দেশেই তৈরি হচ্ছে বিশ্বের শীর্ষ ইলেকট্রনিক পণ্য স্যামসাংয়ের স্মার্টফোন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে স্যামসাংয়ের ফ্ল্যাগশিপ ডিভাইসসহ (গ্যালাক্সি নোট এবং এস সিরিজ) সব ফোন ও ট্যাব সংযোজন হবে দেশে। এ ছাড়া ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকে মাদারবোর্ডসহ অন্যান্য কম্পোন্যান্ট তৈরির মধ্য দিয়ে পুরোদমে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানালেন ফেয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আলম আল মাহবুব। তিনি বলেছেন, দেশে মোবাইল শিল্প গড়ে তুলতে সহায়ক শিল্প (ভেন্ডর) প্রতিষ্ঠায় জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে এই শিল্পে পোশাক খাতের মতো দীর্ঘ মেয়াদে নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে।

দেশে তৈরি হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক বিশ্বের শীর্ষ ইলেকট্রনিক পণ্য নির্মাতা স্যামসাংয়ের স্মার্টফোন। এসব স্মার্টফোনের প্যাকেজিংয়ে লেখা থাকছে মেড ইন বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের জুন মাসে নরসিংদীর শিবপুর উপজেলায় কারখানা স্থাপন করছিল ফেয়ার ইলেকট্রনিকস। এক বছর ১৫ লাখ ফোরজি স্মার্টফোন দেশে সংযোজন করেছে স্যামসাংয়ের পরিবেশক ফেয়ার ইলেকট্রনিকস। আগামী দুই মাসের মধ্যে ট্যাবলেট ও ফ্ল্যাগশিপ ডিভাইস সংযোজনের সুখবর জানালেন ফেয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রুহুল আলম আল মাহবুব। তিনি বলেন, ‘দেশে মোবাইল উত্পাদনে (ম্যানুফ্যাকচারিং) উত্সাহী করতে গত বাজেটে হ্যান্ডসেট আমদানির ওপর শুল্ক, কর বাড়ানো এবং স্থানীয় উত্পাদনে শুল্ক ছাড় দেওয়া ছিল যুগোপযোগী পদক্ষেপ। এতে যারা কারখানা স্থাপন করেনি তারা চাপে পড়েছে। আশা করি বাকিরাও দ্রুতই আসবে।’

রুহুল আলম আল মাহবুব, চেয়ারম্যান, ফেয়ার গ্রুপ

স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে দেশের মোট চাহিদার অর্ধেক পূরণ হচ্ছে জানিয়ে ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের এমডি বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে ৫০ শতাংশ মার্কেট শেয়ার অর্জনে সক্ষম হয়েছি। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ স্থানীয় উত্পাদন দিয়ে আমরা মোবাইল ফোনের ৯৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ করতে পারব বলে আশা করি। বর্তমানে বছরে তিন কোটি হ্যান্ডসেটের (ফিচার ও স্মার্ট) চাহিদা আছে যার বাজার মূল্য ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে স্মার্টফোনের বাজার সাত হাজার কোটি টাকার। ভলিউমে বা সংখ্যায় ফিচার ফোনের বাজার ৭০ শতাংশ এবং স্মার্টফোন ৩০ শতাংশ। কিন্তু মূল্যমান অনুযায়ী মোট বাজারের প্রায় ৭০ শতাংশ স্মার্টফোনের দখলে। গত বছর স্মার্টফোনে ১২%, ফিচার ফোনে ৩% শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।’

২০০৯ সালে স্যামসাং বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ১০ বছর এবং কোরিয়ায় ৫০ বছর পূর্ণ করল তারা। স্যামসাংয়ের মার্কেট শেয়ার সম্পর্কে জানতে চাইলে রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, ‘বর্তমানে স্যামসাং বাংলাদেশের স্মার্টফোন বাজারে ১ নম্বর ব্র্যান্ড হিসেবে দৃঢ় অবস্থানে আছে। স্মার্টফোনের বাজারে মূল্যমানে আমাদের মার্কেট শেয়ার ৪৫ শতাংশ। আর ভলিউমে এটা ৩১ শতাংশ। আগামী বছর এটা ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ হবে বলে আমরা আশা করি। আগামী বছর থেকে স্যামসাংয়ের সব স্মার্টফোন বাংলাদেশে প্রস্তুত হবে। ফ্ল্যাগশিপ ডিভাইস ও ট্যাব আমরা আরো সাশ্রয়ী দামে ক্রেতাদের দিতে পারব।’

নরসিংদীর শিবপুর উপজেলায় ২৫ একর জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে স্যামসাংয়ের কারখানা। সেখানে মোবাইল ডিভিশনে কর্মসংস্থান হয়েছে ৪০০ জনের যাদের ৯৯ শতাংশই বাংলাদেশি বলে জানালেন ফেয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘দেশে মোবাইলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় আমাদের অভিজ্ঞ লোক আনতে হয়েছে।’

তবে দেশে স্মার্টফোন সংযোজনে অনেক কারখানা তাদের কার্যক্রম শুরু করলেও এখনো ভেন্ডর (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি) গড়ে উল্লেখ করে এই শিল্পোদ্যোক্তা বলেন, ‘দেশে স্মার্টফোনের ভেন্ডর শিল্প প্রতিষ্ঠায় নীতি সহায়তা দরকার, যা লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি স্থাপনে বিনিয়োগ উত্সাহী করবে। ব্যাটারি, চার্জার, কার্টুন, এয়ারফোন, কেসিং থেকে শুরু করে যারা লিংকেজ শিল্প গড়ে তুলবে তাদেরও স্থানীয় শিল্পের মতো সুবিধা দিতে হবে। আমরা আশা করছি, আগামী বাজেটে আমরা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আশা করি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই এখন এসএমটি স্থাপন করে স্মার্টফোনের পিসিবি তথা মাদারবোর্ড উত্পাদনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমাদের ব্যাটারি এবং চার্জার বানানোর জন্য একটি নীতিমালা দিয়েছে সরকার যেখানে ট্যাক্স বেনিফিট আছে। আমরা বলছি, ব্যাটারি এবং চার্জার আমাদের বানানোর দরকার নেই। স্থানীয়ভাবে যদি কেউ বানায় আমরা তার কাছ থেকে নেব এমনকি আমাদের প্যাকেজিংসহ। আমরাই যদি সব বানাই তাহলে দেশে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠবে না। সে ক্ষেত্রে মেশিনারিজ খাতে বিনিয়োগ নষ্ট হবে এবং সক্ষমতা অব্যবহূত থাকবে।’

দেশে সংযোজিত স্যামসাংয়ের মোবাইল ফোনের মান কেমন, গ্রাহকরা তা কিভাবে নিচ্ছে জানতে চাইলে রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, ‘স্যামসাং পৃথিবীর যেখানেই পণ্য তৈরি করে তার গুণগত মানের কোনো পার্থক্য নেই। সেটা চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, ভারত কিংবা বাংলাদেশে হোক। গ্রাহকরা খুবই গর্বের সঙ্গে কিনছে মেড ইন বাংলাদেশ ফোন। আমরা ১২০ দিনের একটা রিপ্লেসমেন্ট ওয়ারেন্টি দিচ্ছি। আমাদের কারখানায় ডিফল্ট রেশিও স্যামসাংয়ের গ্লোবাল ডিফল্ট রেশিওর চেয়ে অনেক কম। এতেই প্রমাণ হয় আমাদের দেশীয় কর্মীদের দক্ষতা।’

এখন স্যামসাংয়ের আটটি মডেলের ফোন সংযোজন হচ্ছে উল্লেখ করে ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের এমডি বলেন, ‘আগামী বছরের প্রথম দিকে স্যামসাংয়ের ট্যাবও বানাব। এ ছাড়া আমাদের ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের পরবর্তী ধাপ মাদারবোর্ড বানানো। এ জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা স্যামসাংয়ের ২৪টি মডেলের ফোন দেশে সংযোজন করেছি। যদিও এর মধ্যে কিছু মডেল গত বছর শেষ হয়ে গেছে। হাই এন্ডের ফ্ল্যাগশিপসহ বছর শেষে আমরা ১০টি মডেলের ফোন বানাব। এখন পর্যন্ত আমরা এ সিরিজি, এম সিরিজসহ সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা দামের গ্যালাক্সি-এ ৭০ সিরিজের ফোন সংযোজন করছি।’

স্যামসাংয়ের ফোন রপ্তানি হবে কি না জানতে চাইলে ফেয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার স্থানীয় বাজার। সেটার চাহিদা পূরণ করতে পারলে আমরা রপ্তানির বিষয়েও ভাবব। আশা করছি, ২০২০ সালের শেষ নাগাদ স্থানীয় উত্পাদন দিয়ে ৯৫ শতাংশ চাহিদা পূরণে সক্ষম হব।’

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবে অনেকে চীন থেকে কারখানা স্থানান্তর করছে। বাংলাদেশ এই সুযোগ কিভাবে কাজে লাগাতে পারে জানতে চাইলে রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, ‘প্রত্যেকটি শিল্পের একটি মোক্ষম সময় থাকে। এখন আমরা নিজেদের কিভাবে তৈরি করব সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। চীন থেকে কারখানা সরবে কিন্তু আমরা যদি প্রস্তুত না থাকি তাহলে যারা প্রস্তুত আছে যেমন : ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া চলে যেতে পারে। এসব জায়গায় সরকারের আরো নজর দেওয়া উচিত। চীনে যে ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে, তা আমাদের দেশে গড়ে তুলতে ব্যাপক কর্মতত্পরতা হাতে নিতে হবে। আমাদের এখানে ব্যাকুয়ার্ড লিংকেজ গড়ে তুলতে প্রত্যেকটি ইন্ডাস্ট্রির জন্য আলাদা আলাদা সাপোর্ট প্রগ্রাম হাতে নিতে হবে। ভিয়েতনামের সঙ্গে যেখানে ১৩০ গন্তব্যে সরাসরি ফ্লাইট আছে সেখানে আমাদের আছে মাত্র ১৫-১৮টি। বাংলাদেশ বিমানের অনেক নতুন এয়ারক্রাফট এসেছে, যা দিয়ে আরো নতুন গন্তব্য উন্মোচিত হবে বলে আশা করি।’

মোবাইল ফোন শিল্পের জন্য চোরাই ফোন একটি বড় সমস্যা বলে জানালেন ফেয়ার গ্রুপের অধিকর্তা। তিনি বলেন, ‘সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা কারখানা করেছি। আমাদের বিনিয়োগের সুরক্ষা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। এ জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের মনিটরিং আরো কার্যকর করা এবং ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন রেজিস্ট্রেশন দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।’

কালের কন্ঠ

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর