দারিদ্র্য দূূরীকরণে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

আফতাব চৌধুরী  :   কোনো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার স্পষ্ট পরিচয় পেতে হলে এর অর্থনৈতিক কাঠামোর অধ্যয়ন আবশ্যক। প্রাকৃতিক সম্পদ, জনসংখ্যা, মূলধন গঠনের হার, কৃষি ও শিল্পের অবস্থা, জাতীয় আয় ও এর বণ্টন, মাথাপিছু আয় ও জনগণের জীবনযাত্রা প্রণালী প্রভৃতি থেকেই কোনো দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো বুঝা যায়। তাছাড়া শিক্ষা, আয় ও স্বাস্থ্যসেবা এ তিনটি সূচক মোটামুটিভাবে মানুষের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করে এবং সামগ্রিকভাবে এ তিনটি এক সঙ্গে মানব উন্নয়ন সূচকও নির্ধারণ করে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক স¤পদ ও মানবশক্তি রয়েছে তার যথাযথ ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারলে জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাবে ও জীবনযাত্রার মানের বিশেষ পরিবর্তন ঘটবে, এতে সন্দেহ নেই। এ কথা অনস্বীকার্য, পরিবার, সমাজ তথা দেশের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে অর্থনীতি। এ অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে চলা মানে লক্ষ্যহীনভাবে চলা।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে পৃথিবীর সব দেশকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। (ক) উন্নত (খ) উন্নয়নশীল এবং (গ) স্বল্পোন্নত। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে বাস করে। স্বল্পোন্নত দেশ বলতে সে সব দেশকে বুঝায় যাদের বর্তমান মাথাপিছু আয় উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অতি নগণ্য এবং দারিদ্র্য প্রকট, অথচ যাদের অর্থনৈতিক স¤প্রসারণের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় সর্বনিম্ন এবং মাঝে মধ্যে এর হ্রাস-বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমান বিশ্বে দারিদ্র্য আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা একশ বিশ কোটির কাছাকাছি। মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০১০ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ৪৬ টি দেশ ১৯৯০ সালের তুলনায় অধিক গরিব হয়েছে। প্রতি ঘন্টায় বর্তমান বিশ্বে ১২০০ শিশু মৃত্যুর কোলে মাথা রাখছে, এর একটাই কারণ-দারিদ্র। উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের মোড়কে বাজার অর্থনীতির ভিত্তি উন্নয়নের মূল কথা হল, জনপিছু সর্বোচ্চ উৎপাদন, সর্বাধিক কর্ম সংস্থান নয়। এ হচ্ছে বিশ্বায়নের ফসল। আমাদের মত গরিব দেশ ও মানুষের কাছে বিশ্বায়ন চিরদিনই অধরা হয়ে থাকবে। তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতি বিশেষ করে বিত্তীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশ্বায়নের প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে হলে সরকারের চরিত্র ও মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

সে জন্য প্রথমেই যে কাজটি জরুরি তাহল, দারিদ্র্য কাকে বলে তা যদি সঠিকভাবে নিরূপিত না হয় তবে দারিদ্রের সংজ্ঞা নিয়ে যেমন বিতর্ক থাকবে তেমনি বিতর্ক থাকবে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারীদের সংজ্ঞা নিয়েও। জাতীয় আয়ের অনুপাতে নিম্নতম আয় কাদের এবং কেন তা নিরূপিত হবে না, হতে পারে না। জাতীয় আয়ের কত শতাংশ আয়ের ভাগীদার ওই দরিদ্র ও দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারীরা, তারও সঠিক কোনো তথ্য আজ পর্যন্ত তুলে ধরা হয়নি কোথাও। নুন্যতম মজুরিকে যদি দারিদ্র সীমায় ধরা হয় তাহলে দেশে দরিদ্রের সংখ্যা কত দাঁড়াবে এ বিষয়েও নির্দিষ্ট তথ্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়। সঠিক তথ্যের অভাবের ফলে দৃঢ় এবং বলিষ্ঠ অর্থনীতি অবশ্যই আশা করা যায় না।

বাংলাদেশে দারিদ্র অতি প্রকট। এটি অর্থ ব্যবস্থাকে আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। চরম দারিদ্র্য প্রতিটি স্বল্পোন্নত দেশে চক্রের মত আর্বতনশীল। এ সব দেশে লোকের আয় কম। আয় কম হলে সঞ্চয়ও কম হয়, মূলধন গঠন কম হয় এবং মূলধন গঠন কম হলে বিনিয়োগ সম্ভব হয় না। তাই আয় বৃদ্ধির সুযোগ ঘটে না। অর্থাৎ মাথাপিছু আয়ের স্বল্পতাই নিদারুণ দারিদ্র্যের কারণ, এ নিদারুণ দারিদ্র্য প্রতিটি স্বল্পোন্নত দেশের একটি প্রধান সমস্যা। এ প্রসঙ্গে Prof. Regner Nurksee মন্তব্য করেছেন, ‘কোনো দেশ দরিদ্র বলেই দরিদ্র হয় অর্থাৎ জনসংখ্যার বিপুল অংশ দরিদ্র বলেই কোনো দেশ দরিদ্র হয়। তাই দেশের অগণিত মানুষকে অতিশয় দুঃখ-কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়। এখন প্রশ্ন জাগে, স্বল্লোন্নত দেশগুলোতে দারিদ্রের প্রবণতা বৃদ্ধির মূল কারণ কী? বিভিন্ন তথ্য ভিত্তিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা গেছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে দারিদ্র্যের প্রবণতা বৃদ্ধির অনেক কারণের মধ্যে অজ্ঞতা ও নিরক্ষরতা, অধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ধর্ম-বর্ণ স¤প্রদায়গত ভেদাভেদ এবং দারিদ্র পছন্দ করা অন্যতম।

এছাড়া- (১) স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে মাটির মালিক হওয়াকে বিশেষ মর্যাদার বিষয় বলে গণ্য করা হয়। ফলে সল্প ও মুনাফাহীন হলেও প্রত্যেকেই নিজের নামে এক খন্ড জমি পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। এ মোহ এবং উত্তরাধিকার আইন নামক নিযুক্ত ব্যক্তি প্রকৃত পক্ষে যার কৃষি জমির বিশেষ প্রয়োজন নেই, সে ব্যক্তিও পৈতৃক স¤পত্তির অতি ক্ষুদ্রতম জমি খন্ডটুকু ভাগ করে নিতে দ্ধিধাবোধ করে না। (২) আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায় ৪০ শতাংশ লোক দিনে এক বেলাও আহার সংগ্রহ করতে পারে না। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় বাংলাদেশের প্রায় ৫০ শতাংশ লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করেন, ৩০ শতাংশেরও কিছু বেশি লোক দু’ বেলা পেট ভরে খেতে পায় না। এমত ক্ষেত্রে দেশের উৎপাদিত খাদ্যশস্য যে সব সময়ই উদ্বৃত্ত থাকবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয় না। অভ্যন্তরীণ স্তরে এই যে অসম বন্টন তার প্রতিকারের কোনো সদিচ্ছা যে রাষ্ট্র নেতাদের আছে, এমন কোনো আভাস লক্ষ করা যাচ্ছে না। ফলে একদিকে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত পণ্য গুদামে থাকবে এবং পচে নষ্ট হবে অন্যদিকে দেশের মানুষ না খেয়ে মরবে। (৩) অল্প উন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যা অধিকহারে বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণ গরীব পিতামাতা ধরে নেন যে, সন্তানের সংখ্যা অধিক হলে ভবিষ্যতে পরিবারের আয় বৃদ্ধি পাবে। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা অধিক সন্তানের জন্ম দেন। তাছাড়া চরম দারিদ্রের দরুন হতাশাগ্রস্ত মানুষ কাম-ক্ষুধা চরিতার্থ করে সাময়িকভাবে পেটের ক্ষুধা থেকে মুক্ত থাকতে চায়। (৪) অর্থনৈতিক বণ্টন ব্যবস্থার বৈষম্য সামাজিক স্তরে এক বিরাট পার্থক্যের সৃষ্টি করে। এটি খুব ধীর গতিতে কাজ করে বলে সহজে এ কারণটিকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। সরকার সব দেশেই আপন আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি হাতে নিলেও সেগুলো রূপায়ণের দায়িত্ব যেসব সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীর ওপর ন্যস্ত থাকে তাদের নিষ্ঠা, সততা ও কর্ম প্রচেষ্টার অভাব প্রকল্পগুলো থেকে যে সুফল লাভের আশা করা হয় সেটি লাভ করা যায় না। (৫) সামাজিক শ্রেণি বিভেদ, বর্ণ ও স¤প্রদায়গত বিভেদ, কর্মে শ্রেণি বিভেদ, উচ্চ-নিচ ভেদাভেদ এবং নিরক্ষরতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্যের সৃষ্টি করে। আমরা দেখেছি নিরক্ষরতা, জাত-পাতের বৈষম্য, সরকারি আমলা ও কর্মচারীদের দুর্নীতি, সরকার গৃহীত প্রকল্প রূপায়ণ ক্ষেত্রে পার্থক্য সৃষ্টি করে চলেছে। এর ফলে দারিদ্র্য মোচনে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাস্তবে কোনো স্থির পরিবর্তন ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাছাড়া এদেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের নিরক্ষরতা তাদের বঞ্চিত থাকার সুযোগ করে দিচ্ছে। (৬) দেশে জনপ্রতি আয় বা জিডিপি বৃদ্ধি হলেই সে দেশে দারিদ্র্য কমে যাবে এমনটি মনে করা যুক্তিসঙ্গত নয়। ইতিপূর্বে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ইউনূস উল্লেখ করেছিলেন, কোনো দেশে দুর্ভিক্ষের মূলে খাদ্য দ্রব্যের অভাব নয়, বণ্টন বৈষম্য ও সরকারের উদাসীনতাও খাদ্য দ্রব্যের প্রাচুর্যের মধ্যে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করতে পারে। (৭) দ্রুত উন্নয়নের লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার ফলে স্বল্পোন্নত/ উন্নয়নশীল দেশের কৃষি উৎপাদনের পরিকাঠামোই ভেঙ্গে পড়েছে। ফলে কৃষি ক্ষেত্রে যে বিপুল কর্ম সংস্থানের সম্ভাবনা ছিল সেটিও সংকুচিত হয়ে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে। এ অবস্থায় অনিবার্যভাবেই চলেছে সে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, যাদের ক্রয়ক্ষমতা বাজার দরের নিচে। ফলে অপর্যাপ্ত শস্য উৎপাদন ঘটলেও সেটি লভ্য নয় বহু কোটি মানুষের কাছে। দারিদ্র্য ও ক্ষুধা এখন হাত ধরাধরি করে গ্রাস করতে চলেছে মানবকুলকে। কোটি কোটি মানুষ এমন স্তরে রয়েছে, যাদের ক্রয়ক্ষমতা বলতে কিছুই নেই এবং তার কারণ দারিদ্র্যের বিস্তৃতি লাভ। বিশ্বের অর্থনৈতিক ধারা এমনভাবে প্রবাহিত হচ্ছে যা বিত্তশালীকে আরও বিত্তবান হতে সাহায্য করছে কিন্তু দারিদ্র্যে নি®েপষিত জনগণের সে অর্থনীতি সামান্যতম সহায়তা করছে না। খাদ্য ও পণ্যসামগ্রীর মূল্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থপূরণে নিরূপিত হচ্ছে। প্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে সব নতুন কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে তার সিংহ ভাগই বিশেষ নির্দিষ্ট কারিগরি দক্ষতার দাবি করে যা অধিকাংশ সাধারণ শিক্ষিত ব্যক্তির আয়ত্বের বাইরে।

দেখা যাচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন কারণে দারিদ্র্যের পরিমাণ ও গভীরতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে দারিদ্র্য দূরিকরণ প্রকল্পে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে- (১) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আয়ের সুষম বণ্টন হতে পারে। কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে মাথাপিছু আয় হ্রাস পাবে ফলে আয়গত বৈষম্য দেখা দিবে। সে জন্য দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে জš§ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে হবে। (২) বাজার অর্থনীতিতে দারিদ্র্য সীমারেখা মুছে যাবে না। তাই ভূমি সংস্কার এবং গ্রামোন্নয়নের মাধ্যমে সহনশীল উন্নয়নই হল দারিদ্র্য মোচনের চাবিকাঠি। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করেন এবং এ অধিকাংশ মানুষই কৃষির উপর নির্ভরশীল। ভূমি আইনের সংস্কার সাধন করে ভ‚মিহীন কৃষকদের মধ্যে ভ‚মি বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। ফলে একদিকে যেমন কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে আয়ের অসমতাও দূর হবে। (৩) দরিদ্র শ্রেণির লোকেরা যে সকল অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য ভোগ করেন সে সকল দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে এবং এ সকল দ্রব্যের সাধারণ বণ্টন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। (৪) অনুন্নত অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যুৎ, পানীয়জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে পশ্চাৎপদ অঞ্চলের উন্নয়ন সম্ভব। ফলে ওই অঞ্চলের মানুষের আয়ের বৃদ্ধি ঘটবে ও আয়গত অসমতা অনেকাংশে হ্রাস পেতে থাকবে। (৫) গ্রামাঞ্চলের দারিদ্র্য দূরীকরণের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা ও শিল্প ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীভ‚ত করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে যদি আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি ও অন্যান্য ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব হয় তা হলে দারিদ্র্য দূরীকরণের পথে অনেক দূর অগ্রসর হওয়া যাবে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অধিকাংশ লোক দারিদ্র্য সীমারেখার নিচে বাস করে তাই গ্রামীণ অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়ন দ্রুতগামী করে দারিদ্র্য নির্মূলীকরণ সম্ভব। তাছাড়া স্ব-নিযুক্তি প্রকল্প কিংবা কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে আয় বাড়াবার ব্যবস্থা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে দারিদ্র্য সংকোচন সম্ভব। (৬) শহর ও গ্রাম ভিত্তিক নিযুক্তির জন্য সরকারেরও নীতি নিদের্শিকা তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া স^চ্ছ ও সাবলীল করতে হবে। শিল্প-কলকারখানা ও মূলধন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক নিয়োগও বৃদ্ধি করতে হবে। ফলে আয়ের বৈষম্য অনেকটা হ্রাস পাবে। (৭) উৎপাদন ব্যবস্থায় সরকারের একটি নির্দিষ্ট নীতি থাকা প্রয়োজন। দ্রব্য সামগ্রীর উপর সরকারি কর বা রেহাই মূল্য পরিকল্পনা ও নীতির মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে যাতে দেশের অধিকাংশ মানুষ এর সুবিধা লাভ করতে পারে। জনসাধারণের মঙ্গলার্থে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারকে ক্ষতিও স্বীকার করতে হবে। তাই দারিদ্র্যের স্বার্থে ভর্তুকি থাকা বাঞ্ছনীয় আর তখনই আয়ের সুষম বণ্টন সম্ভব হবে। (৮) আয়ের বণ্টনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মজুরিনীতি থাকতে হবে। শিল্প ও কৃষি উভয় ক্ষেত্রেই ন্যূনতম মজুরি-নীতি ও জাতীয় মজুরি-নীতির দ্বারা ঠিক করতে হবে, এতে আয়ের সুষম বণ্টন হবে এবং আয়গত বৈষম্য অনেকটা হ্রাস পাবে। (৯) সরকারি নীতি নির্ধারণ করে একচেটিয়া ব্যবসার উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ সঠিক ও কঠোর করতে হবে। দেশের আয় কতিপয় মানুষের হাতে না গিয়ে বরং সব শ্রেণির মানুষের হাতে, যাতে যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে আয়গত অসমতা দূর হবে। (১০) বিগত কোনো কোনো সরকারের আমলে দরিদ্রের জন্য সরকারি কর্মসূচি নিয়ে কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করার চেষ্টা হয়েছিল, এখনও হচ্ছে কিন্তু তখন বাজার উন্নত ছিল না, এখন বাজার অনেক উন্নত। সুতরাং এখন গরিব মানুষকে বাজারের জন্য তৈরি করে দেওয়াটা অনেক বেশি জরুরি।

মানব সম্পদ উন্নয়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিরাট সংখ্যক গরিব লোকের বাসভ‚মি ও পৃথিবীর ১৭৪টি গরিব দেশের মধ্যে এর স্থান ১৫৮ নম্বরে। এটি খুবই বেদনাদায়ক বার্তা। কাজেই বাংলাদেশের রাষ্ট্র নেতাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ হওয়া উচিত কৃষি ও কৃষিজীবী সম্বন্ধে যথাযথ পরিসংখ্যান নির্ণয়, দারিদ্র্য সীমারেখার যথাযথ সংজ্ঞা নির্ধারণ, দারিদ্র্যসীমায় বসবাসকারীর সংখ্যা কত তা নিরূপণের প্রতি তীক্ষ্ন দৃষ্টি দেওয়া। যদি তা না হয় তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় রাজনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং জাতীয় স্তরে বিশৃঙ্খলা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়াবে। সেজন্য জনপ্রতি আয় বা জিডিপি এর হিসাবের চেয়েও এখন প্রধান প্রয়োজন সে সব অঞ্চল ও শ্রেণিগুলোকে চিহ্নিত করা যেগুলো দারিদ্র্য কবলিত অবস্থায় রয়ে গেছে। এরপর এদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য গৃহীত কর্মসূচি স¤পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না সেদিকে কঠোর নজরদারি করা যাতে প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থ যথার্থ ও স¤পূর্ণরূপে হিতাধিকারীদের উন্নয়ন সুনিশ্চিতকরণে ব্যয় হয়। প্রকল্প রূপায়ণের পরবর্তী স্তরে এটির ফলাফলে সমীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। রয়েছে পরবর্তী প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন।

বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা সে জন্যই বিশ্বের রাষ্ট্র প্রধানদের আগাম ভয়াবহতা স¤পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে। ক্ষুধার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিশ্রুতিকে মনে করিয়ে দিয়ে বলেছে, ক্ষুধা নিরসনের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দ যদি এখনও সুনিশ্চিত করা না হয় তবে দুর্ভিক্ষের কালোছায়া আরও প্রসারিত হবে এবং মানব সভ্যতার অগ্রগতিকেই বাধাগ্রস্ত করে তুলবে। প্রতিকারের প্রথম স্তর হিসাবে তারা পরামর্শ দিয়েছে ক্ষুধা নিবৃত্তি ও খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা আনয়নের জন্য প্রথম প্রয়োজন বাস্তব স¤মত অর্থনৈতিক অধিকার সুনিশ্চিত করা এবং কৃষি ও গ্রামের উন্নয়ন ঘটানো। আমরা চোখের সামনে দেখতে পাই আমাদের দেশ খাদ্যে স^য়ম্ভর হওয়া সত্তে¦ও বিভিন্ন স্থানে সময়ে সময়ে দুর্ভিক্ষের কালোছায়া ঘনিয়ে উঠে। সেক্ষেত্রে খাদ্য সামগ্রীর অসম বিতরণ ব্যবস্থা যেমন দায়ী তেমনি গ্রামীণ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের অভাবও সমভাবে দায়ী। অথচ দেশে গ্রামোন্নয়নে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় হওয়া সত্তে¦ও গ্রামগুলোর অবস্থার তারতম্য কেন ঘটছে না সে অনুসন্ধানের প্রয়োজন কেউই অনুভব করছে না। গ্রামোন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকা কোনো কাজে ব্যয় করা হচ্ছে সেটি নির্ণয় করা এখন আবশ্যক। অন্যথায় সাধারণ দরিদ্র মানুষেরা বিশেষত গ্রামীণ জনসাধারণের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যেতে পারে এবং তাদের বিদ্রোহ শাসকগোষ্ঠির সমস্ত নিরুদ্বিগ্ন গণনাই বিপর্যস্ত করে দিতে পারে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর