মা-বাবাকে হত্যার পর ঐশীর কৌশল

ধানমণ্ডির অক্সফোর্ড স্কুলে ভর্তি হয়েই পাল্টে যান ঐশী। বেপরোয়া জীবনযাপন, প্রেমের ছড়াছড়ি ও মাদকে ডুবে যান তিনি। এতে বাধা দেন তার মা-বাবা। আর তাতেই প্রতিশোধ নেয়ার পথ বাতলে নেন ঐশী। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে শুরু করেন নিজের মা-বাবাকে হত্যার করার। স্ত্রী, দুই সন্তান এবং শিশু গৃহকর্মীকে নিয়ে মালিবাগের চামেলীবাগের এক ফ্ল্যাটে থাকতেন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান। ২০১৩ সালের ১৬ অাগস্ট ওই বাসা থেকেই তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, আগের রাতের কোনো এক সময় কফির সঙ্গে ঘুমের বড়ি খাইয়ে বাবা-মাকে কুপিয়ে হত্যা করেন ঐশী। পরদিন সকালে সাত বছর বয়সী ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান তিনি। পরে ভাইকে এক প্রতিবেশীর বাসায় পাঠিয়ে একদিন পর গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে রমনা থানায় আত্মসমর্পণ করেন। তার বক্তব্যের সূত্র ধরে রনি ও জনিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ সবাইকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে। ঐশীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে। সেখানকার জীবনযাপন তার ভালো লাগেনি। তাই স্কুল বদল করতে বাবা-মাকে চাপ দিতে থাকেন। বায়না ধরে ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড স্কুলে ভর্তির। ঐশী ছিল বাবা-মায়ের বড় মেয়ে। তাই তার সব আবদার রক্ষার চেষ্টা করতেন বাবা-মা। যা চাইতেন তা-ই দেয়ার চেষ্টা করতেন। এরই একপর্যায়ে ২০১১ সালে ঐশীকে ধানমন্ডির অক্সফোর্ড স্কুলে ভর্তি করে দেন বাবা-মা। ভর্তির পর স্কুলের গাড়িতেই যাতায়াত করতেন ঐশী। মাঝে-মধ্যে রিকশা নিয়ে যেতো। সেখানে ভর্তির পরই ঐশীর আচরণ ও জীবন-যাপনে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। বেপোরোয়া জীবনাপনের কারণে তার মা বকা-ঝকা করতেন। স্কুলের কথা বলে সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে কখনো রাত ১০টা, কখনো ১১টায় ফিরতেন বাসায়। স্কুল ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিতেন ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে। যোগ দিতেন ইয়াবা ও গাঁজার আসরে। আড্ডার আসরেই পরিচয় হয় পুরান ঢাকার ডিজে জনির সঙ্গে। তার সঙ্গে কিছুদিন মেলামেশার পর তারই বন্ধু রনির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় ঐশীর। রনি ও জনির মাধ্যমেই মূলত নেশার জগতে পা রাখা ঐশীর। তেমনই একজন প্রেমিক পারভেজ। এই পারভেজের নির্দেশনা মোতাবেকই ঐশী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী জানান, ঐশীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় তার মা। এরপর থেকে বন্ধু মহলের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে তিনি। নিজের বাবা-মাকেই প্রধান শত্রু বলে মনে করেন। এ অবস্থায় কখনো নিজেকে শেষ করা আবার কখনো বাবা-মাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করতে থাকেন। একপর্যায়ে ঐশী ১২ পৃষ্ঠার সুইসাইডাল নোট লিখে বাসায় রেখে দেন। লাশ উদ্ধারের পর বিভিন্ন আলামতের পাশাপাশি ঐশীর হাতের লেখা ওই চিঠি উদ্ধার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। সেখানে তার জীবনের সুখ-দুঃখ ও কষ্টের কথা প্রকাশ করেছে। নিজেকে খারাপ প্রকৃতির মেয়ে হিসেবে দাবি করার পাশাপাশি কেউ তার কষ্ট বুঝতে চায়নি বলেও দাবি করা হয়। এ কারণেই আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজেকে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে শেষমেষ ঐশী আত্মহত্যা না করে তার বাবা-মাকেই হত্যা করেন। গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, ঐশী নিজের বাবা-মাকে খুন করেই ক্ষান্ত হয়নি, আলমারিতে রাখা স্বর্ণালঙ্কার ব্যাগে ভরে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। পুলিশের ভাষ্য, বাবা-মাকে হত্যার আগে সন্ধ্যার পর মায়ের জন্য তৈরি করা কফিতে ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে দেন। মা ঘুমিয়ে পড়লে তার সঙ্গেই শুয়ে থাকেন ঐশী। রাত ১১টার পর তার বাবা বাসায় ফিরলে তাকেও ঘুমের ট্যাবলেট মিশ্রিত কফি খেতে দেন তিনি। তিনিও ঐশীর বেডরুমে ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর রাত ২টার দিকে ঐশী খঞ্জর টাইপের একটি ধারালো ছুরি নিয়ে ঘুমন্ত মায়ের ওপর হামলে পড়েন। প্রথম কোপেই তার মা জেগে উঠেন। এরপর এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। একপর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েন মা। ছোট ছেলে ঐহী মায়ের সঙ্গেই ঘুমিয়ে ছিল। হত্যাকাণ্ডের সময় সে জেগে ওঠে। তখন তাকে ধরে নিয়ে বাথরুমে আটকে রাখে ঐশী। এরপর বাবার গলায় খঞ্জর চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। মৃত্যু নিশ্চিতের পর কৌশল আঁটে ঐশী। সহযোগিতা চায় কাজের মেয়ের। হত্যার পর কাজের মেয়ে সুমির সহায়তায় তাদের লাশ কাপড়ে মুড়িয়ে টেনেহিঁচড়ে বাথরুমে নিয়ে ফেলে রাখা হয়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর