ওজুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধোয়ার দোয়া ও ফজিলত

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বুজুর্গ ওলামায়ে কেরাম অজুর ক্ষেত্রে প্রত্যেক অঙ্গ ধোয়ার সময় স্বতন্ত্র দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। এই সকল দোয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থেকে সাব্যস্ত নেই যে, তিনি অমুক অঙ্গ ধোয়ার সময় অমুক দোয়া পড়েছেন। তবে এতটুকু সাব্যস্ত যে, এই দোয়াগুলো রাসূল (সা.) বিভিন্ন সময় পড়েছেন, তাই বুজুর্গানে দ্বীন অজুতে বিভিন্ন অঙ্গ ধোয়ার সময় সেই দোয়াসমূহ পড়ার নিয়ম শিক্ষা দিয়েছেন, যাতে অজুর সময় ধ্যান খেয়াল ও মনোযোগ আল্লাহর প্রতি নিবিষ্ট থাকে।

ওজু শুরু করার দোয়া:
তাই বুজুর্গানে দ্বীন বলেছেন, ওজু শুরু করার সময় এই দোয়া পড়বে,
بسم الله العلى العظيم والحمدلله على ملت الا سلام
আল্লাহ তায়ালার নামে শুরু করছি, এবং সকল প্রশাংসা আল্লাহ তায়ালার, যিনি ইসলামের দৌলত প্রদান করেছেন।

কবজি ধোয়ার দোয়া:
এরপর হাতের কবজি ধোয়ার সময় এই দোয়া পড়বে,
اللهم انى اسئلك اليه من والبركة واعوذبك من الشؤم والهلاكة

আয় আল্লাহ, আমি আপনার কাছে কল্যাণ ও প্রাচুর্যের প্রার্থনা করছি, এবং ধ্বংস ও অমঙ্গল থেকে আপনার আশ্রয় চাচ্ছি।

কুলি করার দোয়া:
এরপর কুলি করার সময় এই দোয়া পড়াবে,
اللهم اعنى على تلا وة القران وذكرك وشكر وحسن عبادتك

আয় আল্লাহ, আমাকে কোরআন তেলাওয়াত আপনার জিকির ও শোকর এবং সুন্দর মতো আপনার ইবাদত করার তাওফিক দিন।

নাকে পানি দেওয়ার দোয়া:
নাকে পানি দেয়ার সময় এই দোয়া পড়বে,
اللهم ارحنى دائحة الجنة والا ترحنى دائحةالنار

আয় আল্লাহ আমাকে জান্নাতের সুগন্ধি শোকান এবং জাহান্নামের দুর্গন্ধ শোকাবেন না।

চেহারা ধোয়ার দোয়া:
চেহারা ধোয়ার সময় এই দোয়া পড়বে,
اللهم بيّض وجهى يوم تبيّضُ وجوه وسودّ وجوه

আয় আল্লাহ যে দিন কতক চেহারা উজ্জ্বল হবে আর কতক চেহারা মলিন হবে সেই দিন আপনি আমার চেহারা উজ্জ্বল রাখুন।

কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
يوم تبيض وجوه وسودّوجوهٌ

‘সেদিন হাশরের ময়দানে কতক চেহারা উজ্জ্বল হবে আর কতক চেহারা হবে মলিন।’ (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ১০৬) আমালে সালেহ করেছে এমন সকল মুমিনের চেহারা আল্লাহ তায়ালার দয়া ও অনুগ্রগে ঝলমলে উজ্জ্বল হবে, অন্যদিকে কাফের মুশরিকদের চেহারা হবে মলিন, কালিমাখা যুক্ত, অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
وجوه يومئذناضبرةه الى ربها نا ظرةه وجوه يومئذباسرة تظن ان يفعل بها فاقرة-

কেয়ামতের দিন কিছু চেহারা হবে উজ্জ্বল, তারা তাদের প্রতি পালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে, আর সে দিন কিছু চেহারা থাকবে উদাস, তারা ধারনা করবে, তাদের সঙ্গে কঠিন আচরণ করা হবে, (সূরা: কিয়ামা, আয়াত: ২২/২৫)।

আর এক জায়গায় আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,
وجوه يو مئذ مسفرة ضاحكة مستبشرة- وجوه يو مئذ عليها غبرة- ترهقها قترة- اولئك هم الكفرة الفجرة

‘এবং বহু মুখমণ্ডল সে দিন হবে উজ্জ্বল সহাসা, প্রফল, এবং বহু মুখমণ্ডল সে দিন হবে ধুলো মলিন, তাদেরকে কালিমা আচ্ছন্ন করে রাখবে, তারাই হবে কাফের পাপিষ্টের দল, (সূরা: আবাসা, আয়াত: ৩৮-৪২)।

কেয়ামতের দিন অঙ্গসমুহ উজ্জ্বল হবে:
হাশরের ময়দানে মানুষের চেহারার উজ্জ্বলতা কিংবা মলিনতা দেখেই বোঝা যাবে তার ঠিকানা কোথায় এবং কোথায় যেতে হবে। হাদিস শরিফে এসেছে, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় নিয়মিত অজু করেছে, আল্লাহ তায়ালা তাকে তার চেহারা কপাল হাত পাসহ সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঝলমলে  উজ্জ্বল করে তুলবেন, দূর থেকে তার অঙ্গ প্রতঙ্গের উজ্জ্বলতা দেখে লোকজন বুঝতে পারবে, লোকটি নামাজের উদ্দেশ্যে নিয়মিত অজু করত। (বুখারি, মুসলিম, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ)।

অন্য এক হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কেয়ামতের দিন আমার উম্মতের লোকজনের চেহারা উজ্জ্বল সাদা থাকবে। তাদের হাত পাও সাদা, চমকাতে থাকবে, কেয়ামত অবশ্যই সঙ্গটিত হবে, সেদিন চেহারা উজ্জ্বলতা হবে, আল্লাহ তায়ালার দরবারে মর্যাদাশীল হওয়ার আলামত, আর চেহারায় মলিনতা আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রখ্যাত হওয়ার আলামত, এই কারণেই বুজুর্গানে দ্বীন অজুর মধ্যে চেহারা ধোয়ার সময় এই দোয়া করতে বলেছেন, আয় আল্লাহ যে দিন কিছু চেহারা উজ্জ্বল হবে আর কিছু চেহারা মলিন হবে সেদিন আপনি আমার চেহারা উজ্জ্বল করে দিয়েন।

ডান হাত ধোয়ার দোয়া:
এরপর কনুইসহ ডান হাত ধোয়ার সময় এই দোয়া পড়বে,
اللهم اعطنى كتابى بيمينى وحاسبنى حسابايسيرا

আয় আল্লাহ আমার আমলনামা আমার ডান হাতে দিন, এবং আমার হিসেব সহজ করে দিন, এই দোয়াটি কোরআন শরিফের সেই আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেখানে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,
فأماّمن اوتى كتابه بيمينه- فسوف يحاسب حسابايسيرا- وينقلب الى اهله مسرورا

যার আমল নামা ডান হাতে দেয়া হবে, তার থেকে সহজ হিসেব নেয়া হবে, তারপর সে তার পরিজনের মাঝে সানন্দে ফিরে যাবে, (সূরা: ইনশিকাক, আয়াত: ৭-৯)। অর্থাৎ তার থেকে মামুলি হিসেব নিয়ে বলা হবে, যাও সোজা জান্নাতে চলে যাও, অন্যদিকে যার থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খু হিসেব নেয়া হবে, তাকে বলা হবে, তোমার সকল কর্মকাণ্ড অনুপুঙ্খ হিসেব দাও, এই প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে,
من نو قش الحساب عذب

যার থেকে অনুপুঙ্খ হিসেব নেয়া হবে, সে আজাবে নিপতিত হবে। (বুখারি মুসলিম, আবু দাউদ, আহমদ)।

যে ব্যক্তির পুরোপুরি হিসেব নিকেশ নেয়া হবে, তাকে এক এক করে প্রত্যেক কাজের হিসেব দিতে হবে। এমন ব্যক্তির সর্বশেষ পরিনাম হলো জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া। আল্লাহ তায়ালা আমদের সকলকে জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করুন। ঈমানের দৌলত এমন মূল্যবান যে, যখন আল্লাহ তায়ালা এই দৌলত কাউকে দান করেন, তখন তিনি তার সঙ্গে সদয় আচরণ করেন। যদি তার সামগ্রিক জীবন আল্লাহ তায়ালা আনুগত্যের মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হয়, যদি তার থেকে একটু আধটু সগিরা হয়েও যায় তবু আল্লাহ তায়ালা তার হিসেব কিতাবের ক্ষেত্রে পুঙ্খানু পুঙ্খ জিজ্ঞাসাবাদ করবেন না। তার সঙ্গে বরং সহজ মামুলি আচরন করা হবে, তাকে অবশ্যই আল্লাহ তায়ালার দরবারে হাজির করা হবে। এরপর তার আমলনামা অত্যন্ত হালকা ও সহজভাবে নিবিক্ষন করা হবে। তারপর আল্লাহ তায়ালা তার দয়া ও অনুগ্রহের বহি:প্রকাশ ঘটাবেন। তাকে জান্নাতে পাঠিয়ে দেবেন।

আর যেই ব্যক্তির সামগ্রিক জীবন গুনাহ খাতার মধ্যে অতিবাহিত হয় এবং আল্লাহ তায়ালার ব্যাপারে বেখবর, একদম ভুলে বসে আছে আল্লাহ তায়ালাকে, রোজ হাশরে আল্লাহ পাকের দরবারে হাজির হওয়ার অনুভূতই যার মাঝে নেই এমন ব্যক্তির কাছ থেকে অক্ষরে অক্ষরে হিসেব নেয়া হবে। আর যার থেকে এভাবে অনুপুঙ্খ হিসেব নেয়া হবে, অবশ্যই তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। তাই বুজুর্গানে দ্বিন বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা সমীপে এই প্রার্থনা কর, আয় আল্লাহ ডান হাতে আমার আমলনামা দিন এবং আমার থেকে সহজ হিসেব নিন। আরবি দোয়া মুখস্থ না থাকলে, মাতৃভাষায় দোয়া করলেও চলবে।

বাম হাত ধোয়ার দোয়া:
বাম হাত ধোয়ার সময় এই দোয়া পড়বে,
اللهم لا تعطنى كتابى بشما لى ولا من وراء ظهرى

আয় আল্লাহ আমার আমলনামা আমার বাম হাতে এবং পেছন দিকে দিয়েন না। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ঈমানদার ও নেক বান্দাদের আমলনামা তাদের ডান হাতে দেয়া হবে, আর কাফের ও বদকারদের আমলনামা পেছন দিক থেকে বাম হাতে দেয়া হবে। এই কারণেই এই দোয়া করা উচিৎ যে আয় আল্লাহ, আমার আমলনামা আমার পেছন দিক দিয়ে বাম হাতে দিয়েন না, আমি যেন কাফের ও বদকারদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে যাই।

মাথা মাসেহ করার দোয়া:
বুজুর্গানে দ্বীন মাথা মাসেহ করার সময় এই দোয়া পড়তে বলেছেন,
اللهم اظللنى تحت ظل عرشك يوم لاظل الا ظل عرشك

আয় আল্লাহ! আপনি আমাকে ওই দিন আপনার আরশের ছায়া দিন, যে দিন আপনার আরশের ব্যতিত কোনো ছায়া থাকবে না। মুসলমানই জানে, হাশরের ময়দানে যখন লোকজন একত্র হবে, তখন সেখানে ভীষন উত্তাপ থাকবে, সূর্য একদম কাছে চলে আসবে। হাদিস শরিফে এসেছে, মানুষ সে দিন নিজের নিজ ঘামের হাবুডুবু খাতে থাকবে, কারো হাঁটু পর্যন্ত ঘাম থাকবে, কারো থাকবে কোমর পর্যন্ত আবার কারো থাকবে বুক পর্যন্ত। কেউ আবার ঠোঁট পর্যন্ত ঘামে হাবুডুবু খেতে থাকবে, এভাবে মানুষ নিজ নিজ ঘামে ডুবে থাকবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে এই হাশর দিবসের উত্তাপ্ততা থেকে হেফাজত করুন। এই কারণেই বুজুর্গানে দ্বীন এই দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন, আয় আল্লাহ! যে দিন আপনার আরশের ছায়া ব্যতিত কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন আপনি আপনার আরশের ছায়ায় আমাকে আশ্রয় দেবেন।

গর্দান মাসেহ করার দোয়া:
গর্দান মাসেহ করার সময় এই দোয়া করা উচিত,
اللهم اعتق رقبتى من النار

আয় আল্লাহ আমার গর্দান জাহান্নামের আগুন থেকে নিরাপদ করে দিন।

ডান পা ধোয়ার দোয়া:
ডান পা ধোয়ার সময় এই দোয়া পড়বে,
اللهم ثبت قدمى على الصراط يوم تضل فيه الا قدام

আয় আল্লাহ! সেদিন পা পুলসিরাতের ওপর দৃঢ়পদ রাখুন, যেদিন লোকজনের পা পিছলে যাবে। পুলসিরাত হলো জাহান্নামের উপর স্থাপিত একটি সরু পাতলা পুল, এই পুল পেরিয়ে মানুষ জান্নাতে যাবে, যে ব্যক্তি জাহান্নামী হবে, তার পা সেই পুলের ওপর পদস্খলিত হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।

বাম পা ধোয়ার দোয়া:
এর পর বাম পা ধোয়ার সময় এই দোয়া পড়বে,
اللهم اجعل ذنبى مغفوراً وسعيى مشكورا وتجارتى لن تبورا

আয় আল্লাহ, আমার গুনাহ মাফ করে দিন। আমি যা কিছু করেছি, আপনি আপনার অনুগ্রহে তার প্রতিদান দিন এবং আমি যে ব্যবসায় করেছি, অর্থাৎ যেই জীবন আমি অতিবাহিত করে এসেছি, আসলেই যা ছিল ব্যবসায়, এর ফলাফল আখেরাতে প্রকাশ পাবেই। সুতরাং আয় আল্লাহ, আমার জীবনের বেচাবিক্রিকে আপনি ক্ষতিগ্রস্ত করবেন না। বরং এই ব্যবসায় আমাকে লাভবান করে আখেরাতে এদদ্বারা উপকৃত করুন।

মোটকথা হলো, বুজুর্গানে দ্বীনের কথামত ওজুর মধ্যে উল্লিখিত দোয়াসমূহ নিয়মিত করা উচিত। এ দোয়াগুলো অত্যন্ত উপকারী ও কার্যকর। রাসূল সালাহু আলাইহি ওয়াসালাম ওজুর সময় ওইসব দোয়া পড়েছেন। বিভিন্ন সময় ওইসব দোয়ার আমল করেছেন। এসবের একটি দোয়াও যদি আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন, তা হলেই ইনশাআলাহ্! সকল বিপদের অবসান ঘটবে।

উল্লিখিত দোয়াসমূহ আরবিতে মুখস্থ করে নেয়াই উত্তম। তবে ততক্ষন পর্যন্ত দোয়াগুলো মাতৃ ভাষায় করবে, এর ফলে আল্লাহ তায়ালা বাহ্যিক পবিত্রতার পাশাপাশি অন্তর্জগত ও পবিত্র করে দেবেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে এসব দোয়ার বরকত দান করুন, এবং আমাদের সবাইকে দোয়াসমূহের ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর