার শীতলতা এবং উপস্থাপনায় আবেগের কিছুই ছিল না। তিনি নতুন কিছুই বলেন নি। তবে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি আসলে কতখানি বদলে গেছেন। এটা ছিল চরম এক নাটকীয় মুহূর্ত। বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত সরকারগুলোর প্রতিনিধিরা যে স্থানটি দখল করেছিলেন, সেখানে বসেছিলেন অং সান সুচি। অথচ অতি সাম্প্রতিককাল পর্যন্তও তিনি ছিলেন সাহস, স্থির সংকল্প ও আত্মউৎসর্গের প্রতীক।
অতীতে গেলে যেকেউ কল্পনা করতে পারেন নৃশংসতা চালানো জেনারেলদের বিরুদ্ধে তার নেতৃত্বের কথা। এই জেনারেলরা তাকে বন্দি করেছিল এবং তার লোকজনকে কয়েক দশক ধরে নিষ্পেষণ করেছিল। হ্যাঁ, সেই সুচিই সেনাবাহিনীর পক্ষ অবলম্বন করে বক্তব্য রাখছিলেন। সেনাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার প্রমাণ দিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘ বলেছে, তার সরকার সবচেয়ে ভয়াবহ সব অপরাধ- গণহত্যার জন্য দায়ী। কিন্তু তিনি সেই অভিযোগও প্রত্যাখ্যান করলেন।

তার এই অবস্থানে থাকার কোনো কারণই ছিল না। অভিযোগটা হলো মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে, কোনো নামধারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। তিনি যদি আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ টিমের হাতে বিষয়টি ছেড়ে দিতেন তাহলে কেউ তাকে জিজ্ঞেসও করতো না। কিন্তু তিনি নিজে দেশের পক্ষে ওকালতি করতে হেগে পৌঁছেছেন। তিনি শেষ করলেন রক্তহীন এবং মিথ্যাকথা বলা একজন আইনজীবীর মতো। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে- এই অভিযোগ অস্বীকার করার চেষ্টা করেন নি তিনি। অথবা তিনি বলেছেন, অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল এটা এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

তিনি যে যুক্তি দিয়েছেন তাতে এমনটা বলা হয় নি যে, ভয়াবহ ঘটনাগুলো ঘটেনি। তবে তিনি বলার চেষ্টা করেছেন ওই ঘটনা গণহত্যার সমতুল্য নয়। আর এই বিষয়টির বিচার হতে পারে মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব কোর্ট মার্শালে। এ নিয়ে বিদেশী বেসামরিক আইনজীবীদের মাথা ঘামানোর কিছু নেই। সুচিকে যারা ভালভাবে জানেন, তারা এটা জানেন যে, তিনি পরামর্শ নিতে এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করতে অনীহা প্রকাশ করেন। তবে কেউ কেউ এটা লক্ষ্য করেছেন যে, এসব যুক্তি দেয়ার জন্য তার উপস্থিত হওয়া প্রয়োজন ছিল না। পক্ষান্তরে এর মধ্য দিয়ে এক লজ্জাজনক নৃশংসতায় আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, যে নৃশংসতায় তিনি ভাল কাজ করতে পারতেন।

এর ফলে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ যোগ হবে। অধিকারকর্মীরা যদি দাবি তোলেন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবরোধ দিতে এবং মিয়ানমারকে বর্জন করতে, তাহলে তাদের সেই আহ্বানকে প্রতিরোধ করা সরকার ও বিভিন্ন কোম্পানির জন্য কঠিন করে তুলবে এই ঘটনা।

সাবেক জেনারেলদের দ্বারা প্রণীত সংবিধানের অধীনে অং সান সুচির হাতে সেনাবাহিনীর বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা নেই। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রয়েছে কমান্ডার ইন চিফের নির্বাহী নিয়ন্ত্রণের অধীনে। সুচি যদি কোনো সংশোধনী আনার চেষ্টা করেন তাহলে এর বিরুদ্ধে কার্যকর ভেটো দেয়ার ক্ষমতা আছে ওই কমান্ডার ইন চিফের।  এক পর্যায়ে তাকে (সুচি) দৃশ্যত মনে হয়েছে, তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি গোপন আর্জি জানিয়েছেন। তার মাধ্যমে তিনি বলতে চেয়েছেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে বর্তমানে যে জটিল অবস্থা আছে তা যেন আরো জটিল করে তোলা না হয়।

গণহত্যার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, এটা হলো সেনাবাহিনী ও বেসামরিক সরকারের মধ্যে এখন যে সহযোগিতামূলক আভ্যন্তরীন সম্পর্ক আছে তাকে খর্ব করা। অন্তত মিয়ানমারের বর্তমান সংবিধানের অধীনে, যা সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষ পর্যন্ত সুচির ওপর সন্তুষ্ট হয়ে থাকতে পারেন জেনারেলরা। কারণ, তাদের অপরাধের দায় অং সান সুচি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাদেরকে দায় থেকে উদ্ধারে লড়াইয়ে নেমেছেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর