কৈশোরে শরীরচর্চা: দক্ষিণ কোরিয়া সবার নীচে, বাংলাদেশ শীর্ষে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ১১ হতে ১৭ বছর বয়সী শিশুরা শারীরিকভাবে মোটেই সক্রিয় নয়, অর্থাৎ তারা যথেষ্ট পরিমাণে শরীরচর্চা বা খেলাধূলায় অংশ নিচ্ছে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই জরিপে বলা হচ্ছে, বিষয়টা এখন প্রায় মহামারীর রূপ নিয়েছে। কারণ যথেষ্ট শরীরচর্চার অভাবে শিশুদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে, তাদের মস্তিস্কের বিকাশ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে এবং তাদের সামাজিক মেলা-মেশার দক্ষতা কমছে।

তবে এই জরিপে অবাক করার মতো একটি তথ্য হচ্ছে, শারীরিক সক্রিয়তার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে ভালো। অর্থাৎ শারীরিক নিষ্ক্রিয়তার সমস্যা বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে কম।

দিনে অন্তত একঘন্টা শরীরচর্চা বা কোন ধরণের খেলাধূলায় অংশ না নিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাকে ‘শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা’ বলে গণ্য করে।

জরিপে দেখা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার মেয়েরা (৯৭%) এবং ফিলিপাইনের ছেলেরা (৯৩%) হচ্ছে শারীরিকভাবে সবচেয়ে নিষ্ক্রিয়।, অন্যদিকে বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে এর হার ৬৬%।

Children watching TVডিজিটাল বিপ্লব শিশুদের ঘরে বন্দী করে ফেলেছে, বাইরে খেলতে যাচ্ছে না তারা।

বৈশ্বিক সমস্যা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই জরিপে বলা হয়, শিশুদের শারীরিক নিষ্ক্রিয়তার এই সমস্যা আফগানিস্তান থেকে শুরু করে জিম্বাবুয়ে- কম-বেশি সবদেশেই আছে।

১১ হতে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে চারজনই যথেষ্ট শরীরচর্চা করছে না, খেলাধূলা করছে না।

সমস্যাটা ধনী-গরীব সবদেশেই একই রকম। মোট ১৪৬ টি দেশের ওপর পরিচালিত জরিপে সেটাই দেখা যাচ্ছে।

তবে মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা একটু বেশি সক্রিয়।

কী ধরণের খেলাধূলা বা শরীরচর্চাকে গোণায় ধরা হয়েছে

যে কোন শারীরিক তৎপরতা, যাতে হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয় এবং ফুসফুসের মাধ্যমে আমাদের শ্বাস নিতে হয় ঘন ঘন, সেটাকেই হিসেবে ধরা হয়েছে।

এর মধ্যে আছে:

•দৌড়ানো

•সাইকেল চালানো

•সাঁতার কাটা

•ফুটবল

•লাফ দেয়া

•স্কিপিং

•জিমন্যাস্টিকস

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুস্বাস্থ্য এবং সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধূলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুস্বাস্থ্য এবং সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধূলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, প্রতিদিন অন্তত ৬০ মিনিট ধরে মধ্যম বা তীব্র মাত্রার শরীরচর্চা করা উচিৎ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ড: ফিওনা বুল বলেন, “এটিকে হাস্যকর টার্গেট বলে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না, এর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে। সুস্বাস্থ্য এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

মাঝারি এবং তীব্র মাত্রার শরীরচর্চার মধ্যে তফাৎটা হচ্ছে মাঝারি শরীরচর্চার মধ্যেও স্বাভাবিকভাবে কথা বলা যায়, দম ফুরিয়ে যায় না। কিন্তু তীব্র শরীরচর্চার সময় শ্বাস-প্রশ্বাস এত দ্রুত নিতে হয় যে তখন কথা বলা যায় না।

কেন শরীরচর্চা করা দরকার

মূল কারণ হচ্ছে স্বাস্থ্য ঠিক রাখা। শুধু বর্তমানের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ সুস্বাস্থ্যের জন্যও এটা দরকার।

স্বল্প মেয়াদে, শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকার মানে হচ্ছে:

•হৃদযন্ত্র এবং ফুসফুসকে কর্মক্ষম রাখা

•হাড় এবং পেশীকে শক্তিশালী করা

•মানসিক স্বাস্থ্যকে ঠিক রাখা

•ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা

শিশুরা এখন বাইরে সময় কাটাচ্ছে অনেক কমশিশুরা এখন বাইরে সময় কাটাচ্ছে অনেক কম

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডঃ রেজিনা গুটহোল্ড বলেন, “কেউ যদি কৈশোরে শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকে, এমন সম্ভাবনা প্রবল যে পরিণত বয়সেও তিনি সক্রিয় থাকবেন।”

আর কেউ যদি সারাজীবন এরকম সক্রিয় জীবন-যাপন করতে পারেন তাহলে তার হৃদরোগ, টাইপ-টু-ডায়াবেটিস হতে শুরু করে স্ট্রোকের মতো রোগের ঝুঁকি অনেক কমবে।

শুধু শরীর নয়, মস্তিস্কের বিকাশের সঙ্গেও এই শারীরিক সক্রিয়তার সম্পর্ক আছে বলে দেখতে পাচ্ছেন গবেষকরা।

এ যুগের শিশুরা কি তাহলে অলস?

এই জরিপের ফল দেখে কি এটাই মনে হয় না যে এখনকার শিশু-কিশোররা অনেক বেশি অলস? সুযোগে পেলে আমরা সবাই কি আসলে সোফায় বসেই সময় কাটিয়ে দিতে চাই?

ডঃ বুল বলেন, শিশুরা আসলে অলস নয়। এই জরিপ আসলে আমাদের সবার ব্যাপারেই একটা সত্যের দিকে নির্দেশ করছে, এটা কেবল শিশুদের ব্যাপার নয়। আমরা সবাই আসলে এখন শারীরিক তৎপরতাকে গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হচ্ছি, এটিকে অবহেলা করছি। পুরো দুনিয়া জুড়েই এটা ঘটছে।

Pupil working
পড়াশোনায় অনেক সময় দিতে হচ্ছে কিশোর-কিশোরীদের, ফলে খেলাধূলা গুরুত্ব হারাচ্ছে।

কী ঘটছে তাহলে

কেন আমরা আগের মতো আর শারীরিকভাবে সক্রিয় নই, তার একক কোন কারণ নেই। এর বহুবিধ কারণ।

একটা কারণ হচ্ছে, এখন শিশুদের শারীরিকভাবে ফিট রাখার চাইতে লেখাপড়ায় ভালো করাটাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

“৭ হতে ১১ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের ওপর পড়াশোনায় ভালো করার জন্য বেশ চাপ থাকে, পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য তাদের উৎসাহিত করা হয়”, বলছেন এই সমীক্ষায় জড়িত গবেষক লীন রাইলি।

“প্রায়শই তারা দিনের একটা দীর্ঘ সময় স্কুলে বসে কাটাচ্ছে, হোমওয়ার্ক করছে। শারীরিকভাবে যথেষ্ট সক্রিয় থাকার কোন সুযোগ তারা পাচ্ছে না।”

আরেকটা সমস্যা হচ্ছে খেলাধূলা এবং অন্যান্য অবসর বিনোদন কার্যক্রমের সুবিধার অভাব। এগুলোতে সবার সমান সুযোগ নেই। নিরাপত্তার সমস্যাও আছে।

রাস্তাঘাট যেহেতু নিরাপদ নয়, তাই সেখানে সাইকেল চালানো, হেঁটে কোন বন্ধুর বাড়িতে যাওয়া- এগুলোও আর সেভাবে হয় না।

আরেকটা বড় কারণ ডিজিটাল বিপ্লব। ফোন, ট্যাবলেট এবং কম্পিউটারে এখন ডিজিটাল গেম খেলার সুযোগ এত বেশি যে বাইরে গিয়ে খেলাধূলা করার চেয়ে এটা বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়।

ডঃ বুলের মতে, “এখন নানা রকম বিনোদনের যে বিপুল সুযোগ-সুবিধা, তা অভূতপূর্ব। আগের কোন প্রজন্মের সঙ্গে এর তুলনাই চলে না।”

Girls playing volleyballজরিপে বলা হচ্ছে, শরীরচর্চায় মেয়েরাও পিছিয়ে ছেলেদের তুলনায়

কোন দেশের অবস্থান কোথায়

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সবদেশেই সমস্যাটা একই রকম। বাংলাদেশের অবস্থান যদিও সূচকে বেশ ভালো, তারপরও সেদেশেও ৬৬ শতাংশ শিশু প্রতিদিন এক ঘন্টা যে শরীরচর্চা বা শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকার কথা, সেটা করছে না।

ফিলিপাইন আর দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।

যুক্তরাজ্যে ৭৫ শতাংশ ছেলে এবং ৮৫ শতাংশ মেয়ে শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয়, অর্থাৎ তারা দিনে এক ঘন্টা ব্যায়াম করছে না।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

কানাডার ইস্টার্ন অন্টারিও শিশু হাসপাতালের ডঃ মার্ক ট্রেম্বলে বলছেন, “ইলেকট্রনিক বিপ্লব মানুষের শারীরিক নড়াচড়ার ধরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে। মানুষ এখন কোথায় কিভাবে থাকে, কিভাবে শেখে, কাজ করে, খেলে, বেড়াতে যায়—এই সব কিছুই বদলে গেছে। এখন মানুষ আরও বেশি করে ঘরে বন্দী হয়ে গেছে। তাদের বেশিরভাগ সময় কাটছে চেয়ারে।”

“মানুষ ঘুমাচ্ছে কম, বসে থাকছে বেশি, হাঁটছে অনেক কম, গাড়ি চালাচ্ছে অনেক বেশি এবং আগের তুলনায় শারীরিক তৎপরতা কমে গেছে অনেক।”

রয়্যাল কলেজ অব পেডিয়াট্রিক্স এন্ড চাইল্ড হেলথের অধ্যাপক রাসেল ভাইনার বলেন, এই গবেষণার ফল খুবই উদ্বেগজনক।

“যেসব শিশু শারীরিকভাবে বেশি সক্রিয় তাদের স্বাস্থ্যও ভালো এবং স্কুলেও তারা অনেক বেশি ভালো করছে।”

“আমাদের উচিৎ শিশু এবং তরুণরা যাতে আরও বেশি শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকে এবং স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপন করে, আমাদের সেটা নিশ্চিত করা উচিৎ। তবে এটা বলা যত সহজ, করা ততটাই কঠিন।”

 

BBC BANGLA

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর