বঞ্চনা নিয়ে বেঁচে আছেন প্রাথমিক শিক্ষকরা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কিশোরগঞ্জের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তাসলিমা বেগম। নিয়োগের পর ১৫তম গ্রেডে বেতন পান তিনি। পরে প্রশিক্ষণ নিয়ে বেতনগ্রেড একধাপ উপরে উঠে ১৪তম হয়। প্রায় ৯ বছর তিনি এই বেতনে চাকরি করছেন। দুই সন্তানের জননী তাসলিমা বেগম যে টাকা বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। আবার সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ নিয়েও চিন্তিত তিনি। এ অবস্থায় গত ৩ বছরে অন্তত ৫ বার বেতনবৃদ্ধির দাবি নিয়ে সংগঠিত আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন তিনি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত বেতন গ্রেডের দেখা মেলেনি।

তার ভাষায়— ‘শুধু বঞ্চনা নিয়ে বেঁচে আছি।’ শুধু তাসলিমা বেগমই নন, ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় পৌনে চার লাখ শিক্ষক একই দাবি জানালেও সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি। তাই থেমে থেমে গত কয়েক বছর ধরে চলছে এ আন্দোলন। সর্বশেষ গতকাল বুধবার শিক্ষকদের ১৫টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের পূর্ব ঘোষিত সমাবেশে বাধা দিয়েছে পুলিশ। এতে আহত হয়েছেন কয়েকজন শিক্ষক। গ্রেড পরিবর্তন ও বেতন বৃদ্ধির দাবিতে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে এ সমাবেশের ডাক দেয় শিক্ষকরা। তারা শহিদ মিনারে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ তাদের বাধা দেয় এবং ছত্রভঙ্গ করে।

এসময় শিক্ষকরা শহিদ মিনারের সামনে থেকে সরে গিয়ে পাশেই অবস্থান নেন। পুলিশের বাধার মুখে আন্দোলনরত শিক্ষকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে দুই ভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্র ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের বহির্বিভাগের সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। পুলিশও দুই ভাগে শিক্ষকদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। এসময় বিক্ষোভরত এক শিক্ষককে পুলিশ আটক করার চেষ্টা করলে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে কয়েকজন শিক্ষক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান।

এদিকে, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে মহাসমাবেশে যোগ দিতে সকাল থেকেই বিভিন্ন জেলা থেকে আসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শহিদ মিনারের আশপাশে জড়ো হতে থাকেন।

প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ ছামছুদ্দীন মাসুদ জানান, প্রায় ১০ হাজার শিক্ষক তাদের এ সমাবেশে অংশ নিতে আসেন।তবে শিক্ষকদের এ সমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই শহিদ মিনার ও আশপাশের রাস্তায় বিপুল পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা অবস্থান নেন। তারা শিক্ষকদের শহিদ মিনারে প্রবেশে বাধা দেন।এ সময় শিক্ষকরা দফায় দফায় সমবেত হয়ে স্লোগান দেয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে শিক্ষকরা সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। এসময় শিক্ষকরা দাবি আদায়ের জন্য আগামী মাসের ১৩ তারিখ পর্যন্ত সময় বেধে দেন।

তারা জানান, এসময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে সমাপনী পরীক্ষা বর্জন করবেন। আগামী ১৭ নভেম্বর থেকে সমাপনী পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।

নোয়াখালীর সহকারী শিক্ষক কাজী আবু নাসের আজাদ বলেন, প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড ও সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডের দাবি নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছি। তারই অংশ হিসেবে আজ আমরা মহাসমাবেশে যোগ দিতে এসেছিলাম। আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে শহিদ মিনারে এলেও পুলিশ আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। পরে আমরা কার্জন হলের সামনে অবস্থান নিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেছি।

শিক্ষক হারুনুর রশিদ বলেন, আমাদের ন্যায্য দাবি জানাতে সমবেত হলেও পুলিশ আমাদের শিক্ষকদের ওপর লাঠিচার্জ করে সাত-আটজন শিক্ষককে আহত করে। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়াও অনেক শিক্ষক লাঠিচার্জে আহত হয়েছেন। আমাদের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নের আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত আমরা ক্লাসে ফিরে যাবো না।

এর আগে, আখেরী চাহার সোম্বা উপলক্ষে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ছুটি থাকলেও গতকাল বুধবার শিক্ষকদের কর্মস্থল ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে বিভাগীয় উপপরিচালক এবং জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়। গতকাল মঙ্গলবার শোকজ করা হয় কয়েক হাজার শিক্ষককে।

এদিকে, দাবি আদায়ের জন্য শিক্ষকরা গত কয়েকদিন ধরে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পালন করেছেন। এরমধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে গত ১৭ অক্টোবর পূর্ণদিবস, ১৬ অক্টোবর অর্ধদিবস, ১৫ অক্টোবর ৩ ঘণ্টা এবং ১৪ অক্টোবর কর্মসূচির প্রথমদিনে ২ ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেন।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদ ডাকে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। পরে কর্মবিরতি পালন করা শিক্ষকদের চিহ্নত করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।

শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিরসন না করে কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের সাথে প্রহসনমূলক আচরণ করছেন। এতে করে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান কমেছে। বেতন বৈষম্য নিরসন না হলে শিক্ষকরা সমাপনী পরীক্ষা বর্জন করতে বাধ্য হবে।

জানা যায়, ১১তম গ্রেডের দাবিতে সহকারী শিক্ষকরা ২০১৭ সালের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আমরণ অনশন শুরু করে। পরে তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার ১ মাসের মধ্যে শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে আশ্বাসে শিক্ষকরা আমরণ অনশন স্থগিত করেন। কিন্তু ২ বছর পার হলেও শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিরসন হয়নি।

জাতীয় নির্বাচনের আগে শিক্ষকরা আবারো আন্দোলনের ডাক দিলে বর্তমান সরকার তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিরসনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী সরকারের ১০ মাস পার হয়ে গেলেও সঠিক কোনো উদ্যোগ না থাকায় শিক্ষকরা আবারো আন্দোলনের ডাক দেয়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর