যুবলীগ নেতা (জিকে) শামীমের সব কাজ বাতিলের নির্দেশ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মাদক, অস্ত্র ও ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার যুবলীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া (জিকে) শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিকে বিল্ডার্স অ্যান্ড কম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড সরকারি যতগুলো প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছে, ক্রয়নীতি (পিপিআর) অনুসরণ করে সব প্রকল্পের কাজ বাতিল করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিমকে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিকে বিল্ডার্স যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, সেগুলো যাতে মুখ থুবড়ে না পড়ে থাকে। যত দ্রুত সম্ভব এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্পের কাজ বাতিল করে নতুন কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিতে। বাতিল প্রক্রিয়াটি সরকারি ক্রয়নীতি অনুযায়ী করতেও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। চলমান মাদক, ক্যাসিনো ও টেন্ডারবাজির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান আরো জোরদার হবে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। সভায় উপস্থিত একাধিক সরকারের নীতিনির্ধারক এসব তথ্য জানান। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করেন।
সভায় উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা জানান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন যেসব প্রকল্প জিকে বিল্ডার্স বাস্তবায়ন করছে সেসব প্রকল্পের ভবিষ্যত নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু করেন পরিকল্পনা সচিব নূরুল আমিন। তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) দুই লাখ কোটি টাকার বেশি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান (জিকে বিল্ডার্স) বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ১৭টির মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ওইসব প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ আছে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যদি শ্লথ হয়, তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এডিপি বাস্তবায়নের ওপরও। বছর শেষে দেখা যাবে, এডিপি বাস্তবায়ন কমে গেছে। তাই যেসব নতুন প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, সেসব প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু করার তাগিদ দেন এই সচিব। যাতে করে এডিপির গড় বাস্তবায়ন হার ঠিক থাকে। এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিকে বিল্ডার্স যতগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, সবগুলো চুক্তি বাতিল করা হবে। সেখানে নতুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হবে। এই কাজটি দ্রুত শেষ করতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

একনেক সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রধানমন্ত্রীর বেশ কয়েকটি নির্দেশনা তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বৃতি দিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের মতো দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আরেকটি পারমানবিক বিদ্যুতকেন্দ্র করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এরইমধ্যে তিন-চারটি স্থান বাছাই করা হয়েছে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য। তবে এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। দেশে নতুন করে আর ইউক্যালিপটাস গাছ না লাগানোর নির্দেশও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রামসহ দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে ইউক্যালিপটাস গাছ কিভাবে পরিবেশ ধ্বংস করছে, এবং পানির স্তর আরে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে সে বিষয়টি গতকাল একনেক সভায় আলোচনা হয়েছে। এই গাছটি অধিক পানি শোষণ করে এবং পরিবেশের নানাভাবে ক্ষতি করে তাই সামনের দিনগুলোতে দেশের কোথাও এই গাছ আর না লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ইউক্যালিপটাস গাছ না লাগিয়ে পানি কম শোষণ করে এমন গাছ লাগানোর কথা বলেছেন তিনি। দেশের সকল মহাসড়কে টোল আদায় করতে ফের প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী। কয়েক সপ্তাহ আগে এক একনেক সভায় দেশের মহাসড়কগুলোতে টোল আদায়ের কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী আরো বলেন, দেশের সরকারি ও বেসরকারি সকল মেরিন একাডেমি একই শিক্ষা কারিকুলামের আওতায় এনে শিক্ষার মানোন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। দেশে কত সংখ্যক বিদেশি শ্রমিক কাজ করছে এবং বিদেশের মাটিতে কত সংখ্যাক বাংলাদেশি কাজ করছে, তার সঠিক হিসাব বের করারও নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আগামী ২০২১ সালে জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পে যাতে সবাই গণনায় আসে সেটি নিশ্চিত করার কথা বলেছেন তিনি। এদিকে গতকাল একনেক সভায় ১১ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট দশটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে খরচ হবে আট হাজার ২৭১ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে তিন হাজার ১৯৬ কোটি টাকা পাওয়ার আশা করছে সরকার।

ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা :
দেশে প্রকৃত জনসংখ্যা কত তা জানতে দেশব্যাপী ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনার কাজ শুরু হবে আগামী ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি। দিন রাত ২৪ ঘন্টা এই শুমারির কাজ চলবে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। ষষ্ঠ জনশুমারির কাজ মার্চে হওয়ার কথা থাকলেও গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় নতুন এই সিদ্ধান্ত হয়।

সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের জানান, এবারের জনশুমারিতে প্রথমবারের মতো বিদেশের মাটিতে কতসংখ্যাক বাংলাদেশি অবস্থান করছে তা গণণা করা হবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের মাটিতে কতসংখ্যক বিদেশি অবস্থান করছে তা-ও বের করা হবে। এর আগে ১৯৭৩ সাল থেকে যতবার আদমশুমারি হয়েছিল, কখনো এই উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, এর আগে সর্বশেষ পঞ্চম আদমশুমারি হয়েছিল ২০১১ সালের ১১ মার্চ। ১৫ মার্চ পর্যন্ত চলেছিল আদমশুমারির কাজ। ওই শুমারির প্রাথমিক ফলে দেশের জনসংখ্যা উঠে এসেছিল ১৪ কোটি ২৩ লাখ। পরে সরকারের মন্ত্রীসহ বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (বিআইডিএস) দিয়ে শুমারির কাজ মূল্যায়ন করা হয়। ২০১২ সালে প্রকাশিত চূড়ান্ত ফলে দেখা গেছে, দেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার। অবশ্য ২০১৩ সালে পরিসংখ্যান আইন অনুমোদনের মাধ্যমে আদমশুমারির পরিবর্তে নতুন নাম রাখা হয়েছে জনশুমারি।

গতকাল একনেক সভায় ষষ্ঠ জনশুমারির সময়কাল নিয়ে আলোচনা হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, মার্চে অনেক উৎসব ও অনুষ্ঠান থাকে। ওইসময় ঘরে ঘরে গিয়ে তথ্য আনার সময় নেই। সবাইকে তখন পাওয়া যাবে না। বছরের শুরুতেই সবাইকে পাওয়া যাবে। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি প্রাথমিক পর্যায়ে বই বিতরণ করা হবে। তার পর দিন ২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনার কাজ উদ্বোধন করবেন।

গতকাল একনেক সভায় ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পটি এক হাজার ৭৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে এক হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা খরচ হবে। বাকি ১৮৩ কোটি টাকা জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল, ইউনিসেফ, ডিএফআইডি ও ইউএসএআইডি দেবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।

২০১১ সালের পঞ্চম আদমশুমারিতে সরকারের খরচ হয়েছিল ২৩৭ কোটি টাকা, দশ বছরের ব্যবধানে একই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কেন এক হাজার ৭৬২ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে- গতকাল একনেক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দশ বছর অনেক সময়। এসময়ে বিভিন্ন সেবা ও পণ্যের দাম বেড়েছে। ২০১১ সালে আদমশুমারিতে গণনাকারী ছিল তিন লাখ ৭৬ হাজার, এবার তা বাড়িয়ে পাঁচ লাখ ৬ হাজার গণনাকারী করা হচ্ছে। ২০১১ সালে গণনাকারীর সম্মানি ছিল দুই হাজার টাকা এবছর তা হচ্ছে আট হাজার টাকা। আগে মোটরসাইকেল ছিল না। এবার সাইকেল সংযোজন করা হচ্ছে গণনাকারীদের জন্য। তারপরও এই প্রকল্পে যদি অস্বাভাবিক কোনো খরচ হয়, তা অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে সাংবাদিকদের আহ্বান জানান মন্ত্রী।

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পটি যখন প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে নিয়ে আসে বিবিএস, তখন এর ব্যয় ছিল তিন হাজার ৫০১ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে অস্বাভাবিক খরচ দেখে বিস্মিত হন খোদ পরিকল্পনামন্ত্রী। পরবর্তীতে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এই প্রকল্পের খরচ এক হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা কমানো হয়। এক হাজার ৭৩৯ কোটি টাকায় যদি জনশুমারি প্রকল্পের কাজ করা যায়, সেটি কেন তিন হাজার ৫০১ কোটি টাকা ধরা হলো এমন প্রশ্নে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ সামাজিক বিভাগের সচিব আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, সব কর্মকর্তা দক্ষ, আমরা সেটি দাবি করব না। অদক্ষ কর্মকর্তাও আছে। ভূত সবখানেই আছে। আমরা পরিকল্পনা কমিশন সেই ভূত সারনোর উদ্যোগ নিয়েছি। এই প্রকল্পের আওতায় ভ্রমণ ব্যয়, আপ্যায়ন, সফটওয়্যার মোটরসাইকেল কেনা বাবদ যে খরচ ধরা হয়েছিল, তা অনেক কমানো হয়েছে।

গতকালের একনেক সভায় ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পটিসহ মোট দশটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট খরচ হবে ১১ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। এরমধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে খরচ হবে আট হাজার ২৭১ কোটি টাকা। আর বাকি তিন হাজার ১৯৬ কোটি টাকা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আশা করছে সরকার। দেশে প্রথম আদমশুমারি হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। পরবর্তীতে ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০১ এবং ২০১১ সালে আদমশুমারি হয়েছিল। প্রতি দশ বছর পর পর এই শুমারি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর