একটি স্থান শূন্য হওয়ার কষ্ট

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সাংবাদিক দিল মনোয়ারা মনু আর নেই। এ সত্যটি মেনে নেয়া যেমন কষ্টের, তেমনই স্থান শূন্য হওয়ার আরেকটি দিক আমাদের সামনে। দিল মনোয়ারা মনুর সঙ্গে আমার প্রায় পঁচিশ বছরের পরিচয়।

প্রথম পরিচয় হয় ‘পাক্ষিক অনন্যা’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে। লেখালেখির সূত্রে বিভিন্ন সময়ে ‘পাক্ষিক অনন্যা’ অফিসে গিয়েছি। দেখেছি মনুর কাজের স্পৃহা, নিষ্ঠা এবং কত দায়িত্বের সঙ্গে একটি জায়গাকে সুন্দরভাবে ধরে রাখতে হয়। সেই প্রেরণার উৎসও দেখেছি তার মাঝে।

১৯৯৪ সালে ‘অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার’ প্রবর্তিত হয়। নারী লেখকদের এ পুরস্কার দেয়া হয়। শুরুর দিকে পুরস্কারের জন্য যাদের নির্বাচিত করা হতো সেই নির্বাচনে নিরপেক্ষতা ও পুরস্কারের মর্যাদায় কোনো ধরনের ব্যত্যয় হতো না। সবাই একসঙ্গে অভিনন্দিত করত পুরস্কৃত লেখককে। এমনই ছিল নির্বাচনের নিষ্ঠা।

পুরস্কার প্রদানের প্রধান ছিলেন সেসময়ের ‘পাক্ষিক অনন্যা সম্পাদক’ তাসমিমা হোসেন। তখন শুনতে পেতাম দিল মনোয়ারা মনু যাকে নির্বাচন করতেন, তাসমিমা হোসেন তাকে সঠিক নির্বাচন বলে মেনে নিতেন।

এভাবেই দিল মনোয়ারা মনুর নিরপেক্ষ কাজের নিষ্ঠা আমার দেখার সুযোগ হয়েছিল। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রটি দিল মনোয়ারা মনু নিজের চেতনার আলোকে বড় পরিসরে উজ্জ্বল করে তুলতেন। কখনও কোনো পিছু টান তার সাংবাদিকতার ক্যারিয়ারকে ক্ষুণ্ণ করেনি।

পাশাপাশি ‘ঈদসংখ্যা অনন্যা’ও ছিল আমাদের সাহিত্যের মেধা বিকাশের একটি দিক। অন্যদিকে এ পত্রিকায় দিল মনোয়ারা মনু নারী ইস্যুকেও জেন্ডার সমতার আলোকে উপস্থাপন করার কাজ করেছেন। তখন থেকে দিল মনোয়ারা মনুর এ কাজের পরিসর দেখে আমি তাকে সাহসী, সচেতন একজন ব্যক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করেছি।

তিনি কখনও তার কাজের ক্ষেত্রকে মলিন হতে দেয়নি। তার নিজের লেখার জগতটিও ছিল বিষয়কে বিশ্লেষণ করে প্রকাশ করার একটি বড় জায়গা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা মনুর মাধ্যমে নানা বৈচিত্র্যে চিত্রিত হয়েছে। দিল মনোয়ারা মনু মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছেন নারী-পুরুষের সম্মিলিত শক্তির জায়গা হিসেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা শুধু পুরুষের একক সংগ্রামের বিজয় নয়। নারী তার সবটুকু শক্তি দিয়ে এ যুদ্ধের সক্রিয় সহযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দিল মনোয়ারা মনুর লেখার কয়েকটি উদ্ধৃতি এমন-

২০১৭ সালের ২০ মার্চ দৈনিক যুগান্তরে ‘মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের বীর সেনানী শারাহ বানু শুচি’ শিরোনামে দিল মনোয়ারা মনু লিখেছেন, ‘একাত্তরের পুরো বছরটাই কেটেছে শুচির পথে পথে। অগ্নিঝরা মার্চে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধ তৈরির কাজে যুক্ত হন তিনি। এপ্রিলে বাংলার নিভৃত গ্রামবাসীর সঙ্গে থেকে পাকবাহিনীকে পিছু হটার লড়াইয়ে অংশ নেন।’…

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নারীর সাহসী ভূমিকার চিত্র তার লেখায় প্রকাশ পেয়েছে এভাবে।

দৈনিক যুগান্তরে ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল ‘যুদ্ধজয়ের এক ভয়ঙ্কর গল্প শোনালেন ডা. লতিফা শামসুদ্দিন’ শিরোনামে দিল মনোয়ারা মনু লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে কালীতলা হাটে সরকার একটি তিনতলা বাড়ি ভাড়া করে যুদ্ধে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত, অসম্মানিত নারীদের চিকিৎসার জন্য একটি সেন্টার তৈরি করে।

চিকিৎসার জন্য সেখানে ৬০জন নারীকে রাখা হয়। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান আমাকে দায়িত্ব দেন তাদের গর্ভপাত করানোর জন্য। কিন্তু অভিজ্ঞতা না থাকায় এ কাজ করতে আমি অজ্ঞতা প্রকাশ করি। ঠিক এ সময়ে আমাদের দেশের অভিজ্ঞ প্রসূতিবিদরা ফিগো সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

ইউকে, ভারত থেকে আগত অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এ হাসপাতালের সেপটিক ওটিতে এই সময়ে ৬০জন নারীকে আনা হয়। একদিন বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, আমাদের হাসপাতালের ছাদে একটি হেলিকপ্টার এসে নামে। একজন সাদা পোশাক পরা দীর্ঘদেহী সৌম্য সপ্রতিভ বিদেশি চিকিৎসক হেলিকপ্টার থেকে নামেন।

আমি তখন সেই ৬০জন নারীকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম, তার ভাষা আমি বুঝলাম না কিন্তু এটা বুঝতে পারলাম ওই গর্ভবতী মেয়েদের কাছে যেতে চাচ্ছেন তিনি। পরে দেখলাম উনি সঙ্গে করে লেমিনেটেড টেন্টের মতো স্টোরাইড কাঠি এনেছেন। গর্ভবতী নারীদের জরায়ুর মধ্যে ওগুলো ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য আমাদের নির্দেশ দিলেন’…

দিল মনোয়ারা মনুর এ লেখার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পাশবিক নির্যাতনের শিকার নারীদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছিল- এ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি জানা যায়।

সেসঙ্গে ইউকে, ভারত থেকে আগত অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের পাশাপাশি ডা. লতিফা শামসুদ্দিনসহ আমাদের দেশের চিকিৎসকরা তাদের সেবা, শুশ্রুষা, ভালোবাসা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার যে অবিরল চেষ্টা চালিয়েছিলেন সেই সত্যটিও প্রকাশ পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের গবেষণার ক্ষেত্রে এটি কাজে লাগবে। এ গুরু দায়িত্বটি দিল মনোয়ারা মনু তার লেখার মাধ্যমে পালন করেছেন।

দৈনিক যুগান্তরে চলতি বছরে ২৫ মার্চ ‘বাবার রক্ত বৃথা যেতে দেননি মুকুল মজুমদার’ শিরোনামে প্রকাশিত দিল মনোয়ারা মনুর আরেকটি লেখায় জানা যায়, ‘আমাদের দলের সঙ্গে ৯ মাসের শিশু নিরঞ্জন ও তার মাও ছিলেন। আমরা ধরা পড়ে যাব সেই আশঙ্কায় বাচ্চার কথা শুধু নয়, কাঁদতেও দেয়া হয়নি। তিনদিন শুধু ওর মায়ের আনা রান্না করা বার্লি ছাড়া কিছু খায়নি। ছেলেটি পড়ে মারা যায়। আঠারো দিন আমাদের সঙ্গে থাকা এ শিশু নিরঞ্জনের অসহায় মৃত্যু এখনও আমাকে কষ্ট দেয়।’

… একজন মুক্তিযোদ্ধা মুকুল মজুমদার একাত্তরে শহীদ বাবার স্মৃতিচারণের পাশাপাশি একজন শিশুর নির্মম মৃত্যুর বর্ণনা দিয়েছেন। সাবলীল ভাষায় দিল মনোয়ারা মনু তার লেখনীতে প্রকাশ করেছেন। যা পাঠকের হৃদয়কে আলোড়িত করে। একজন লেখক হিসেবে দিল মনোয়ারা মনুর এখানেই স্বার্থকতা।

তিনি তার লেখায় তথ্য দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি। তার লেখার শ্রুতিমাধুর্য্য বাক্য গঠন পাঠকের কাছে যথার্থ গ্রহণযোগ্যতাও অর্জন করেছে ।

এভাবেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দিল মনোয়ারা মনু তার লেখার এ জায়গাটি ধরে রেখেছিলেন। এজন্যই মনে হয়েছে মনুর না থাকা আমাদের জন্য একটি জায়গা শূন্য হয়ে যাওয়া।

অপরদিকে কচিকাঁচার মেলার সঙ্গে দিল মনোয়ারা মনুর যে যোগাযোগ ছিল সেটাও আমাকে মুগ্ধ করেছে। শিশুদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার জন্য মনু নিরলস চেষ্টা করেছেন। কচিকাঁচার মেলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে কাছ থেকে দেখেছি দিল মনোয়ারা মনুর এ কাজের পরিধি।

এভাবে সমাজকে আলোকিত রাখার যে চেষ্টা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সচেতনভাবে মানবিকবোধে সমুন্নত থেকে মনু এ চেষ্টাই করে গেছেন। তার চেতনার দীপ্তি সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে এক স্থির ধ্রুবতারা ছিল। এভাবে দিল মনোয়ারা মনুকে স্মরণ করে কষ্টের মাঝে শক্তির দিকটি খুঁজে পাই।

তার আত্মার শান্তি কামনা করি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর