সততার আড়ালে ভূমি সচিবের ভিন্ন চেহারা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নিজেকে সৎ দাবি করলেও ভূমি সচিব মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী সরকারি গাড়ি অপব্যবহারে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। প্রাধিকারের বাইরে তিনি পরিবারের জন্য ব্যবহার করছেন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর জন্য বরাদ্দকৃত পাজেরো গাড়ি এবং টাঙ্গাইল জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের জন্য কেনা প্রাইভেট কার।
শুধু তা-ই নয়, সরকারের ঋণ সুবিধায় ৩০ লাখ টাকা নিয়ে প্রাইভেট কার কিনলেও তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন লঙ্ঘন করে প্রতিমাসে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ভাতা বাবদ তুলে নিচ্ছেন পুরো ৫০ হাজার টাকা, যা তিনি পারেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভূমি সচিব মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগে প্রশাসনের কে অভিযুক্ত নয়? অনুসন্ধান করলে বেশির ভাগ সচিবের বিরুদ্ধে এমন তথ্য পাবেন। তবে যেহেতু বিষয়টি সামনে এনেছেন, তাই এখন থেকে প্রাধিকারের বাইরে কোনো গাড়ি ব্যবহার করব না।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেহেতু সরকারের ঋণ সুবিধায় গাড়ি কিনেছি এবং সচিব হিসেবে আমার পদের বিপরীতে বরাদ্দকৃত মন্ত্রণালয়ের গাড়ি ব্যবহার করছি, সেহেতু ঋণে কেনা গাড়ির পুরো ভাতা তুলতে পারব না। এটিও সত্য। তবে দেখুন, এ বিষয়টিও ৯০ শতাংশের বেশি কর্মকর্তা মানছেন না।’

এ সময় সচিব মাকছুদুর রহমান দাবি করেন, তিনি যোগ দেয়ার পর ভূমি মন্ত্রণালয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি ও তদবির বাণিজ্য একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি এ পর্যন্ত ২৩টি জেলা সফর করেছেন, রাতদিন কাজ করে মন্ত্রণালয়ের অনেক উন্নতি করেছেন।

কিন্তু বহু সেবাপ্রার্থীর অভিযোগ রয়েছে, ভূমি সচিবের সিদ্ধান্তহীনতায় জনস্বার্থের ফাইল নিয়ে সাধারণ মানুষকে মাসের পর মাস মন্ত্রণালয়ের বারান্দায় ঘুরতে হয়। শতভাগ আইন ও বিধিবিধানের মধ্যে থাকা ফাইলও সহজে নিষ্পত্তি হয় না। সচিবের অহেতুক কোয়ারি যন্ত্রণায় সেবাপ্রার্থীরা অতিষ্ঠ।

যে ফাইল ৩ দিনে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, তা ৩ মাসেও আলোর মুখ দেখে না। এছাড়া সচিবের ঘন ঘন জেলা সফরের কারণে ফাইল নিষ্পত্তি জট আরও বেহাল হয়ে পড়েছে। এমন অভিযোগের বিষয়ে সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মাকছুদুর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। আমি সততা, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করছি।’

সচিবের গাড়ি সমাচার : ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কাজ ও মাঠপ্রশাসনে সফরের জন্য প্রগতি থেকে কেনা দুটি দামি পাজেরো গাড়ি সংরক্ষিত আছে। যার একটি ব্যবহার করেন সচিব এবং অপরটি মন্ত্রী। মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্বে যিনি থাকেন, তিনি ব্যবহার করেন ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৫-০৮৬৮নং পাজেরো। যথারীতি বর্তমান সচিব মাকছুদুর রহমান শুরু থেকেই এ গাড়িটি ব্যবহার করে আসছেন। কিন্তু এর বাইরে সচিব তার পরিবার বা স্ত্রী-সন্তানদের জন্য আরও দুটি গাড়ি অতিরিক্ত ব্যবহার করছেন।

যার একটি হল মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর জন্য বরাদ্দকৃত পাজেরো গাড়ি। যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৫-৬৯৪৮। বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ব্যবহার করতেন এই গাড়ি। কিন্তু বর্তমান ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ মন্ত্রণালয়ের গাড়ি না নিয়ে ব্যক্তিগত রেঞ্জ রোভার গাড়ি ব্যবহার করেন।

সেক্ষেত্রে এই গাড়িটি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কাজ ছাড়া অন্য কারও ব্যবহার করার সুযোগ না থাকলেও সচিব মাকছুদুর রহমান পরিবারের ব্যক্তিগত কাজে প্রতিদিন ব্যবহার করে আসছেন। সূত্রমতে, গাড়িটি ঢাকার মধ্যে ব্যবহৃত হওয়া ছাড়াও সচিবের এক সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আনা-নেয়ার জন্য রাজধানীর বাইরে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় যাতায়াত করে থাকে। গাড়িটির চালক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি ভূমি আপিল বোর্ডের চালক। এই গাড়ির শুধু জ্বালানি তেলের পেছনে মন্ত্রণালয়ের প্রতিমাসে ব্যয় হয় কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকা।

এছাড়া টাঙ্গাইল জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের (জেডএসও) জন্য কেনা একটি দামি প্রাইভেট কার (ঢাকা মেট্রো-গ ৩৩-৯২৪৪) ব্যবহার করা হয় সচিবের পরিবারের জন্য। টাঙ্গাইলে জেডএসও পদটি দীর্ঘদিন থেকে শূন্য রয়েছে। ময়মনসিংহের জেডএসও কামরুজ্জামান মিয়া টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে গাড়িটি ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর ঢাকায় এনে সচিবের পারিবারিক কাজে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে।

এই গাড়ির চালকের নাম হাসান। তিনি উন্নয়ন প্রকল্পের গাড়িচালক। সূত্রমতে, এই গাড়ির পেছনে প্রতিমাসে জ্বালানি ব্যয় কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা। তবে জ্বালানি তেল, চালকের বেতনভাতা ও গাড়ির সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ সচিবের পরিবারের জন্য ব্যবহৃত অতিরিক্ত এই দুটি গাড়ির পেছনে সরকারের প্রতিমাসে ব্যয় হচ্ছে লক্ষাধিক টাকা।

এখানেই শেষ নয়, ভূমি সচিব সরকারি ঋণ সুবিধায় অনেক আগে ৩০ লাখ টাকা দিয়ে প্রিমিও প্রাইভেট কার কিনেছেন। কিন্তু গাড়িটি তেমন একটা ব্যবহার করা হয় না। বেশির ভাগ সময় রমনা এলাকায় সচিব কোয়ার্টারের গ্যারেজে কাভার দিয়ে ঢাকা থাকে। ব্যাটারি সচল রাখার জন্য মাঝেমধ্যে চালানো হয়।

গাড়ি নগদায়ন নীতিমালা অনুযায়ী উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ের যেসব কর্মকর্তা এই গাড়ি সুবিধা গ্রহণ করেছেন, তাদেরকে বেতনের সঙ্গে প্রতিমাসে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিবহন অধিশাখা থেকে ২০১৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, প্রাধিকারপ্রাপ্ত যেসব কর্মকর্তার সার্বক্ষণিক গাড়ি ব্যবহারের সুবিধা রয়েছে, তারা ঋণ সুবিধায় গাড়ি কিনে থাকলে তাদেরকে ৫০ হাজার টাকার পরিবর্তে ২৫ হাজার টাকা দেয়া হবে।

কিন্তু ভূমি সচিব এই তথ্য গোপন করে প্রতিমাসে বেতনের সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা তুলে নিচ্ছেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাও এর দায় এড়াতে পারবেন না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটি অবশ্যই ক্ষমতার অপব্যবহার, যা দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে।

কোনো কর্মকর্তা প্রাধিকারের বাইরে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন না। প্রশাসনের সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এমন অভিযোগ এলে নিচের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগে শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন হবে। বিষয়টি অবশ্যই তদন্তের দাবি রাখে। প্রত্যাশা করব, কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভূমি মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কোনো কর্মকর্তা এভাবে তথ্য গোপন করে বাড়তি সুবিধা নিতে পারেন না। এটি অর্থ আত্মসাৎ পর্যায়ের অপরাধ বলে গণ্য হবে। দুর্নীতি বললেও ভুল বলা হবে না। তারা বলেন, একজন সচিব হিসেবে তিনি তো এটি করতেই পারেন না। কেননা এটি তো জানা সত্য।

ভুল এক মাস হতে পারে, প্রতিমাসে হতে পারে না। আইনের পরিভাষায় অতিরিক্ত নেয়া অর্থ ফেরতযোগ্য এবং এটি অসদাচরণ। অপরদিকে সচিব হিসেবে তিনি অতিরিক্ত যে দুটি গাড়ি এতদিন ব্যবহার করে এসেছেন, এটি তো আরও গুরুতর অপরাধ। তারা বলেন, সচিব যেখানে প্রতিনিয়ত আমাদের নীতি-আদর্শের কথা বলছেন, আইন ও বিধিবিধান মেনে চলার নির্দেশনা দিচ্ছেন, সেখানে তিনি নিজেই আইন মানছেন না।

এটি সততার আড়ালে ভিন্ন চেহারার বহিঃপ্রকাশ। তারা প্রত্যাশা করেন, নিশ্চয়ই এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশন যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কেননা আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান হওয়া উচিত।

প্রসঙ্গত, ভূমি সচিব মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে ভূমি মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর। সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান ২৬ মে।

যুগ্ম সচিব থেকে তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা ২০১১ সাল থেকে গাড়ি কেনার ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদেরও এ সুবিধার আওতায় আনা হয়। এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৭১৯ জন কর্মকর্তা ঋণ সুবিধায় গাড়ি কিনেছেন। এটি সম্পূর্ণ সুদমুক্ত ঋণ। বরং নির্দিষ্ট হারে অবচয় বাদ দিয়ে একজন কর্মকর্তাকে শেষ পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ করতে হবে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা।

সূত্র: যুগান্তর

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর